করোনা মহামারীতে বাংলাদেশসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জনজীবন বিপর্যস্ত। কভিড ১৯-এর প্রথম বছরের হামলাটি প্রকট চেহারায় দেখা গিয়েছিলো পশ্চিমা বিশ্বে। বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো আক্রান্ত হয়েছিলো অপেক্ষাকৃত কম। কিন্তু করোনা মহামারীর দ্বিতীয় বছরের চিত্রটি একটু ভিন্ন। করোনার বিশ্বায়ন সম্পন্ন হয়েছে। যাপিত জীবনে মানুষের অসহায়ত্ব গোটা বিশ্বে এখন একইরকম। করোনাসাম্যের এই বিশ্বে আর কেউই নিরাপদ নয়। এই যে আমি আজ করোনা সম্পর্কে লিখছি; আগামীকাল আমার আঙ্গুল আর কীবোর্ডে অক্ষর ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম নাও হতে পারে।
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বলতে ঠিক যা বোঝায়; যেটি চিরন্তন জীবন বাস্তবতা; সেটাকে করোনা যেন আরো স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিচ্ছে। ১৯১৮-র স্প্যানীশ ফ্লু কয়েক বছর স্থায়ী হয়েছিলো। নাম ছিলো স্প্যানিশ ফ্লু; কিন্তু এই মহামারী কেবল ইউরোপেই আটকে ছিলো না; লেখক ও দার্শনিক জা পল সার্তের বাবা দক্ষিণ এশিয়ায় কর্মরত অবস্থায় মারা গিয়েছিলেন স্প্যানিশ ফ্লুতে। সেই মহামারীর বিপন্নতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ইউরোপ তার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সংস্কার করেছিলো। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়া যেহেতু অভিজ্ঞতা থেকে শেখার জনপদ নয়; তাই নিতান্ত অপ্রস্তুত রয়ে গেছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায়। ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপন্ন ও অসহায় তিনজন মানুষ।
পশ্চিমা বিশ্বের এতো ভালো দেশ ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা যে করোনার আঘাত সামলাতে নাকানি চোবানি খেয়েছে; সেখানে আমরা কোথায় আছি; একটু কল্পনা করুন। পশ্চিমা বিশ্ব কল্যাণ রাষ্ট্র-ধনী দেশ; ফলে দীর্ঘায়িত মহামারীতে দেশের প্রতিটি মানুষকে অন্তত প্রতিদিন তিনবেলা আহার জোগান দিতে সক্ষম।
কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান যেহেতু কতিপয়তন্ত্রের দেশ; এখানে করোনায় আক্রান্ত যত মানুষ; তার চেয়ে বেশি মানুষ অনাহারে আক্রান্ত। পশ্চিমা বিশ্ব লকডাউন করে বসে থেকে করোনার সঙ্গে সাপলুডু খেলতে পারছে ও পারবে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়া রোজ এনে রোজ খাওয়া মানুষের দেশ। এখানে সরকারগুলো তার সদিচ্ছা থেকে প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়ে অনাহারীকে ক্ষুধা-মন্দা থেকে বাঁচাতে চেষ্টা করলেও; সরকারগুলোর যে চাটার দল আছে; তারা এই সরকারি ত্রাণ বিতরণের উদ্যোগ ভেস্তে দিয়েছে-দিচ্ছে-দেবেই। এরা এরকমই নরভোজি; অনুতাপহীন রাক্ষস। দক্ষিণ এশিয়া চোরের খনি; সরকারি অর্থ লুন্ঠন করে চর্বি জমিয়ে; সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই নরভোজির দল এসে “হাউ মাউ খাউ; মানুষের গন্ধ পাউ” বলে প্রতিদিনই জনমানুষের চোখ-কান-নাক-হাত-পা এমনকী হৃদপিন্ড চিবিয়ে খায়।
