ভারতের শান্তির দূত নরেন্দ্র মোদির রাজনীতি মূলত ইয়োগার মাধ্যমে সুস্থ দেহ; পাহাড়ের গুহায় ধ্যান করে সুস্থমনের চর্চায়। সাধারণতঃ যে নারীসঙ্গ নেশাতে দক্ষিণ এশিয়ার মৌর্য-মুঘল-সেনাশাসক-সেকুলাঙ্গারদের ক্ষমতার কেল্লা ধসে পড়েছে; মোদি সেখানে জিতেন্দ্রিয়। স্ত্রী যশোদাকে শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছেন; নারী নয়; ক্ষমতারাণীকে ভালোবাসেন তিনি। সুতরাং তিনি শুধু চা বানাবেন আর নতুন করে ভারতবর্ষের ইতিহাস লিখবেন।
পাশ্চাত্য শিক্ষিত দক্ষিণ এশীয় এলিটরা বাস করে তাদের কল্পনার বুদ বুদে। হালকা সমস্যা বোধ করলে বিদেশে পাড়ি দেয়; কমফোর্ট জোন খুঁজতে। সেইখানে হিন্দি মিডিয়াম, সংস্কৃত মিডিয়াম, অনাথ আশ্রমে আশ্রিত গোলির ধারের ছেলেটির খোঁজ কেউ রাখেনা। ক্ষমতা কেল্লার বাইরের এই নিপীড়িতদের মোদি মর্যাদা সম্পন্ন কেল্লার জীবনের স্বপ্ন দেখান। নিও রুলিং এলিট হলে, “তোমার ছাওয়ালও নেহেরুর মতো ফটাফট ইংরিজি মিডিয়ামে কথা কইবে খগেন।” এইভাবে মোদি খগেনের খড়ম পরা পায়ে ‘রামের সোনার জুতো’ পরার স্বপ্ন জারিত করে; জয়শ্রীরাম শ্লোগানে গেরুয়া বিজয় নিশান উড়িয়ে দেন দিল্লীর দরবার চূড়ায়। ইতিহাস থেকে নেহেরুকে মুছে ফেলে; সেইখানে মোদিজির স্বপ্ন নায়ক শিবসেনার গর্বিত ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতে ইতিহাসের মুনতাসির ফ্যান্টাসিদের জড়ো করেন সর্বভারত থেকে।
ক্ষমতার ‘সোনার বাছুর’ বিজেপির গোয়ালে বেঁধে রাখতে গোমাতাকে রাষ্ট্রীয় সম্মানে অধিষ্ঠিত করে মুসলমান উচ্ছেদে মরিয়া হয়ে ওঠেন দামোদরজি। নাগরিক বিল সংশোধন করে মুসলমানদের রাষ্ট্রহীন করা নরভোজি উতসবে মেতে ওঠেন যেন। গুজরাটে গোধরার হোলি খেলায় মুসলিম রঙ নিয়ে খেলার লাল রঙ এখনো তার হাতে লেগে। নৈশভোজে গোধরার মাংস খণ্ড দেখা গেলে শাকান্ন দিয়ে মাংস ঢাকেন এই মাংসের কারবারি। আরো কত রক্ত হলে তার পিপাসা মিটবে তা অজানা; কিন্তু কাশ্মীরকে ভারতের সংবিধান কাটাছেঁড়া করে মোদির সরাসরি শাসন জারি করে; গেরুয়া পতাকা উড়িয়ে দেন মোদি। তার সিপাহসালার অমিত শাহ’র চোখ দুটি উঁইপোকারা খেয়ে নিলে; অন্ধ দৈত্যের মতো সে আসমুদ্র হিমাচল দাপিয়ে বেড়ায়। আর কাউ রিপাবলিক টিভির গো-স্বামীর ‘জয়শ্রীরাম’ মাতমে ঠিক যেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালের নাতসির ঢক্কানিনাদ।
টেক্সাসের চা-ওয়ালা জর্জ ওয়াকার বুশ, আইদার ইউ আর উইদ মি অর এগেইন্সট মি সূত্র দিয়ে মুসলিম নিধনের জন্য “ওয়ার অন টেররের” যে নিওহলোকাস্ট ঘটিয়েছেন; গুজরাটের চাওয়ালা নরেন্দ্র দামোদর মোদিও তার গরীব মনে সে হোয়াইট সুপ্রিমিস্টের স্বপ্ন ধারণ করেছেন। বিগ এমেরিকান ড্রিম তাড়িত মোদির খুব শখ, মার্কিন মেরিন যেভাবে তাদের “ওয়ার অন টেরর” থিয়েটার অভিনেতা বিন লাদেনকে পাকিস্তানের আবোটাবাদে ঢুকে পুড়িয়ে গেছে ডেট এক্সপায়ার্ড এসেট বলে; গরিব বলে কী মোদির শখ আহলাদ থাকতে নেই! তারও ইচ্ছা করে সার্জিক্যাল এটাক করে পাকিস্তানের জঙ্গী নিবাস থেকে জঙ্গীর চামড়া ছিলে এনে ইলেকশান প্রচারণায় উপহার দেবে। কাউ রিপাবলিকের গো-স্বামী সিএনএন-এর আমানপোরের মতো অংকশায়িনী সাংবাদিকতা করে প্রমাণ করে দেবে; পাকিস্তান হচ্ছে ইরাক; ওখানে জনবিনাশী মারনাস্ত্র আছে। টেক্সাসের কায়দায় খুব বেশি এডভেঞ্চারাস হতে গিয়ে, গরীব ভারতের যুদ্ধ বিমান পাকিস্তানের মাটিতে উষ্টা খেয়ে পড়ে যায়। ইমরান খানের লম্বা চুলের একটিও ছিঁড়তে না পেরে একটু উহ বলে কষ্ট পান মোদি।
