৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে সাফল্যগাথা ঠোঁট সেবায় প্রতিদিন আলোচিত; পরিসংখ্যানের পরীটি যেভাবে সংখ্যার গর্ব ঠোঁটে নিয়ে উড়ে বেড়ায়; সেই ‘মুখ ঢেকে যায় উন্নয়নের বিজ্ঞাপন”-এ। আর ‘মানুষ ও মানবতা’ ভূলুন্ঠিত হওয়া; সরকার সমালোচনার কারণে রাষ্ট্রদ্রোহীর তকমা দিয়ে নাগরিককে কারাগারে ছুঁড়ে ফেলা কিংবা প্রতিবাদী জনতাকে তার পয়সায় কেনা অস্ত্রে গুলি ছুঁড়ে; অনুতাপহীন রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় নাগরিকের চোখ কাঁটাচামচ দিয়ে খাওয়া, কান কামড়ে কুড়মুড় করে খাওয়া নরভোজি যে রাজন্যের বাংলাদেশ; এই দুই বাংলাদেশের দূরত্ব কয়েক আলোকবর্ষ।
ভাবতে অবাক লাগে; এতো নিষ্ঠুর বাংলাদেশ কোন সে ত্যাগের-রক্তের-শ্রমের-ঘামের বাংলাদেশ! গরীবী সরিয়ে ফেলার পরিসংখ্যান ঠোঁটে নিয়ে যে ঈগল আনন্দে উড়ে বেড়ায়; সে ঈগল কী অনায়াসে গরীবের বুকের অলিন্দ ছিঁড়ে খেয়ে তারপর ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে” আছের আত্মতুষ্টিতে বাতাবি লেবুর সুঘ্রাণ ছড়িয়ে দেয় ‘সাহেব-বিবি-গোলাম’-এর বাক্সে।
পাকিস্তান উপনিবেশে হৃদয়হীন লুন্ঠক জমিদার আর তাদের সামন্ত প্রথার চৌকিদার “জামিনদার’স মেনেরা” ঠিক যেভাবে পূর্বপাকিস্তানের কৃষক-শ্রমিকের পয়সায় মৌজ-মাস্তি করতো; প্রতিবাদ হলে কৃষকের-শ্রমিকের উপার্জিত অর্থে কেনা বুলেটে ঝাঁঝরা করে দিতো তাদের বুক; সেই একই পিশাচ-কাহিনীর দেজাভুঁ যেন আজকের বাংলাদেশ।
অনুতাপহীন রাজভোঁদড়েরা কারাগারে নির্যাতিত লেখকের মৃত্যুর পরে কিংবা গুজরাট-কাশ্মীর গণহত্যার মানবতাবিরোধী অপরাধী নরেন্দ্র মোদির সফরের প্রতিবাদে মুখর মাদ্রাসার ছাত্রের বুকে গুলি চালিয়ে; এরপর ফেসবুকে এসে নরভোজিতার হাউ মাউ খাউ জুড়ে দিয়ে “আগেই এইগুলিরে সাইজ করা উচিত ছিলো” বলে নিও-এলিট জীবনকে উদযাপন করে এই “আমরা বনাম ওরা”র মাঝে।
বিস্ময় লাগে মাত্র দশবছর আগে কুঁড়ে ঘরে বসে পান্তা খাওয়া লোক; সরকারের কোলধরা হয়ে ভাগ্যবদলে প্রাসাদ তুলে পাস্তা খায়; আর দশবছর আগের স্বগোত্রের দরিদ্রদের চামড়া দিয়ে উন্নয়ন ঢোল বানিয়ে বাজায়। এতো সম্পদের বর্ণ বৈষম্যের জনপদ পৃথিবীর আর কোথাও কী আছে!
