বাংলাদেশকে পানি বঞ্চিত রাখার মমতা নীতি আমি সমর্থন করি না। তবে মমতা কেন পানি দিতে পারছেন না বাংলাদেশকে কিংবা কেন বিরোধিতা করছে? কারণটি এদেশের আওয়ামীলীগ, মোদীপন্থী বুদ্ধিজীবিরা কখনও আপনাকে জানাবে না। আসুন দেখে নেই বিস্তারিত।
১। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের, মমতার নয় কিংবা পশ্চিম বঙ্গের রাজ্য সরকারের নয়। আন্তঃ নদী সংযোগ প্রকল্পের হিমালায়ন কম্পোনেট এর মানস-শঙ্কোশ-তিস্তা-গঙ্গা সংযোগ প্রকল্পের অংশ হিসেবে এরই মধ্যে তিস্তার উল্লেখযোগ্য পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। পাশাপাশি যমুনা নদীর শাখা নদী মানস ও শঙ্কোশের পানি সরিয়ে নেয়ার মহাপরিকল্পনা করা হয়েছে।
অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের জন্য প্রয়োজনীয় পানি টূকু রেখে বাকিটা হাইজ্যাক করা হচ্ছে। ফলে গজল্ডোবায় তিস্তা পয়েন্টে আসলে পানি নেই উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। স্বাবাবিক সময়ে সম্ভবত ৮ থেকে ১২ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহিত হয় (এবার বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় তা আরো কমেছে), বাকি পানি ডাইভার্ট করে ভারতের অন্য অঞ্চলে প্রবাহিত হচ্ছে। এখান মমতা এই ১২ হাজার থেকে বাংলাদেশকে অন্তত ৩, ৪ বা ৫ হাজার কিউসেক পানি দিতে রাজি হচ্ছে না।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে নেগোশিয়েট করে, ডিল করে ভারত রাষ্ট্রকে। রাজ্য পশ্চিম বঙ্গকে নয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে ২০১৫ সালের বাংলাদেশ সফরকালে তিস্তার জলবণ্টনকে ‘সিনসিয়ার কমিটমেন্ট’ বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সুতরাং পানি প্রত্যাহারের বিষয়ে মোদি, ভারতের পানি ও পররাষ্ট্র মন্ত্রক, যৌথ নদী কমিশনকে চ্যালেঞ্জ না করে, মমতার উপর একমুখী রাজনৈতিক চাপ তৈরি ক্ষমতায় থাকার প্রশ্নে আওয়ামীলীগের দাসসুলভ মানূষিকতা। পাছে অবৈধ ক্ষমতার সমর্থনে ভাটা পড়ে! আর বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিরা? তারা হয় নির্লজ্জ বেহায়া, অন্ধ ভারতপন্থী সেবক, না হয় স্রেফ নির্বোধ।
২। তিস্তা তো গেল। শুষ্ক মৌসুমে দেশের স্বাদু পানির অন্তত ৬০ ভাগের উৎস যে যমুনা- ব্রহ্মপুত্র, তার কি অবস্থা জানবেন? স্বয়ং বাংলাদেশই যমুনা নদী হত্যার প্রস্তাবে সম্মত হয়ে বসে আছে যে! বিদ্যুৎ আমদানির নামে নিজেরাই নাকি প্রস্তাব দিয়ে বসে আছে। দেখুন বিস্তারিত-
বাংলাদেশে নন-নিউক্লিয়ার নবায়নযোগ্য বা সবুজ বিদ্যুতের কথা উঠলেই দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে বরং ভারত থেকে ‘চিপ অ্যান্ড ক্লিন’ জলবিদ্যুৎ আমদানির পরামর্শ নিয়ে আসে, ভারতের কিছু লবিস্ট গ্রুপ, কিছু ভারত পন্থী রাজনিতিবিদ, খোদ বুয়েটের মহান শিক্ষক, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জ্বলানি উপদেষ্টা, কিছু মাফিয়া জ্বালানি সাংবাদিক- এই বলয়।
****************
বস্তুত ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের হিমালয়ান কম্পোনেন্ট অর্থাৎ অরুণাচলে পরিকল্পিত ১৫৪টি জলবিদ্যুৎ বাঁধের পরিকল্পনানির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন এই অঞ্চলে বহুপক্ষীয় ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি তৈরি করবে। এর মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্রে ইয়ারলাং সাংপো জলবিদ্যুতের মতো অতি বৃহৎ প্রকল্পগুলোর বৈধতা খুঁজবে চীন। ব্রহ্মপুত্রের বিপুল পানিসম্পদ ব্যবহার করে তিব্বতের বিদ্যুৎ ঘাটতি কমাতে চারটি বৃহৎ বাঁধ আগেই পরিকল্পিত হয়ে আছে। বাংলাদেশে যমুনা-ব্রহ্মপুত্রে বহমান পানির বড় অংশ আসে অরুণাচল ও আসামে বিপুল মৌসুমি বৃষ্টি থেকে। তাই ভারতের বাঁধে শুধু মৌসুমি পানিপ্রবাহকেন্দ্রিক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থাকবে না, বরং এতে বৃহৎ জলাধার ভরাট ও আন্তঃসংযোগের বিষয়ও জড়িত থাকবে। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মৌলিক ও বৃহৎ লক্ষ্য হচ্ছে, ‘ওয়াটার সারপ্লাস’ অঞ্চল থেকে ‘ওয়াটার স্কার্সিটি’ অঞ্চলের দিকে পানীয় জল ও সেচের পানি প্রবাহিত করা।