তবুও কাউ রিপাবলিক টিভির অংকশায়িনী সাংবাদিকতায় “পাকিস্তানে জঙ্গী ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইন্ডিয়ান মেরিন; মারা গেছে চারশো মানুষ” এই হলুদ খবর পিন্ড দিয়ে গণতন্ত্রের পিণ্ড দান সম্পন্ন হয়। মোদি দ্বিতীয়বারের মতো দিল্লীর তখত দখল করে; ভারতের আকাশে গেরুয়া আংরাখা ছড়িয়ে দিয়ে।
মোদি জানেন গো-ভোটারের মাঝে ইভিএম প্রচলন করে কীভাবে বিজয় তুলে আনতে হবে। মোদির আবার দাড়িইজম বলে একটা ইজম আছে। ফলে জামাতের-উলেমার-হেফাজতের দাড়িওয়ালা মুসলমান তার প্রিয়; এরা ভোটে খাটে; লিপসার্ভিস দেয়। শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নয়। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতেও। পাকিস্তানের মওলানা ফজলুর রহমান শিবসেনার গেরুয়া রং-এর সঙ্গে মিলিয়ে ইসলামি সেনাকে গেরুয়া সালোয়ার-কামিজ পরিয়ে ইসলামাবাদ অচল করার কর্মসূচী নিলে; খুব ভালো লাগে মোদিজির গেরুয়া রঙ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ার আবেশে।
আবার বাংলাদেশের হেফাজতের মওলানা শফিকে চিকিতসার জন্য ভারতে নিয়ে যাবার মহানুভবতা মোদিকে আরো মহান করে তোলে। ফলে মোদির বিজেপিকে মহান করে তুলতে; পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে গেরুয়া ওড়াতে; বিজেপির যা দরকার; ‘শাল্লা গ্রামে আল্লার ভীতি’ ছড়িয়ে দেয়া; যাতে হিন্দুদের তছনছ হয়ে যাওয়া বাড়িঘর; মা-বোনের অবর্ণনীয় কষ্ট দেখে; পশ্চিমবঙ্গের ভোটারদের মনে মুসলিমের নির্যাতনের বিরুদ্ধে ঘৃণা জাগে ; হিন্দুত্ববাদই একমাত্র আশ্রয় এই ধর্মযুদ্ধে; এমন একটি নির্বাচনী প্রচারণার হেফাজত মোদির দাড়িইজমের বন্ধুরা ঠিকই করেছে। বাড়তি লাভ হিসেবে হিন্দু উচ্ছেদ হলে সেখানে হেফাজত হাউজিং স্টেট গড়ে উঠবে; মোদিও ভারতের মুসলমান উচ্ছেদের সময় একটু পায়েস খেতে খেতে বলতে পারবেন, “মুসলমান মুরগীর খোপে মুসলমান মুরগা থাকবে; হিন্দু মুরগীর খোপে হিন্দু মুরগা থাকবে। এতে এতো মমতার কী আছে গো দিদি? আপোনি বোলছেন খিলা হোবে; আমি বোলছি উন্নয়ন হোবে।”
শিবসেনার বাংলাদেশ উইং শাল্লার এগিয়ে দেয়া বলটা পাস নিয়ে; মোদির সফরে কটূ কথা বললে; জিভ টেনে ছিঁড়ে নেবার মা কালীর দিব্যি দিয়ে ভারত-বিরোধী পাগল হাওয়ায় এমন দোল দিয়েছে; যে মদিনায় মিছওয়াক করতে করতে ইসলামের অনুভূতি হাঁটাহাঁটি শুরু করে। পশ্চিমবঙ্গ ইলেকশানের গোলপোস্টে মোদির গোল্ডেন গোলের বলটা; মামুনুল-স্বাধীন-সঞ্জিত যৌথভাবে বানিয়ে দেয়া সম্পন্ন করলে; তখন হেফাজতের আত্মীয়কে বিয়ে করে জয়শ্রীরাম বললেই বা কী; অথবা শিবসেনার আত্মার সঙ্গে লাভ জিহাদ করলেই বা অসুবিধা কী! ভোটে জিততে একটা টানটান উত্তেজনার থিয়েটার চাই; সেটা স্প্যানিশ ট্র্যাজেডি হোক; তাতে রক্তপাত-ভাংচুর হোক; তাতে কী; প্রাণ তো যাবে উলুখাগড়ার! গেরুয়া পতাকার বিজয় নিশান ওড়াতে মোদির অশ্বমেধযজ্ঞ বেগবান হোক। জয় হো মোদি।
– মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক
প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া