যার বাপে নামাজ পড়ে কপালে ঘাঁটি ফেলেছে অথবা পূজা করে কপালে তিলক এঁকেছে; তার উত্তর প্রজন্ম মাত্র দশবছরের উন্নয়নের সুফল কুড়িয়ে এখন জিনস-টিশার্ট পরে গ্লোরিয়া জিনসে বসে কফি খায়; আর সেকুলারিজমের পাঠ দেয়; নও সেক্যুলার হলে যা হয় আর কী! ক্ষিদেয় যার ঠোঁটে চটা পড়ে থাকতো; এখন ‘স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির” মহাদ্রাক্ষারিস্ট খেয়ে সে ওয়েস্টিনের পাঁচ তারকা সুইমিংপুলে সাঁতরে কাতলা মাছের মতো মুখটা হা করে রাখে।
আত্মবিশ্বাসহীন নব্য সেক্যুলার মোদির কট্টরপন্থীদের কাছ থেকে শিখেছে; হিন্দু ধর্মের আচার আচরণই সেকুলারিজম। পূজা করা, ভাইফোটা দেয়া, রাখী বাঁধা, হোলি খেলা, পূজা পর্বের গান পিঁ পিঁ করে গাইলেই ওটি বেশ সেকুলারিজম। গুজরাটের খুনি মোদি পৃথিবীর যেখানে যায় কিংবা যাবে; বিশ্বমানবতা প্রতিবাদ জানাবে। অথচ ভারতের ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকা শিরোনাম করেছে ‘মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীতে বিক্ষোভ বাংলাদেশে, পাক-পন্থীদের তাণ্ডব, নিহত ৪”। পূজার ঘরে বসে পাছার ছাল তুলে ফেলা আনন্দ- খঞ্জনি সেক্যুলারিজম-এর স্বপ্রণোদিত ম্যানেজার হয়েছে; ওর মতো পূজার গণেশের ঠোঁটে চুমু না দিয়ে জায়নামাজে বা তসবিতে চুমু দিলেই সে কথিত ‘পাকপন্থী’। স্যাঁতসেতে সাম্প্রদায়িক আনন্দবাজারের মতো এই ক্ষ্যাত মানসিকতাই আজকের নিও-এলিট ঢাকা সমাজের একটি অংশের আধুনিকতার অংশ।
আত্মবিশ্বাসহীন নও-মুসলিমের দল; শুধুই কদমবুচি করার পা খোঁজে; আনন্দবাজারের মুদি দোকানিদের পা জাপটে ধরে বসে থাকে একটি ‘আনন্দ পুরস্কারের জন্য’। এই নানাবিধ পদ-পদক-প্লটের লোভটাই খেলো এই ভাটিয়ালি জনপদের নাগরিক সমাজকে। রুই-কাতলা-ইলিশে পদকের জন্য নানান মোকামে অদৃশ্য সাবানে হাত চুলকায় এরা। তাই তো ভারত ও পাকিস্তানের সাতদশকের “দুই সারমেয়র ঘেউ ঘেউ”-এর একটি না একটি বলয় চুলকে ঢাকায় বসে শাক দিয়ে মাছ ঢাকা শিখেছে কিছু লোক। ভারত ও পাকিস্তান স্বদেশে সুশাসন ও কল্যাণ রাষ্ট্র উপহার দিতে ব্যর্থ হয়ে “পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষের শাক দিয়ে ব্যর্থ রাষ্ট্র নামের মাছটিকে ঢাকে”। সেই এট্রিবিউশান বা আরোপ যখন আনন্দবাজার করে, মোদির গেরুয়া পতাকা পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে ওড়ানোর অভিলক্ষ্যে; বাংলাদেশ সমাজের নও-সেক্যুলার ভ্রাতাঃ বা ভগ্নিটি তখন এসে বাংলাদেশকে ‘অসাম্প্রদায়িকতা’-র নসিহত দেয়। কপালে ধ্যাবড়া করে সিঁদুর দিয়ে কিংবা হিন্দুত্ববাদের লাল তিলক এঁকে উপদেশ দেয়, বাংলাদেশে হিজাব বাড়তেছে! “ফইন্নির ঘরের এইসব ফইন্নি সেক্যুলারিজম” শেখার জন্য বাংলাদেশের মানুষের জন্ম হয়নি। লালন-হাসনরাজা-শাহ আবদুল করিমের অসাম্প্রদায়িক দর্শনের আলোয় স্নাত বাংলাদেশ। এই দেশ গানের দেশ; কবিতার দেশ।
