অনুজীব বিজ্ঞান বিভাগের বিষয়টা আশা করি সকলেই খেয়াল করেছেন। নামকরা সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচটড করে আসা প্রার্থীদের বাদ দিয়ে তুলনামূলকভাবে বেশ পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের শিক্ষক বানানো হয়েছে। বিষয়গুলো এত নৈমত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে যে আজকাল মানুষজন এগুলো নিয়ে আর প্রায় কথা বলে না, গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু এই সয়ে যাওয়াটাই সবচাইতে বেশি বিপদজনক।
একশো বিশ বছর আগে প্রথম একটা এশীয় রাষ্ট্র হিসেবে জাপান যখন শিল্পোন্নত দেশের কাতারে ঢুকতে শুরু করে, কোন কোন খাতে তাদের কী কী চাহিদা নিরুপন করে নিজ দেশের শিক্ষার্থীদের সেসব খাতগুলোতে পাঠাতে শুরু করে। পাঠানো শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ সেসব দেশে থেকে গিয়েছেন সত্যি, কিন্তু একটা বড় অংশকেই তারা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। এই বিষয়টা মাছের ডিম পাড়ার মতই, সব ডিম ফুটবে না, যেগুলো ফুটবে, তাদেরও সবগুলো প্রাপ্ত বয়স্ক হবার সুযোগ পাবে না। কিন্তু কিছু মাছ লক্ষ্য পূরণ করতে পারবে।
গত শতকের গোড়াতেই জাপানী শিক্ষার্থীরা যুক্তরাজ্য, জার্মানীর মত পুরনো শিল্পায়িত দেশগুলোতে নয় শুধু, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও যাওয়া শুরু করেছে জ্ঞান আর প্রযুক্তির সন্ধানে। শুধু কিন্তু কৃৎকৌশল না; ব্যবস্থাপনা শেখা, রাষ্ট্রনীতি শেখাও গুরুত্বপূর্ণ। তেমনি এক যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শিক্ষার্থীর কাছেই জাপান সংবাদ পায় নতুন আসা বেতার তরঙ্গ প্রযুক্তির, যেটা সামনের দিনে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও যুদ্ধকৌশলকে আমূল বদলে দেবে। প্রযুক্তিটির গুরুত্ব উপলদ্ধি করলেও উচ্চদামে সেটা না কিনে নিজেরাই তা বিকশিত করার সিদ্ধান্ত নেয় জাপান। সেই একই সময়ে রুশরাও বেতার প্রযুক্তির সাথে পরিচিত হয় এবং উচ্চদামে জার্মান প্রযুক্তি কেনে। ১৯০২ সালে জাপানে অবস্থান করা একজন ধর্মপ্রচারকের স্মৃতিকথায় পড়েছিলাম জাপানীরা রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবেই এটা নিয়েছিল, বিদেশী বিশেষজ্ঞদের সাহায্য তারা নিতো, কিন্তু তাদের ওপর নির্ভরশীল থাকতে চাইতো না। লক্ষ্য ছিল দেশে জনসম্পদ তৈরি করা।
ওই যে নিজের দেশে বেতার প্রযুক্তির বিকাশ, তার ফলাফল হলো ১৯০৫ সালের রুশ-জাপান যুদ্ধে রাশিয়ার গ্লানিকর পরাজয়। কেননা তারা আদ্যোপান্ত নির্ভরশীল হয়ে থাকার নীতি নিয়েছিল। রুশ যুদ্ধজাহাজগুলোতে বেতার যন্ত্রগুলো দামী জার্মান হলেও সেগুলোর ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণে নির্ভরশীলতা তাদের পরাজয়ের বড় কারণ হয়েছিল।
কাছাকাছি উদহারণ দেয়া যাবে চীনের বেলাতেও। নিজেদের জাতীয়তাবাদী বিকাশকে তখনকার আন্তর্জাতিক বাতাবরণে গ্রহণযোগ্য করতে চীনের বিপ্লবী নেতা মাও সে তুং কার্যত নতুন একটা তত্ত্ব দিয়ে বসলেন, তিন বিশ্বের তত্ত্ব। তার একদিকে রাশিয়া, একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, আরেকদিকে চীন। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে এর মর্মবস্তু ছিল জাতীয়তাবাদী। অন্য বহু রাজনৈতিক বিষয়ের সাথে চীনকে প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে নিজেদের ওপর নির্ভরশীল রাখতে চাওয়া রাশিয়ার সাথে চীনা নেতাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা , জাতীয় বিকাশের একটা আকাঙ্ক্ষারই তা প্রকাশ। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রেরও প্রয়োজন ছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রধান প্রতিপক্ষ রাশিয়ার সাথে প্রতিযোগিতায় চীনকে কাছে পাবার। নিক্সন যখন মাও সেত তুং এর কাছে তার প্রতিনিধিকে পাঠালেন, সম্পর্ক তৈরি করবার শর্তগুলো নির্ধারণ করতে, মার্কিন দূত অবাক হয়ে দেখলেন মাওয়ের প্রথম দাবি: প্রতি বছর ৫ হাজার চীনা ছাত্রকে যুক্তরাষ্ট্রে বৃত্তি দিতে হবে! মাও সে তুং কে যে তখনকার বহু কমিউনিস্ট ‘সংশোধনবাদী’ বলতেন, সেটার কারণ এইখানেই নিহিত। মাও এর সেই অধুনা-বিস্মৃত তিন বিশ্বের তত্ত্ব আসলে চীনের যে জাতীয় বিকাশের আকাঙ্ক্ষা, সেটারই একটা বহিঃপ্রকাশ। যে জন্য ঠিক মাথার ওপরে থাকা রাশিয়াকে অতিক্রম করে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক স্থাপন। বাকি সব ডালপালা ছিল এটুকুকে ন্যায্য প্রতিপাদন করবার জন্য তাত্ত্বিক ধোঁয়াশা।
কোন সন্দেহ নাই যে, যুক্তরাষ্ট্রে থেকে যাওয়া চিনা, জাপানী বা কোরীয় বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্রও বহু সুবিধা ও উপকার পেয়েছে। শুধু বিজ্ঞানে নয়, শিল্পকলা, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান– সর্বত্র। সস্তায় গরিব দেশগুলো থেকে মেধাবীদের কিনে নেয়ার এই প্রক্রিয়াটিকেই বলা হয় ‘মেধাপাচার’ বা ব্রেনড্রেইন।
জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া বা চীনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু সাদৃশ্যটুকু পরিস্কার। জ্ঞান পেতে হলে এর কোন ভিন্ন রাস্তা নেই, নতুন করে শীতলীকরণ যন্ত্র আবিষ্কার করাটা পণ্ডশ্রম।
তবে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে বাংলাদেশের সাথে এই রাষ্ট্রগুলোর তুলনা মাছের মায়ের সবগুলো ডিম খাদকের পেটে যাবার মতন। পুরোটাই মেধাপাচার। এই জন্যই সারা দুনিয়ায় অজস্র বাংলাদেশী কৃতবিদ্য মানুষ আছেন, বাংলাদেশে তারা সংখ্যায় আশ্চর্যরকমের কম। শুধু কম নন, তারা আছেন যাকে বলা যায় কোনঠাসা হয়েই আছেন। এখনও চীন কিংবা জাপান অথবা কোরীয় রাষ্ট্রনীতিতে প্রবাসীদের কতকাংশকে ফিরিয়ে আনা যায়; এরপরও যারা রয়ে গেলো তারা কিভাবে এই জ্ঞান ও পুঁজি আহরণ প্রক্রিয়ায় সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করতে পারেন, তা গুরুত্বপূর্ণ বিচার্য। আমাদের দেশের গণমাধ্যমগুলোকে বিদেশে সফলদের জীবনী প্রচার করেই ঘোলে স্বাদ মেটাতে হয়। আমাদের কৃষকের, শ্রমিকের, জনজীবনের, উৎপাদনের বিকাশের সাথে তার কী সম্পর্ক, সেটা সামান্যই ভাবা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নিয়োগ প্রক্রিয়াটা আসলে আর কিছু না, দেশের কৃতবিদ্যা শিক্ষার্থীদের বলে দেয়া, ফেরত এসো না। এমন আরও বহু দেখেছি। আমারই এক বন্ধু যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, চীনের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ছাত্রদের পড়িয়েছেন, পড়াচ্ছেন, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার সুযোগ পাননি। তিনি এমনকি এমন প্রস্তাবও রেখেছিলেন যে জ্যোর্তিপদার্থবিদ্যা পড়াবেন, সফল শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি নিজেই বাইরে পিএইচডি বৃত্তির বন্দোবস্ত করবেন। হয়তো তার এই প্রস্তাব সংকীর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে আরও আতঙ্ক তৈরি করেছিল। এমন ঘটনা একটা দুটো হয়, অজস্র। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এক সৃহৃদকে দেখেছি মর্মযাতনা প্রকাশ করতে, কেননা তাদের বিশেষজ্ঞতা প্রায় কোন কাজে লাগেনি ভয়াবহ এই মহামারী প্রতিরোধে।
এই যে শিক্ষকের বদলে অনুগত ভোটার নিয়োগ করা হচ্ছে, এর ফলাফল কতটা ভয়াবহ হবে তা এখনই আমরা দেখতে পাচ্ছি। ‘চাপ-চপ-সিঙ্গারা’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রমাগত সংকীর্ণ ও সংকুচিত হয়ে আসা এই বিদ্যায়তনিক বাতাবরণে আপনারা অচিরেই দেখতে পাবেন শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে হুকুম দিয়ে (বা আরেকটু নমনীয় ভাষায় নির্দেশণা দিয়ে) বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ করা হবে।
এখনই তা হচ্ছে কি না, তাই বা কে জানে!
– ফিরোজ আহমেদ, বিশ্লেষক, রাজনৈতিক সংগঠক