করোনাকালে বিশ্বজুড়ে মঙ্গা চলছে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে সুপারম্যানদের কদর কমেছে। কারণ এরা আর যাই পারুক; কভিড নাইনটিন সুপার ভাইরাসকে পরাজিত করতে পারবে না। এমন সুপারম্যান দিয়ে ওরা কী করবে আর!
সুপারম্যানেরা সবাই চাকরির খোঁজে পথে ফ্যাঁ ফ্যাঁ করে ঘুরতে থাকে। হোয়াটসএপে সবাই যোগাযোগ করে হারকিউলিসের সঙ্গে। হারকিউলিসই একমাত্র লোক যে অনেক আগে চিনতে পেরেছিলো হীরকরাজ্যটিকে; তাই তো কোন পিছুটান না রেখে অভিবাসী হয়েছে হীরকরাজ্যে। সেইখানে রাতের ন্যায়বিচারদাতা হিসেবে ক্রসফায়ারের প্রদীপ হয়ে সে জ্বলছে। জনগণ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের এতোই ভক্ত যে দিনে দুপুরে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, ও হারকাউলিস ভাই আমি অপরাধীর লাশ দেখতে চাই; কেউ যেন কোনদিন বলতে না পারে; হীরকরাজ্যে ন্যায়বিচার নাই; ও হারকিউলিস ভাই।
হীরকরাজ্যে হারকিউলিসের সাফল্য দেখে প্রলুব্ধ হয় রবিনহুড। আগে সে দরিদ্র মানুষের মাঝে ডাকাতির অর্থ বিলিয়ে দিয়ে বিচার বহির্ভূত ন্যায়বিচারের কিংবদন্তী হয়েছিলো। জীবন বৃত্তান্তে এই সাফল্যের গল্প সে ইমেইল করে দেয় হারকিউলিসের কাছে। হারকিউলিস অনেক তদবির করে রবিনহুডের জন্য একটা চাকরি ম্যানেজ করে। ভাওয়ালমাণ্ডির জিডিপি কেল্লার পাখালের চাকরি। প্রাসাদের বেগমদের আলস্য বিনোদিত জীবনে তারা পাখী পোষে খাঁচায়। রবিনহুডের দায়িত্ব এই পোষা পাখিগুলো দেখেশুনে রাখা। ক্যারিয়ারে এমন কাপুরুষোচিত ডিমোশনে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয় রবিনহুড। সারাজীবন যে পাখিদের খাঁচা থেকে মুক্তি দিয়েছে; তাকে এখন পাখি উড়ে গেলে ধরে এনে খাঁচায় ভরার সহমত পাখাল হতে হয়েছে।
চাকরীর লোভে হীরকরাজ্যে এসেছে স্পাইডার ম্যান; তার দায়িত্ব ফেসবুক লাইভের সাবু আপাদের অবৈধ সৌন্দর্যের কারবার বন্ধ করা। সাবু আপা জুস খাইয়ে কালোকে সাদা, বেগুণীকে নীলাভ, হলুদকে সবুজ ইত্যাদি করে থাকে। ফেসবুক লাইভে সাবু আপা গান গায়, সাতটি রঙ এর মাঝে আমি মিল খুঁজে না পাই; জানিনা তো কেমন করে কী দিয়ে সাজাই। স্পাইডার ম্যান তার জীবনে অনেক মেয়েকে বিপজ্জনক পথ থেকে উদ্ধার করেছে। কিন্তু সাবু আপার জুস বিক্রি বন্ধ করতে গিয়ে সে নাকাল। সাবু আপা শুধু কানের কাছে ” স্পাইডার ম্যান ও স্পাইডার ম্যান তুমি আমার জানের জান” গান গেয়ে কান টুকরি বের করে দেয়। আর ফেসবুকে পাওয়া হাহা ইমো জোগাড় করে তারস্বরে হাহাহাহাহাহা করতে থাকে।
ভাগ্যান্বেষণে জেমস বন্ডও এসেছে হীরক রাণীর কৃপা প্রার্থনায়। তাকে টোটাবাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হয়। তার দায়িত্ব হচ্ছে হীরার খনির শ্রমিকেরা যাদের দুই বেলা জোটেনা আহার; তারা বেতন চাইলে তাদের দিকে টোটা ছুঁড়ে পিঠে রক্তজবার চিহ্ন এঁকে দেয়া। সারাজীবন হাইটেক ওয়ারফেয়ার করে আজ তাকে টোটা তাক করে বসে থাকতে হয়; শ্রমিক বিক্ষোভে টোটা মারতে।
নোম চমস্কি শাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শত বর্ষ পূর্তিতে সেখানে ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’ বিষয়ে পিএইচডি করছেন অধ্যাপক মুনতাসির ফ্যান্টাসির অধীনে। অধ্যাপক মুনতাসির নোম চমস্কিকে জিজ্ঞেস করেন, বলো তো চমস্কি; শ্রমিকের টোটাবিদ্ধ ক্ষত বিক্ষত রক্তাক্ত পিঠের ছবি ঢেকে দিতে কোন ধরনের শাক প্রয়োজন! চমস্কিকে মাথা চুলকাতে দেখে ব্যাংকবন্ধু চেয়ারের অধিপতি এই পণ্ডিত ঠাট্টা করে বলেন, চমস্কি তোমার নেসেসারি ইলিউশান বইটা পুড়িয়ে ফেলো। আবার নতুন করে শুরু করো শিক্ষা। অধ্যাপক ফ্যান্টাসি তার অধীনে পিএইডরত কালাজম খানকে জিজ্ঞেস করেন, বলো তো ব্ল্যাক পার্ল; কী দিয়ে ঢাকা যায় শ্রমিকের রক্তাক্ত পিঠ?