কোনো দেশে দারিদ্র্য থাকলে সেখানে ধর্মীয় মৌলবাদ বা উগ্রবাদ জ্যামিতিক হারে বাড়ে। ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ তিনটি দেশেই আবহমান কাল ধরে ‘কেল্লার ভেতরের জীবন” আর “কেল্লার বাইরের জীবন” এই দুইভাগে বিভাজিত সমাজ। কেল্লার ভেতরের লোকেরা নিজেদের ছেলেমেয়েদের উন্নত জীবন দেয়; আর কেল্লার বাইরের দারিদ্র্যে বিশীর্ণ জীবনের শিশুদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। সৌদি আরবের কেল্লার মধ্যের রাজবংশ যেমন দরিদ্র শিশুকে উটের জকি বানিয়ে তার ভীতি-আর্তনাদ বা মৃত্যুর কৌতুকে বিনোদিত হয়; দক্ষিণ এশিয়াতেও ঠিক তাই হয়। পাকিস্তানের ইসলামভূক নেতারা নিজেদের ছেলে মেয়েদের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করেছে; আর কেল্লার বাইরের অনাথদের জন্য তৈরি করেছে মাদ্রাসা; কল্পিত খিলাফতের ধর্মের সৈনিক তৈরির ব্যারাক। ভারতের হিন্দুত্বভূক নেতারা নিজেদের ছেলে মেয়েদের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করে আর কেল্লার বাইরের অনাথ শিশুদের হাফপ্যান্ট পরিয়ে ‘নাতসি’ কায়দায় তৈরি করে গেরুয়া পতাকার সৈনিক হিসেবে। এই নরভোজিতাই দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি।
বাংলাদেশ এই কেল্লার রাজনীতির ইউনিক উদাহরণ। এইখানে নব্য ধনী নেতারা নিজেদের ছেলেমেয়ে লুন্ঠনের টাকায় পশ্চিমে সেকেন্ড হোমে রাখে; বিদেশে পড়ায়; তারা ফিরে এসে নওফেল ও হাতেম হয়। বাপের রাজনীতির জমিদারী আগলে ধরে রাতের ভোটে আর নির্বাচন কমিশনের ঠোঁটে। অন্যদিকে কেল্লার বাইরের শিশুরা হাটহাজারির মাদ্রাসায় খিলাফতের ফুটসোলজারের প্রশিক্ষণ নেয়। দেশ ফেইক সবুজ মদিনা সনদে চললে তারা ডুকরে কেঁদে শোকরানা মেহেফিল করে। কেল্লার বাইরের শিশুদের আরেকটি দল দেশ ফেইক গেরুয়া মোদি সনদে চলছে এই আনন্দে ‘মোদির বিরুদ্ধে কথা বললে, জিভ টেনে ছিঁড়ে নিতে চায়। বাংলাদেশে কেল্লার বাইরে এই দুইরকমের উগ্রশিশুপালনের সংস্কৃতিকেই ইনক্লুসিভ ‘অসাম্প্রদায়িকতা’-র বাতাবি লেবুর সুগন্ধ বলে প্রচার করে ‘হিজ মাস্টার্স’ ভয়েসে। এইভাবে নানারকম ক্রোকোডাইল’স মেন-এ থকথক করতে থাকে বিপজ্জনক বাংলাদেশ।
রাজনীতির ব্যবসা করে নতুন জমিদার হয়ে ওঠা পরিসংখ্যানের কেল্লার কুমির মানব ও মানবীরা; ডিভাইড এন্ড রুলের আরো একটি মুনতাসির ফ্যান্টাসি তৈরি করে, স্বাধীনতার পক্ষের ও বিপক্ষের শক্তি বলে। সরকারের ভাঁড় হলে সে স্বাধীনতার স্বপক্ষের সেকুলার ফার্মার্স ব্যাংক; আর সরকারের ভাঁড় না হলেই সে স্বাধীনতার বিপক্ষের সাম্প্রদায়িক ন্যাশনাল ব্যাংক অফ পাকিস্তান। এরকম একটা ভাঁওতাবাজির বিভাজন রেখায় বাংলাদেশ আছে মনুষ্য-পশ্চাদ্দেশটির মতোই বিভাজিত হয়ে। সেই পশ্চাদদেশ ঢাকতে কেউ “ভক্তির বিনিময়ে জেনিটাল পার্ক” ব্র্যান্ডের অন্তর্বাস পরে ন্যায়সঙ্গত প্রতিবাদকে প্রহার করে। কেউ বা “ভক্তির বিনিময়ে খাসজমি” ব্র্যান্ডের সালোয়ার পরে শারিয়াহ আইনের স্বপ্নে কুঁদে বেড়ায়। উভয় শিবসেনা ও শিবিরকের মাথায় হাত বুলিয়ে বীণ বাজিয়ে “নাগিন নৃত্য পরিবেশন” করতে থাকে একদলীয় থাগস অফ বেঙ্গল।