যেহেতু এই চোরের খনির বিদূষক ও সহমত ভাইয়ের কোন কাজ করতে হয় না; সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব এদের মাঝে সহানুভূতির আলোড়ন তোলে না; তাই তাদের কাজ একই; ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তী বা নিজেদের চুরিদারি-ডাকাতির চিরস্থায়ী বন্দোবস্তীর চিরায়ত জব্বার-গব্বর-মাতব্বরের বলি খেলা চালিয়ে যাওয়া। ওকে তো খাওয়ার চিন্তা করতে হয় না; ক্ষমতাসীন পার্টি করে চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয়তে আনস্মার্ট ভুঁড়ি বাগিয়ে বসে থাকে স্মার্ট ফোন নিয়ে। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের অনাহারের কান্নার শব্দ যাতে দেশের রাজা-রাণীর কেল্লা পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারে; সেই উদ্দেশ্যে পোষ্য মিডিয়ার লাল বাতাবি মাণ্ডিতে আর সোশ্যাল মিডিয়ার সহমতযন্ত্র-তালিবানযন্ত্র-চাড্ডিবান গ্যাং-এর কলতলা হৈ চৈ তৈরি করে তারা প্রতিদিনই; নানা তুচ্ছাতি তুচ্ছ বিষয়ে। এইসব মর্কটের ফেসবুক টাইম লাইন ঘুরলে মনে হবে, কোথাও কোন করোনা নেই- কান্না নেই; আছে শুরু রগড়-লালসার লোল চর্ম উন্নয়নের মুজরা। যৌন কর্মীকে তবু বিশ্বাস করা যায়; কিন্তু এসব সহমত কর্মীর শিরায় শিরায় পাপ।
বাংলাদেশের করোনা অসহায়ত্বের জন্য স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষ রাষ্ট্র-ব্যবস্থাপনার শীর্ষ মানুষকে দুষবেন। ভারত-পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও সেটাই বাস্তবতা। কিন্তু লক্ষ্য করুন; প্রতিটি মানুষকে ক্ষুধার অন্ন জোগাতে সরকার প্রধান প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ ও ছাড় করেছেন। কিন্তু এই অর্থ পৌঁছাতে পারে না সে অনাহারী কুটিরে; যেখানে মা চুলার হাঁড়িতে পাথর চড়িয়ে তার সন্তানদের কান্না থামায়। সেইখানে সরকারের সাহায্য পৌঁছাতে দেয় না ঐ নরভোজিগুলো; যারা ফেসবুকে হৈ চৈ তৈরি করে হারাম-হালাল বিবাহ নিয়ে; দেশচেতনার ডুকরে ওঠা কুমির অশ্রুর মাতম দিয়ে; বুক থাবড়ে হায় স্বাধীনতার চেতনা; ও শত্রু স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি-সাধু সাবধান ইত্যাদি লালবাতি এলাকার দালালের শীৎকার দিয়ে। স্বাধীনতার বিপক্ষের কাফের মারার ছলে এই দেশমোল্লাদের মুনতাসির ফ্যান্টাসি জীবন বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে স্থূল নীল ছবির বানোয়াট এক রগরগে বিকৃতি ছাড়া কিছুই না।
এইসব দালাল-রাজভোঁদড়ের শৈশব কেটেছে অনাহারে; পুষ্টির অভাবে মস্তিষ্ক বিকশিত হয়নি; ফলে নৈতিকতার বোধ তৈরি হয়নি সেই পুষ্টিহীন খুলিতে। ফলে সে কিন্তু যে ক্ষমতার লালবাতি এলাকার পিম্পহুড বেছে নিয়েছে; একে কোন অন্যায় বলে ভাবছে না। গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস অনেক আগেই বুঝেছিলেন, অপরাধী যখন অন্যায় করে; সে কিন্তু এটাকে ন্যায় বা সঠিক ভেবেই করে।