কালাজম উত্তর দেয়, পদ্মা সেতুর স্প্যান সাংবাদিকতার চার্ম ফুরিয়ে যাবার পর মেট্রোরেল সাংবাদিকতা চালু হয়েছে। তাই মেট্রোরেলের একটা দুইটা বগি লাইনের ওপর দিয়া নড়া চড়া করাইলে; ডেভিড কপারফিল্ডের জাদুর মতো কাজ হবে।
ডেভিড কপারফিল্ড উন্নয়নের জাদুর গল্প শুনে বাতাবিত্তোর টিভির এনএলই হিসেবে চাকরি নিয়েছে। তাকে হোস্ট হীরা আপু বলেন, কপারদা; মেট্রোরেলের বগির নড়াচড়া দিয়ে একটা রুদ্ধশ্বাস উন্নয়নের প্যাকেজ বানিয়ে দিন। আমি বাতাবিত্তোর জার্নালে উন্নয়নের ব্যাংক সিংহ আর সুচিন্তার ধারাপাত ভাইয়াকে নিয়ে ‘হায়রে আমার মন মাতানো মেট্রোরেল, হায়রে আমার হীরাভরা মাটি’ টকশো করতে চাই।
সব ঠিকই ছিলো; কিন্তু মেট্রোরেলের ইঞ্জিনের সামনে সবুজ-মাঝে সাদা-বর্ডারে লাল রঙ নিয়ে গোল বাধে। সবুজের পাশে সাদা থাকলেই পরাজিত পাকিস্তানের পতাকার মতো লাগে। তাই মাথায় লাল সবুজের পতাকা বেঁধে উত্তেজিত হয়ে চলে আসেন দেশপ্রেমিক ভাইয়ারা। রঙ চেঞ্জ করুন গো হীরক রাণী; পাকি রঙ চাইনা মেট্রোরেলে; দরকার পড়লে দিয়া বাড়ি টু মতিঝিল হেঁটে যাবো তবু পাকি কালারের মেট্রোরেলে চড়বো না।
হীরকরাজ্যের রাজন্য ও অমাত্য আত্মীয়দের স্পর্শকাতরতায় মেট্রোরেলের রঙ যখন বিরাট ও পোকিত পোবলেম; তখন ফেরি ঘাটে ঈদের বেতন তুলে সন্তানের মুখে জুঁই ফুলের মতো সাদা ভাত তুলে দিতে
মঙ্গার গ্রামে যাবার পথে সেলাইমাকে ফেরি থেকে হিঁচড়ে নামায় ব্যাটম্যান। সে-ও করোনাকালে চাকরি নিয়েছে গরীব মানুষকে টানা-হ্যাঁচড়া করার। গরীব মানুষ শুধু ভাতের ঐ সাদা রঙ-টাই চেনে। কিন্তু টোটাবাহিনী জোর করে তাকে রক্তের লাল রঙ চেনায়।
পাশের শুণ্ডি রাজ্যে করোনায় সারি সারি চিতা পুড়ছে; গঙ্গায় ভাসছে লাশ। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই; দৈনিক মরার দেশে চাকরি নেয়া ব্ল্যাক উইডো হঠাত এসে বলে, ভারতের মৃতদেহ নিয়া এতো কান্না কেন? তোমরা কী জানো রবীন্দ্রনাথ শাকা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির বিরুদ্ধে ছিলেন। এই যে কান নিয়েছে চিলে; সেই কানের খোঁজে খিলাফতের ভাইয়া ও বুবুরা রবীন্দ্রনাথের মাকে পর্যন্ত গালাগাল শুরু করে।
