মোল্লা আল-বাতাবি হেলিকপ্টার থেকে নামার আগে
বাতাবি লেবুগন্ধী টিস্যু পেপারে মুখ মুছে নেন। একটু আতর স্প্রে করেন; যে উন্মাতাল সুগন্ধে হেলিকপ্টারের নীচে দণ্ডায়মান কিশোরেরা কাতর হয়ে পড়ে। তাদের স্বপ্ন পুরুষ অসম্ভবকে সম্ভব করা জলিলীয় আল-বাতাবি আকাশ থেকে নামছেন। তার সঙ্গে কেবল একটি সেলফি তুলে জীবন ধন্য করতে চায় তার ফ্যানক্লাব। কিন্তু তার সময় কোথায় সময় নষ্ট করার। ধমকে ছত্রভঙ্গ করে তাদের। ভলান্টিয়াররা টুপিসহ মাথার খুলি ধরে নিয়ে যায় কয়েকজন পাগল ফ্যানকে।
মোল্লা আল বাতাবির মধ্যে একই সঙ্গে একজন নায়ক শাহরুখ আবার
বক্তা জাকির নায়েকের বসবাস। নিজেকে শো’বিজের তারকা ভাবতেই তার চেহারা শাহরুখ খানে রূপান্তরিত হয়; উঁকি দিয়ে খোঁজে, ফ্যাশনেবল অজন্তার ইলোরার খাঁজ কাটা নন্দন খোঁজে; ব্ল্যাক আই মেক আপ করা হুমায়রা অটোগ্রাফ নিতে এলে; তখন নিজেকে ডন শাহরুখের মতো লাগে। বক্তৃতার মুড এসে যায়; শাহরুখ খানের মতো বাঙ্গময় ভঙ্গিতে বসে জাকির নায়েকের মতো রক্তে খিলাফতের নেশা তোলা ভাষণ দেয় তখন। যে ফ্যানক্লাবের সঙ্গে সেলফি তোলা হয়নি; হুমায়রার চোখ সমুদ্রে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যাওয়ায়; তারাও আল-বাতাবির জলিলীয় অসম্ভবকে সম্ভব করা খিলাফতের নেশায় মাতোয়ারা হয়।
“ঐ ইউরোপের দালান, নারী, সম্পদ সব তোমার জন্য উন্মুক্ত; তরবারি দিয়ে না পারো একটি ফুটবল টিমের সংখ্যক মুসলিম সন্তান উপহার দাও। দখল করো ইউরোপ-এমেরিকা। ইয়াসির আরাফাতের ভাষায় বলতে হয়, আমরা নারী গর্ভের বিপ্লব ঘটিয়ে প্যালেস্টাইনকে ইহুদি মুক্ত করবো; ইজরায়েলের আগ্রাসন রুখতে; তোমরা আমাকে অসংখ্য মুসলিম সেনা দাও।”
পাশ থেকে কে যেন ফোন ধরিয়ে দেয়, সেই ফোনে একজন বুদ্ধিজীবী টকাস টকাস করে বলেন, যেখানেই যাবেন ভাই; হেফাজতে হাউজিং সোসাইটির কথা ভুলবেন না।
” পাশের দেশটা হিন্দুত্ববাদী হইয়া গেলো; আমরা কী পেরেছি; ইসলামের ঝান্ডা ওড়াতে! যদি তাই হবে বিধর্মীরা এতো ইসলাম বিরোধী কথা কেমনে কয়; বলো তোমরা উত্তর দাও; সাইবার জিহাদে তোমাদের ভূমিকা কী!”
একটা ছেলে উত্তর দেয়, হে ইসলামি উম্মাহ’র বেতাব বাদশা; ডিজিটাল আইন আর এর আগে ৫৭ ধারা, সহমত ভাইয়েরা যেইভাবে কাজে লাগাইতে পারছে; সেইভাবে আমরা পারিনাই; এইটা সত্য জনাব।
আরেক ছেলে ফোঁড়ন কাটে, সহমত ভাই সাইবদরেরা ‘দেশদ্রোহী’র তালিকা দিয়া সামান্য হাদিয়া পায়। একটা স্ক্রিনশট আর নাম দিলেই আড়াইশত টাকা। তারা নিয়মিত বিরিয়ানি পান করে। আর আমরা পেটে ভাতে খাটি হুজুর।
ভলান্টিয়ার ধমক দেয়, উনাকে হুজুর বলো কেন! বাতাবি বাদশাদ বলো। দেখো না; উনার মুখমুবারকে বাতাবি লেবুর গোলাপী আভা!