এইসব ক্ষমতামাণ্ডি বা বেনিয়াশান্তার ঋণখেলাপি ও ডাকাতেরাও কিন্তু একেকজন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মরছে; কিন্তু রাষ্ট্রের কাছে নেয়া তাদের হাজার কোটি টাকার ঋণ অপরিশোধিত রয়ে যাচ্ছে। এখন কবরের কাছে গিয়ে তো রাষ্ট্র ঋণের টাকা ফেরত চাইতে পারে না। এই যে দক্ষিণ এশিয়ার যে লোকগুলো বড় রাষ্ট্রীয় ও বিজনেস মিটিং-এর ছবি দেয় ফেসবুকে; এই যে তাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-পরিজন; সেজেগুজে সেলফি দেয়; এইগুলি হচ্ছে বিশ্বফকির। এদের একেকজনের যে ঋণ রয়েছে রাষ্ট্রের নানা ব্যাংকে; তা শোধ দিতে হলে; আগামীকালই তাদের বায়তুল মোকাররমের সামনে ভিক্ষার থালা হাতে বসে যেতে হবে।
রাজভোঁদড়গুলো এই যে পিঠা-পুলি-পাস্তা খাচ্ছে ফেসবুকে ছবি দিয়ে; রাষ্ট্র তাদের কাছে ঋণের টাকা ফেরত নিলে কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশন এইসব রাজকীয় ছবি খুঁজে খুঁজে ‘চোরের খনি’-র প্রাসাদগুলোতে হানা দিলে; এরা কিন্তু পাহাড় থেকে আবার ইঁদুরে রূপান্তরিত হবে; ফিরে যেতে হবে যেভাবে জন্ম নিয়েছিলো সেই ইঁদুর জীবনে। পাস্তা নয়; পান্তা খেতে হবে অর্থনীতির লজিং মাস্টারদের; যারা আজকে জিডিপির জ্ঞান দেয়; বৈদেশিক রিজার্ভের গালগল্পের পদ্ম ফোটায়।
করোনা ভাইরাসের চেয়ে বড় শত্রু এই ক্ষমতামাণ্ডি, অনুভূতিবাজার, বেনিয়াশান্তার দালালগুলো। এদেরকে প্রতিহত করতে হবে। এদেরকে হিড় হিড় করে নামিয়ে আনতে হবে ওদের জন্মাবস্থার বস্তিতে। দেশের প্রতিটি নাগরিককে আওয়াজ তুলতে হবে এইসব লুন্ঠকের বিরুদ্ধে। পুলিশ-প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে হবে ‘চোরের খনি’-কে শত্রুমুক্ত করতে। প্রজাতন্ত্রের সেবকদের পূর্ণ সহযোগিতা করতে হবে দেশের শৃংখলা রক্ষায়। করোনা যখন আসল ক্ষমতায়; তখন ছদ্ম ক্ষমতার হীরক রাজার দড়ি ধরে টান মেরে লাভ নেই। জীবন্মৃত রাজা-রানী-যারা প্রায় জীবন সায়াহ্নে-করোনার ছোবলে যে কোন মুহূর্তে তাদের জীবন প্রদীপ নিভে যাবে। তাই পুরো মনোযোগ দিতে হবে সহমতযন্ত্রগুলোর দিকে; যারা দেশপ্রেম-ধর্ম-সামাজিক পুলিশির দোকান খুলে মাংসের কারবার চালিয়ে যাচ্ছে; সেই অনুতাপহীন কসাইগুলোর গলায় পা দিয়ে বলতে হবে; মহামারীর সময় তোর চেহারাও দেখতে চাইনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ফেসবুক থেকে মহামারীর সময় চর্বিপ্রসূত রগড় সমাজটির ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশনকে জানান। কোত্থেকে এতো চর্বি এলো তার তদন্ত হবে।
আর বিপুল জনসংখ্যার দেশে করোনা ভাইরাস থেকে আত্মরক্ষার একমাত্র পথ শৃংখলা; ডাক্তারের নির্দেশনা মেনে চলা। সৃষ্টিকর্তার পরে এই ডাক্তারই এখন মানুষের প্রিয় বন্ধু। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাত দিন কাজ করছে। মনভাঙ্গা গানে তাদের মনোযোগ বিচ্যুতি যেন আমরা না ঘটাই। করোনা-ভাইরাসের চোখে কোন ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-রাজনৈতিক আদর্শ-ধনী-দরিদ্রের বিভাজন নেই। কভিড নাইন্টিন এক জন্মান্ধ কালাশনিকভের ব্রাশ ফায়ারের মতো। সুতরাং নিজেকে বাঁচাতে মাস্ক পরতে হবে; হাত ধুতে হবে বার বার; গাদাগাদি করে চলাফেরা-হাসাহাসি-নাচানাচি-ঘোরাঘুরির ছুটি এখন। এটাই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাল। কেবল সচেনতাই পারে আমার-আপনার আগামীকালের সূর্যোদয় দেখার সম্ভাবনা জিইয়ে রাখতে।