গড়ের মাঠে শাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজন নেই; চাষা ছেলেকে পড়ালে আমাদের জমিদারিতে কৃষকের অভাব হবে; এই বক্তব্য দিয়ে যারা পাড়া গরম করেছিলেন; তারা রবীন্দ্রনাথের ফেসবুক ফ্রেন্ড ছিলেন; কিন্তু ফ্রেন্ড ছিলেন না। রবি ছিলেন নিঃসঙ্গ শেরপা। আর রবীন্দ্রনাথ ঐ সময় কলকাতাতেই ছিলেন না; অসুস্থ অবস্থায় লন্ডনে ছিলেন। কিন্তু ব্ল্যাক উইডোর নেতৃত্বে খেলাফতিরা সে কথা কানে না তুলে; রবীন্দ্র আইকন ভাঙ্গার কাজে মন দেয়। দৈনিক মরার দেশের কাজই এরকম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উস্কানি দেয়া।
ওদিকে রবীন্দ্রনাথের মাকে গালি দেয়ায় হীরক রাজ্যের বিদূষকেরা একটা কাজ পায়; আঞ্জুমানে মফিদুল জোটে করোনায় মৃত সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীর সতকারের চাকরি নিয়েছে বাহুবলী। সে আঞ্জুমানে সাংস্কৃতিক জোটের সংস্কৃতি মামাদের বুদ্ধি দেয়, নারীর অবমাননায় ক্রসড্রেসিং শুরু করুন। অমনি শাখা-সিঁদুর পরে রবীন্দ্রনাথের মা সেজে ছবি দেয় ফেসবুকে। শুরু হয়ে যায়, “হ্যাশট্যাগ আমরা রবির মা; শাখা-সিঁদুরের ওগো নিরুপমা।”
এটা দেখেই খিলাফতে সাংস্কৃতিক জোটের অনুভূতি মামারা হিজাব পরে রকমারির মাকে গালাগালের প্রতিবাদ জানায় উইন্টার সোলজারের নেতৃত্বে। সে অনলাইনে বই বিক্রির ছোট্ট চাকরি পেয়েছে এই করোনাকালে। “হ্যাশট্যাগ বোরখা পরা মেয়েটা আমায় পাগল করেছে” মুভমেন্টে মাতোয়ারা হয় সূর্য মদিনার চেয়ে বালুগরম মদিনা।
চকিতে জ্যাকি চ্যান হীরক রাজ্যে তাদের দূতাবাঁশে চাকরি নিয়ে বলে, স্বামী শ্যাম আর আংকেল স্যামের সঙ্গে ঢলাঢলি কমান। উই মিন বিজনেস। আপনাদের ঐসব আবেগের ভটভটি রিলেশানশিপ বন্ধ করেন। অতো শ্যাম রাখিনা কূল রাখি করে ব্যবসা হয়না।
জ্যাকি চ্যানের কথায় অত্যন্ত আঘাত পান বিদেশ রাজন্য; তিনি ভাবেন, কূটনৈতিক শিষ্টাচার বলে কী কিছু নেই, গতকাল শ্যাম বলেছে, রাধা তুই উঁইপোকা; আঙ্গেল স্যাম বলেছে, কওমি প্রেম কমাও নইলে ওয়ার অন টেরর হবে। আর আজ জ্যাকি চ্যান এমন অসৌজন্যমূলক ব্যবহার করলো। শাবানাকে বিদেশ মন্ত্রকের কান্না দূত করে নেয়া হয়। তার কাজ শুধু ভেউ ভেউ কান্নার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা।
একদিন শাকা ক্লাবে হারকিউলিস, রবিন হুড, স্পাইডার ম্যান, ডেভিড কপার ফিল্ড,বাহুবলী, জেমস বন্ডকে শাবানা দাওয়াত দেন তাদের জব স্যাটিসফেকশান সম্পর্কে আলাপের জন্য। জেমস বন্ড বলেন, আপনাদের চাকরিগুলি সব ডিমোশান। করোনাকালে বাঁইচা থাকতে করেন একটা কিছু। কিন্তু এই যে টোটা ছুড়ে শ্রমিকের পিঠে লালজবার ট্যাটু করার কাজটা কিন্তু লা-জওয়াব।
– মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক
প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া