বাংলাদেশ মুক্তির আন্দোলনে যুদ্ধে যারা প্রাণপাত করেছেন; তারা ভারত-পাকিস্তানের এই কেল্লাভিত্তিক জেল্লা-র জীবন প্রত্যাখ্যান করে বৈষম্যমুক্ত কল্যাণরাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিলেন। যেখানে কেল্লার ভেতর আর বাইরের শিশুর জীবন একই রকম সম্ভাবনার আলোয় দীপিত হবে। ত্রিকালদর্শী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ‘চোরের খনির’ ‘চাটার দলের দৌরাত্মে’ অসহায় বোধ করেছিলেন; তাঁর স্বপ্নকে হত্যা করেছিলো এরা। এখন সেই চোরের খনির চাটার দল বঙ্গবন্ধুর ছবি-ম্যুরাল-ভাস্কর্য চেটে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে। যে লুন্ঠন করতে বৃটিশ বা পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক ভোঁদড়েরাও এই বিপুল টাকার অংকে পেরে ওঠেনি।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট ভোরে; কেল্লার জেল্লার জন্য মরিয়া ডালিম-আপেলেরা গর্বভরে ‘বঙ্গবন্ধু’-কে হত্যার ঘোষণা দিলে; এই চোরের খনির চাটার দল; দ্রুত নতুন পাওয়ার প্ল্যান্টের রাজভোঁদড় হবার দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। রাজা যায় রাজা আসে; কিন্তু রাজাকার থেকে যায় চাটাচাটির নিত্যতাসূত্র জিভে নিয়ে।
গুজরাটের খুনি নরেন্দ্র দামোদর মোদি বা বাগদাদের খুনি জর্জ ওয়াকার বুশ পৃথিবীর যেখানে যায়; বিশ্বমানবতা তার বিরুদ্ধে উন্মত্ত প্রতিবাদ করে। অথচ বাংলাদেশ যেন পৃথিবী গ্রহের বাইরে। এক প্রজন্মের নও সেক্যুলার এসে বলে, আমি তো বুঝতে পারিনা; একটা এতো সাম্প্রদায়িক দেশের লোক কোন মুখে পাশের দেশের সাম্প্রদায়িক নেতার সমালোচনা করে।
ক্ষীণ অথচ চিকন বুদ্ধির এই সাম্প্রদায়িক-সেক্যুলার মদিরারা এটা বোঝে না; বাংলাদেশে ইসলামপন্থী দল; দুটি প্রধান দলের লেজ হয়ে ক্ষমতার ছিটে ফোটা চেটে খায়। কিন্তু ভারতের মতো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের খুনে নেতাকে ভোট দিয়ে গেরুয়া পতাকা উড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী বানাতে পারে না। বাংলাদেশের জনমানুষ সেরকম অনুমোদন দেয় না।
একটা দেশের সংখ্যায় কম অন্যধর্মের মানুষ নিজের দেশে বসে তারধর্মী অন্য রাষ্ট্রের উগ্রবাদকে সমর্থন করতে পারে; বাংলাদেশে বসে মোদির পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনী প্রচারণার সারিন্দা বাজাতে পারে; কিন্তু তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব সংখ্যায় বেশি ধর্মাবলম্বীদের কাঁধে বর্তায়। একটি দেশের ‘সংখ্যালঘু’-র নাগরিক অধিকার সমুন্নত রাখার সূচকটি সভ্যতার অন্যতম প্রধান সূচক। বাংলাদেশের হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান-আদিবাসী-অবিশ্বাসীদের শান্তিপূর্ণ জীবনের দায় বাংলাদেশের মুসলমানদের।
কেল্লার ভেতরের পাপেট মাস্টারদের “পুতুল খেলায়” কতো প্রাণ গেলো; কতো উলু-খাগড়ার মৃতদেহ পড়ে রইলো পুলিশের বুটের তলে; এলিটফোর্সের বেয়োনেটের খোঁচায়; ক্ষমতার বুলেটের নিষ্ঠুরতায়। এইভাবে বাংলাদেশ থেকে বাংলাদেশের দূরত্ব বাড়তে থাকায় মানবতা ও বাকস্বাধীনতাহীনতায়; উন্নয়নের বেহুদা ঢোল শুনে বলির বাদ্য বলে মনে হয়। পরিসংখ্যানের ‘পরী’ রাষ্ট্রের ক্ষমতা শিকারে জনমানুষের বিদেহী আত্মা হয়ে উড়ে গেলে; পড়ে থাকে শত শত-হাজার হাজার মৃতের সংখ্যা।
– মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক
প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া