ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনার উন্মাদনায় মেতে থাকব আমরা। আমাদের নাকে শিশুর পোড়া গন্ধ আমরা একটুও অনুভব করতে পারবোনা। যেখানে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করা হয় সেখানে এতোদিন ধরে এতো শিশু কাজ করছে কেউ দেখল না! যেই পুড়ে মরে গেল, কয়লা হয়ে গেল তখনই সবার নজরে এলো। ছিঃ! এমন নজরদারিকে। সাংবাদিকগণ এখন খুব মানবিকতার কথা বলে বেড়াচ্ছেন। অথচ তারা অপেক্ষা করেন কখন মানুষ লাশ হয়ে যাবে। নিউজ ভ্যালু বাড়বে সেই অপেক্ষা করেন।এমন নিষ্ঠুর অপেক্ষা যেন লাশ পড়ার আগেই কিছুই করার থাকেনা তাঁদের। কারণ আজকাল সবাই এরকম নিষ্ঠুর অপেক্ষায়ই থাকেন। আমার জীবনের লক্ষ্য রচনা চিকিৎসক হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে বড় হয় নাই এরকম মেধাবী ছাত্র খুবই কম আছে। যদিও চিকিৎসক হওয়ার পরে তারা বেমালুম ভুলে যায় একসময় তারা সেবার কথা বলতো। চিকিৎসক হওয়ার পর পরই তারা টাকা রোজগার করে না রীতিমত হাতিয়ে নেয়ার মত সব ধরনের আয়োজন ষোল কলা পূর্ণ করে। সরকারি হাসপাতালগুলো কে অবহেলা করে গড়ে উঠতে দেয়া হয় একের পর এক প্রাইভেট হাসপাতাল। ডাক্তার খুব কৌশলে সরকারি হাসপাতালের রোগী প্রাইভেট হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। অশিক্ষিত অজ্ঞ জনগণ সেগুলো না বুঝে প্রাইভেট এর পিছনে দৌড়ায় আর সর্বস্বান্ত হয়। যাদের টুকটাক জ্যাক তৈরি করার মতো ক্ষমতা কোনো ভাবে কেউ পেয়ে যায় তারাই কেবল সরকারি হাসপাতালগুলোতে কিছুটা চিকিৎসা সেবা পায়। নইলে প্রাইভেট ছাড়া গতি থাকে না। দেশটিই যেন আস্ত প্রাইভেট হয়ে বসে আছে। শিশুশ্রমে নারায়ণগঞ্জের এই ঘটনার ছাড়াও আরো অনেক ঘটনা আছে যেখানে খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে প্রচুর শিশু শ্রমিক কাজ করছে। মালিক এ কাজ করা শিশুদের থেকে অতিরিক্ত কাজ আদায় করে নিতে পারবে অনেক কম টাকায়। বড়রা থাকলেই আন্দোলন’ করবে। শিশুরা তো আন্দোলন করতে শিখে নাই! যেমন বস্ত্রখাতে নারী নেয়া হয় ঠিক একই কারণে । যত পরিশ্রম মেয়েদেরকে দিয়ে করিয়ে নেয়া যায় তার থেকে অনেক কম পরিশ্রম ছেলেরা করবে, এটা জেনে শুনেই গার্মেন্টস সেক্টরে নারী শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হয়। যদিও বলা হয় অন্য কথা। ঘটনার আড়ালের কথাগুলো বুঝতে শিখেছি অনেক আগেই। হয়তো বলি না কিংবা বলতে পারি না। আর শুধু মালিকপক্ষ কেন শিশুশ্রমের ব্যাপারে এই শিশুদের বাবা-মাকেও বিচারের আওতায় আনা উচিত। যে পিতা-মাতা একটা সন্তান জন্ম দিয়ে ভরণপোষণ দিতে পারবেনা, শিক্ষা চিকিৎসা দিতে পারবে না, তাদের জন্ম দিতেই হবে কেন! আমি জানি এদের গভীরের যায়গা থেকেই। আমি কম দেখিনি। এরা বছর বছর বাচ্চা পয়দা করে যেন বাচ্চার রোজগার খাওয়ার জন্যই। বিভিন্ন জায়গায়, বাসা বাড়িতে কাজে দিয়ে দেয়। কলকারখানায় কাজে দিয়ে দেয়, চা দোকানে দেয়, গ্যারেজে দেয়। এই সকল পিতা-মাতাকে শাস্তি প্রদান করা উচিত। পিতার যোগ্য হওয়ার মতো যোগ্যতা হয়ে ওঠেনি যার বা যাদের তাদের কেন জন্ম দিতেই হবে!