আন্তর্জাতিক সংস্থা সিএনএ কর্তৃক সম্পাদিত ‘ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার পানিসম্পদ প্রতিযোগিতা: চীন, ভারত ও বাংলাদেশ’-২০১৬ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে (পৃ-৩৩) বলা হয়েছে, ‘ভারতে পানি প্রত্যাহারে বাংলাদেশ যে বোধগম্য হুমকির মুখোমুখি হয়েছে, তা তিব্বতে চীনের বাঁধ নির্মাণ সম্পর্কে ভারতের উদ্বেগের কাউন্টার প্রতিপাদ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন চীনা বিশ্লেষণে ভারতের জল প্রত্যাহার পরিকল্পনাকে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে হাইলাইট করে বলা হয়েছে, এটি ভাটির প্রতিবেশীর ওপর মারাত্মক অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত প্রভাব ফেলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, বেইজিংয়ে সিএনএ’কে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে চীনের এক বিশেষজ্ঞ যুক্তি দিয়েছিলেন, সম্ভাব্য ভারতীয় ডাইভার্সন পরিকল্পনাগুলো বাংলাদেশের স্বার্থের ক্ষতি করতে পারে এবং প্রবাহিত নদীর ভাটির অঞ্চলে হুমকি থাকায় বাংলাদেশের কিছু বলার অধিকার রয়েছে। মোদ্দাকথা হচ্ছে, ভারত চীনের উজানের উন্নয়নের উদ্যোগের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে দ্বৈত-নীতি প্রয়োগ করছে।’
ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় ভারতের সীমানা মার্জিনাল (জনসংখ্যার তিন শতাংশ, ভূমির ছয় শতাংশ)। অপেক্ষাকৃত কম জনবহুল এই অঞ্চল চীনের ভূমির তিন শতাংশ। ব্রহ্মপুত্র বেসিন বাংলাদেশের ভূমির ২৭ শতাংশ। এখানে জনসংখ্যার ৭০ শতাংশের বসবাস। সিএনএ গবেষণামতে, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় বর্তমানে বাংলাদেশের সেচ চাহিদার অন্তত ২৫ শতাংশ পানি ঘাটতি রয়েছে। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার প্রস্থের যমুনা চলমান শুষ্ক মৌসুমে মাত্র ৭০০ মিটারে নেমে এসেছে। সব মিলিয়ে চীন ও ভারতের উপর্যুপরি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে ব্রহ্মপুত্র-যমুনায় চরম পানি সংকট দেখা দেবে, যা বাংলাদেশের গ্রীষ্মকালীন স্বাদুপানির প্রধান উৎস। এ অবস্থায় বাংলাদেশের অরুণাচলকেন্দ্রিক জলবিদ্যুৎ আমদানিতে অংশ নেয়া মোটেই সমীচীন নয়।
যেহেতু ভারতে কয়লা উৎপাদিত বিদ্যুতের উদ্বৃত্ত রয়েছে এবং ভারত বৈশ্বিক নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের লক্ষ্য অর্জনে সৌর ও বায়ুবিদ্যুতে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে, তাই অরুণাচলের অতি খরুচে জলবিদ্যুৎ আদতে ভারতের প্রয়োজন নেই, দরকার আসলে পানি প্রত্যাহারের। বাংলাদেশ যদি বিদ্যুৎ করিডোরের অনুমতি দেয়, তবে ব্রহ্মপুত্র (যমুনা) নদী ও এর শাখা নদীর ওপর পরিকল্পিত ১৫০+ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর হয়ে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পকে এগিয়ে নেবে। আশঙ্কা হয়, এই প্রক্রিয়া ভাটির ব্রহ্মপুত্র (যমুনা) নদীটিকে ধীরে ধীরে হত্যা করবে। তদুপরি এই বাঁধগুলোর অনেকগুলো জলাধার হিসেবে কাজ করবে এবং ভবিষ্যতে চ্যানেল দিয়ে পরস্পর সংযুক্ত করা হবে। উদাহরণস্বরূপ,