বাদশা আল-বাতাবি বলেন, সাইবদরেরা; তাদের “স্বাধীনতা’র মর্যাদা রক্ষী”-র বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে সাইবার আইনে গ্রেফতার তালিকায় তার নাম তুলে দেয়। সাইবদর পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে যায়, কেউ জেলখানায় মরে যায়; কেউ জীবন্মৃত হয়ে জামিন পেয়ে ফেরে। তোমরাও তেমনি আমাদের “ইসলামের মর্যাদা রক্ষী’র বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে; তার নাম নাশতেকের তালিকায় দিয়ে দাও; আমাদের পরহেজগার আইনের ভূ-স্বামীরা নিশ্চয়ই তালিকা দেখে গ্রেফতার করবে। আরে পরকালের ভয় প্রধানমন্ত্রী থেকে সেপাই-পুলিশ সবার আছে। কাজেই; তারা নিশ্চয়ই ইসলামের মর্যাদা রক্ষার “শোকরানা মেহেফিলে”র কথা ভুলে যাবে না। নিশ্চয়ই তাহারা ভঙ্গ করে না ওয়াদা। যো ওয়াদা কিয়া হ্যায় নিভানা পড়েগা।
ঠিক এই সময় হুমায়রার চোখে চোখ পড়ে। “চোখ গেলো চোখ গেলো” অন্তঃসলিল সুরে হুমায়রা চোখ সরিয়ে নেয়। একটু দেরি করেই দুপুরের খাওয়ার টেবিলে বসেন বাতাবি বাদশাহ। টেবিলে সৌদি বাদশাহর’র টেবিলের মতো মনোরম খানা-খাজানা। একটা আস্ত রোস্ট করা ছাগল তার থমকে যাওয়া চোখে তাকিয়ে দেখে এই হেলিকপ্টারের ম্যাজিক কার্পেটে ঘুরে বেড়ানো ইসলামের সেবককে। হুমায়রা একটু একটু করে খাবার পরিবেশন করে, ১৩০ ডিগ্রি এঙ্গেলে; যাতে স্পর্শের গুনাহ না হয়; অথচ ভালোলাগার ভাস্কর্যটি ঠিকই চোখে পড়ে। ফিরে যাবার পথে হেলিকপ্টার থেকেই শাহরুখ খান হোয়াটস এপে চ্যাটিং শুরু করে; খিলাফত সফল হলে হুমায়রা ফার্স্টলেডি হতে পারবে এমন স্বপ্নের কথা টাইপ করতে থাকে বাতাবি বাদশাহ।
হুমায়রা শুধু টাইপ করে সেন্ড করে, আমারে একদিন হেলিকপ্টারে চড়াইবেন আপনে!