পরিবার পরিকল্পনা যে কি কাজ করছে সেটা গ্রামে কাজ করার সুবাদে আমি খুব কাছ থেকে দেখছি। মাঝে মাঝে মনে হয় যেন ইচ্ছে করেই পরিবার পরিকল্পনা আর কাজ করেনা। দেশে কল-কারখানা হচ্ছে, উন্নয়ন হচ্ছে, যাই হচ্ছে- সবই মালিক শ্রেণীর মুনাফার জন্য । মাঝে মাঝে মনে হয় ধনীরা গরিব পেলে পুষে রাখে। তাদেরকে সেবা দেয়ার জন্য, ঘরে সেবা, বাইরে সেবা, রাস্তায় সেবা।কতো রকম সেবা যে তাদের লাগে সেটা বলে কয়ে শেষ করা যাবেনা। পাঠ্যপুস্তকে খুব করে বলা হয় কোনো পেশাই ছোট নয়। এটা বইয়ের কথা আসলে এই জাতি এরকম চিন্তা করতে আরো ৫০০ বছরেও পারবে কিনা আমার সন্দেহ আছে। কারণ আমি বিশ্বাস করি শিক্ষার কোয়ান্টিটি আর কোয়ালিটি এক জিনিস নয়। এবার আসি মূনাফার কথায়। মুনাফার প্রথম শর্ত হচ্ছে সস্তা শ্রম আর সস্তায় শ্রমিক নিতে হলে এরকম মানুষ লাগবে যারা গত পরশুদিন পুড়ে মরলো বেশ কয়েকজন। বলা হয় ৫২ জন, আসলে ক’জন সেটা তো জানার সাধ্য আমার নেই । আমার মনে হয় অনেক আগেই এক সন্তান জন্মদানের নিয়ম করে দেয়া উচিত ছিল। অথবা আরেকটা জিনিস করা যেত যাদের ধন-সম্পদ আছে যে কোনোভাবেই, তারা সন্তান উৎপাদন করুক তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু যারা নিম্নবিত্ত তাদেরকে অবশ্যই এক সন্তানের বেশি জন্মদানে বাধা দেয়া উচিৎ ছিল আরও অনেক আগেই। শিশুরা তো নিষ্পাপ। জন্মগ্রহণ করে কোনো পাপ করেনি ওরা। যদিও জন্মের সাথে সাথেই ওদের অজান্তেই ওরা মাথায় নিয়ে চলে হাজার হাজার টাকার ঋণ। সারা জীবন দিলেও যা থেকে ওরা কখনোই মুক্তি পাবে না। বলেছি ঠিকই আবার এও বুঝি এই ধর্মোন্মাদনার দেশে এই আইন করাটা অনেক কঠিন হবে। তবে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন এবং সেটা সফল ভাবে নিতে পেরেছেন। এই বিষয়টা একটু খতিয়ে দেখবেন বলে তাঁর সদয় দৃষ্টি কামনা করছি। ছোটবেলা থেকেই আমি খেলা পারতাম না বলে আমাকে কেউ খেলায় নিত না, খুব কান্নাকাটি করলে যদি কারো মায়া হতো তখন আমাকে দুধ ভাত হিসেবে নেয়া হতো। এই প্রজন্ম জানেনা দুধভাত আসলে কি বিষয়।আমি এখনো খেলা দেখি না। আমার কাছে খেলা তো স্রেফ
খেলাই। খেলার পেছনে এত টাকার নষ্টের গুরুত্ব আমার কাছে নেই। বিনোদনের জন্য এত টাকা কেন নষ্ট করতে হবে! যে দেশে মানুষের এখনো চিকিৎসা, শিক্ষা এসবে অনেক ঘাটতি রয়েছে সে দেশে এমন বিনোদন একদমই মানায় না । অবশ্য টাকা খরচ না করে সুস্থ শরীর তৈরিতে যেসব খেলা সেগুলিকে আমি অবশ্যই গুরুত্বের সাথে দেখি।এসব বিষয় নিয়ে আমার আরো অনেক কথা ছিল যা এখানে বলা যাবে না কিংবা এখন বলা যাবেনা অথবা বলতে গেলে আমার মুশতাক কিংবা কাজলের চেহারাটা মনে পড়ে যাবে। রক্ত পুঁজ এর গন্ধ পাই আমি এখনও। শিশুর লাশের গন্ধ পাই। আমি খেলা দেখি না এখনো। আমি কখনোই আমি কোনো বিনোদনের পেছনে দৌড়াই নি। আমার জীবনটা ছিল এবং এখনো আছে, স্রেফ যুদ্ধক্ষেত্র। সন্তানদের চিকিৎসা, শিক্ষা আর ন্যূনতম খাবার দিতে গিয়েই সারাজীবন হিমশিম খেয়েছি। বিনোদনের পেছনে টাকা নষ্ট করিনি। করার ইচ্ছেও হয়নি।বাবার কথা মনে পড়ে যায়।স্রেফ চিকিৎসা আরও প্রয়োজনীয় খাবারের অভাবেই বাবা মারা গেলেন। শুধু একটুখানি লিখতে ভালো লাগে, সেটাও মন খুলে লিখতে পারিনা। এত এত ব্যর্থতা নিয়ে চলতে গেলে মনে হয় সেই কবিতার লাইন, “জন্মই আমার আজন্ম পাপ!”
– শামা আরজু, লেখক