মানস-শঙ্কোশ-তিস্তা-গঙ্গা সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে এরই মধ্যে যমুনা নদীর শাখা নদী মানস ও শঙ্কোশের পানি সরিয়ে নেয়ার মহাপরিকল্পনা করা হয়েছে। (সূত্র: ইন্ডিয়া ওয়াটার পোর্টাল/ন্যাশনাল-রিভার-লিংকিং-প্রজেক্ট)। মোটকথা, নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের নামে বাংলাদেশকে কোনোভাবেই জলবিদ্যুৎ আমদানির ফাঁদে পড়া যাবে না।
‘হাইড্রো-ইলেকট্রিক পাওয়ার ইভাকুয়েশন মাস্টার প্ল্যান অব অরুণাচল (ইন্ডিয়া)’ (সূত্র: জেটিটি রিপোর্ট, ২০১৪) ছয়টি সাত হাজার ও একটি ছয় হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৮০০ কেভি হাই-ভোল্টেজ বাই-পোলার গ্রিড সঞ্চালন লাইনের জন্য বাংলাদেশের ভূমি দরকার। এতে প্রতীয়মান হয়, বাংলাদেশে জলবিদ্যুৎ রপ্তানির প্রস্তাব মূলত বিদ্যুৎ করিডোরের মূল লক্ষ্য (ড্রপ অ্যান্ড ক্যারি ওভার বাংলাদেশ)। যেখানে বাংলাদেশে সড়ক প্রশস্ত করার কিংবা সৌরবিদ্যুতের জমিস্বল্পতা বহুল আলোচিত বিষয়, সেখানে সাতটি হাই-ভোল্টেজ সঞ্চালন লাইনের ভূমি বরাদ্দ পুরোপুরি অসম্ভব। এরই মধ্যে বিপিডিপি-পিজিসিবি-পল্লী বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনের অধিগ্রহণকৃত জমির বিষয়ে শত শত মামলা রয়েছে। ফলে পানি প্রত্যাহার ও নদী হত্যা তো বটেই, জলবিদ্যুৎ ক্রয়ের সাথে রয়ে গেছে আরো বহু পরোক্ষ ক্ষতি।
*******
সুতরাং পানির জন্য শুধু এককভাবে মমতাকে গালি দেয়ার আগে, বৃহৎ পরিসরে ছবিটাকে দেখুন। বাংলাদেশের স্বাদুপানির ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত হবার কারণ আছে। হ্যাঁ, মমতা বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু হলে, কিংবা প্রাণ ও প্রকৃতি বান্ধব হলে, নদীটিকে হত্যা না করে নিজেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে নেগশিয়েশনে যেত। যে ওকে, আমি বাংলাদেশকে কিছু পানি দিচ্ছি কিন্তু তার জন্য আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প থেকে আরো বেশি পানি ছেড়ে গজলডোবায় আমাকে আরো বেশি পানি দিতে হবে, যাতে বাংলাদেশকে কিছু দেয়া যায়।
পানি ভাটির দেশের মানুষের বিশ্বস্বীকৃত আন্তর্জাতিক অধিকার। শুধুই ভাটি অঞ্চলের মানুষের নয়, বরং ‘বেঁচে’ থাকার জন্য নদীর নিজেরও রয়েছে প্রবাহ প্রাপ্তির অধিকার। নদী অববাহিকার উদ্ভিদ ও প্রাণিজগৎ, বনাঞ্চল সহ সব জীব বৈচিত্র টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজনীয় ন্যূনতম পানি প্রবাহ চালু রাখা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পন্থা (সূত্র, জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ কনভেনশন ১৯৯৭, ধারা ৫ ও ৭.১)।
যেখানে, বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবিরাই দেশের স্বার্থ্য জলাঞ্জলি দিয়ে ভারতের কাছে নিজেদের পশ্চাৎ দেশ উদোম করে দিয়েছে, সেখানে মমতার একক দোষ কিভাবে দেই?
যেখানে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তথা মোদিকে কাঠগড়ায় দাঁড়া করিয়ে মূল যুক্তি, তথ্য বক্তব্য এবং দাবী উপস্থাপনা করা দরকার, সেখানে নদী খুনীকে বাদ দিয়ে নদী হত্যার দর্শককে অভিযুক্ত করার পালে হওয়া দিচ্ছে বাংলাদেশের স্বার্থ্য জলাঞ্জলি দেয়া দালাল ও লবিস্ট গোষ্ঠী।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর দায় চাপিয়ে আসলে নরেন্দ্র মোদিই কি বাংলাদেশকে ঠকাচ্ছে না? এবং এর জন্য অবৈধ ক্ষমতার সমর্থন পেতে আওয়ামীলীগের চালিয়ে যাওয়া দাসসুলভ ‘নতজানু পররাষ্ট্রনীতি’ই দায়ী নয় কি? কেন যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক হচ্ছে না (সর্বশেষ ৩৭ তম বৈঠক, ২০১০)? কেন আওয়ামীলীগ সরকার আন্তর্জাতিক নদীর পানি হিস্যা ও তিস্তা চুক্তির দাবী ভারতকে আনুষ্ঠানিক ভাবে জানাতে পারছে না? অত্যন্ত কম পানি প্রবাহ নিয়ে অন্তত কিছু চিঠি দিতেও তার এর ভয় কিসের?
– ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক লেখক, গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