–তুমি চাইলে রকেটে কইরা সপ্ত আসমান ঘুরাইয়া আনবো তোমাকে হুমায়রাজান।
ওদিকে মোল্লা আল-বাতাবির এক পাগল ভক্ত ফেসবুকে দেখে তার হৃদয়ের বাদশা’র বিরুদ্ধে লিখেছে এক বিধর্মী। তার বুকের মধ্যে হু হু করে কান্না ঠেলে আসে। “ইসলাম খাতরে মে হ্যায়, ইসলাম খাতরে মে হ্যায়” জপতে জপতে সে মোল্লা আল-বাতাবির অন্য ফ্যানদের জোগাড় করে হোয়াটস এপ গ্রুপে। তারা পুলিশের এক ধর্মপ্রাণ কর্মীকে ফোন করে, লম্বা একটা আসসালাম দিয়ে স্যার বলে পেলব করে নিয়ে; এই কটূক্তির অভিযোগ জানায়। ডিজিটাল ওরফে ব্লসফেমি আইনে তাকে গ্রেফতারের অনুরোধ জানায়। মোল্লা বাতাবি ভক্তেরা খিলাফতের নিখুঁত অভিযানে শাল্লায় হামলা করে আল্লা হু আকবর নারা লাগিয়ে। ভাংচুর করে; লুট করে; ভয়ে পালিয়ে যাওয়া নারীদের পোশাক-আষাক থেকে তেঁতুলের ঘ্রাণ নিয়ে; গণিমতের মাল হাতের নাগালে পাইলাম না; এই আক্ষেপ নিয়ে ফিরে যায়।
তবে আল্লার যে ভীতির সঞ্চার করা হয়েছে শাল্লায়; তাতে অনেক হিন্দু পরিবারই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার কথা ভাববে; দেখলো তো এতো বছর; নিজভূমে পরবাসী হয়ে জীবন্মৃত জীবনের এই পাথর ঠেলার বুঝি শেষ নেই। ফলে সেইখানে সেই প্রাণের ভয়ে ফেলে যাওয়া বাড়ি ও জমিতে আল-বাতাবি হাউজিং সোসাইটি গড়ে উঠবে; এতো প্রায় শতবর্ষের ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি মাত্র।
শাল্লা ইস্যুটা খুব টাইমলি এসে যায় জয়শ্রীরাম বাতাবি সিংহের টেবিলে। মানবতার পিতা মোদি শান্তির মন্দির পরিদর্শনে আসছেন অতিশীঘ্র। তখন অযথা তাকে তিস্তা নদীর জল দিতে বলে; তার পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনের ধ্যানভঙ্গের চেষ্টা করতে পারে অত্র এলাকার স্বাধীনতার শত্রুরা। সুতরাং, শাল্লা ট্র্যাজেডির কার্ড টেবিলে রেখে দিলে, সেটা বেশ টেক্কার মতো দেখাবে। জয়শ্রীরাম বাতাবি রঞ্জিত সূর্যের চেয়ে বালি গরম হয়ে বলে, মানবতার পিতার আনন্দ সফরে কেউ কটূ কথা বললে, কলিজা সিঙ্গাড়া বানিয়ে খাবো বলে দিলাম।
বাতাবি সিংহ বলে, ক’টা সিঙ্গাড়া মোল্লা আল-বাতাবির দফতরেও পাঠিও; শাল্লার বলটা পাস না করে দিলে আমরা কী মোদির গোলটি এতো সুন্দর করে শান্তি মন্দিরের ডি-বক্সে প্রবেশ করাতে পারতাম।
ইসলামের ভাবমূর্তি রক্ষার দল শাল্লা বিজয়ে খুশি; হিন্দুত্ববাদের ভাবমূর্তি রক্ষার দল শাল্লা বিজয়ে অখুশি নয়; এই উইন উইন সিচুয়েশানেই চলতে থাকে ধর্ম নিয়ে রাজনীতির ক্যাসিনো। যার হুইলে-ডাইসে-তাসের খেলার উপায়হীন জোকারদের নষ্ট হবার কষ্ট মেখে থাকে।
সেলফ সেন্সরশিপের ঘাড় মটকে দেয়া ভূতের ভয়ে, পড়ে পড়ে মার খায় দরিদ্র হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃস্টান-আদিবাসী; কারাগারে পচে মরে চিন্তার জগতের সংখ্যা লঘু প্রতিবাদীরা।
আর এইসব শাসক-শোষক-পরিতোষক-স্থূল সৌন্দর্য ধারক, হস্তকচলায়েক রাজভোঁদড়দের “ধর্ম আর দেশপ্রেম কারখানা”র নিষ্কাশন নালায় ভাসতে থাকে; ত্রাসনযন্ত্রে নিষ্পেষিত প্রজাদের চাপ চাপ রক্ত। “আরে-এ-এ ভাইরে-এ-এ, গণতন্ত্রের বার বি কিউ করে উন্নয়নের রোস্ট বানাতে; এক আধটু রক্ত ঝরবেই; ও কিছুনা;” টকশোতে উপসংহার টানেন নবরত্ন সভার বিদূষকেরা।