করোনা ভাইরাস গ্রিণ ডেল্টায় প্রবেশের পর থেকেই বদলে যেতে থাকে। তাকে যেন ক্ষমতার মোহ পেয়ে বসে। গ্রিণ ডেল্টা ভাইরাস অবশ্য করোনা ভাইরাসের চেয়ে শক্তিশালী। গ্রিণ ডেল্টা যে হীরক রাজ্য; এখানে চাঁদের টানে নদীতে জোয়ার ভাটা হয়; মানুষের মন চাঁদের টানে কখনো ই-ভ্যালিতে ঘুরতে যায়; কখনো বা ভাটার টানে ডেসটিনি বদলে দেয়। অত্যন্ত শুদ্ধাচারের প্রতীক এই গ্রিণ ডেল্টাভাইরাস; ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য
সদা সতর্ক অতন্দ্র প্রহরী।
করোনাভাইরাসের মাঝে ‘ভাবমূর্তি’ রক্ষার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় গ্রিণ ডেল্টাভাইরাস। গ্রিণডেল্টা ভাইরাস যে সংখ্যক মানুষ মেরেছে গত করোনা দুই বছরে; করোনা ভাইরাস সেই স্কোর বোর্ডের দিকে তাকিয়ে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াতে থাকে। সেই দৌড়ে হাসপাতালে অপার আনন্দে ঘুমিয়ে থাকা করোনাহত জনমানুষের ছবি দেখে গ্রিণ ডেল্টা ভাইরাস তাচ্ছিল্য করে; মায়ানমারের হাসপাতালের ছবি দিয়া করোনাভাইরাসের স্কোর বাড়াইতে চেষ্টা করতেছে। ফ্যাক্টস চেকিং-এর দায়িত্বে রয়েছেন ডেল্টা ভাইরাসের সাইবার ব্রিগেড; এরা ‘ডোন্ট অরি, বি হ্যাপি’ গান গাইতে গাইতে সত্যানুসন্ধান করে দেখিয়ে দেয়, গ্রিণ ডেল্টাভাইরাসের চেয়ে করোনাভাইরাস কম সাফল্য পেয়েছে এই জনপদে।
এপার্টমেন্টের নীচে চাঁদপানা নাতিকে নিয়ে দাঁড়িয়ে কুরবানির জন্য নিয়ে আসা গরুকে আদর স্নেহ করছেন কুরবান সাহেব। কুরবানির আগে প্রাণীর সঙ্গে আত্মীয়তা তৈরি করতে হয়। যাতে কুরবানি দেবার সময় নিজের সন্তান হারানোর বেদনাহত হওয়া; সেটাই এই ঐতিহ্যের শিক্ষার জায়গা। গরু একটু গম্ভীরভাবে বলে, করোনার সময় আদর সোহাগ দূর থেকে করেন আব্বা। সোশ্যাল ডিসট্যান্স বজায় রাখুন।
কুরবান সাহেব গম্ভীরভাবে বলেন, এই গোরু আমাকে স্যার বলো। ডেকোরাম মেনে চলো।
গরু হেসে বলে, আপনিই তো স্যার করোনাকালের ডেকোরাম অনুযায়ী মাস্ক পরেন নাই। আর এই এপার্ট্মেন্টে যতজন ফুড রাইডার আসে, আপনার নাতি গিয়া ঝাঁপ দিয়া তাদের কোলে উঠতে চায়।
কুরবান সাহেব বুঝিয়ে বলেন, দেখো গরু মৃত্যু আসবেই দু’দিন আগে আর দু’দিন পরে। আর আমি গ্রিণ ডেল্টা ভাইরাসের মধ্যে গড়াগড়ি দিয়ে বেঁচে যাওয়া লোক। করোনাভাইরাস আমাকে কী করবে আর! আর বাচ্চাটা সারাদিন বাসায় বন্দী থাকে; ওরও তো ইচ্ছা করে একটু মানুষের সঙ্গে মিশতে।
কুরবান সাহেবের মেয়ে মার্সিয়ার সময় কাটে মাস্টার শেফ অস্ট্রেলিয়া দেখে। দেশের মেয়ে কিশোয়ার সেরা তিনের সাফল্য পাওয়ায়; এই শো’র বিভিন্ন পর্ব ঘুরে ফিরে দেখে সে। বাসায়-অফিসে সময় কাটানোর সঙ্গী হয়েছে তার এই কুকিং শো। সে পান্তা-আলুভর্তা প্লেটে সুন্দর করে সাজিয়ে গরুর সামনে পরিবেশন করে।
গরু কাতর স্বরে বলে, কয়েকদিন পর তো মরেই যাবো। একটু ভালো মন্দ খেতে চেয়েছিলাম মার্সিয়া।
কুরবান সাহেবের মেয়ে অত্যন্ত আহত হয়। মেয়েটির মন খারাপ দেখে গরু বলে, আমি দুঃখিত মার্সিয়া আপনার কিশোয়ার-অনুভূতিতে আঘাত দেয়ায়। দিন আজ প্রাণ ভরে পান্তা খাই।
মার্সিয়া গরুটার পান্তা খাওয়ার দৃশ্য নিয়ে ফেসবুক লাইভ করে। সে গরুটিকে বলে, পান্তাভাত খেয়ে তোমার অনুভূতি কী!
গরু উত্তর দেয়, পান্তা খেয়ে টিপসি লাগছে মার্সিয়া; তা ছাড়া মিডিয়ায় ইন্টারভিউ দেয়াটা আমার পছন্দ নয়।
ফেসবুক লাইভের মন্তব্যে একজন দর্শক প্রস্তাব করে, এই গরুর নাম বুদ্ধিজীবীর তালিকায় দেয়া হোক। মার্সিয়া এই মন্তব্যটি পড়লে গরু প্রতিবাদ জানায়। আমি কুরবানিজীবী; মন্তব্যকারীর নামটি বরং বুদ্ধিজীবী তালিকায় দেয়া হোক। উনি অনেক বুদ্ধি দিয়ে মন্তব্য করেছেন। হাহাবাদিরা এসে গরুকে স্যালুট দিয়ে যায়।
গরুকে একজন জিজ্ঞেস করে, ট্রাকে করে আসার পথে গ্রিণ ডেল্টা ভাইরাস বেশ জ্বালিয়েছে নিশ্চয়ই; ঘাটে ঘাটে গরুর ট্রাক থামিয়েছে নিশ্চয়ই।
গরু উত্তর দেয়, আমি গ্রিণ ডেল্টাভাইরাসের ওপর খুবই বিরক্ত; ঘুমের মাঝে বাঁশি বাজাইয়া বিরক্ত করছে। গরুর ব্যাপারীকে ধমক দিয়ে পকেটে ঢুকে পড়ে তারা। গ্রিণ ডেল্টা ভাইরাসের ধমক শুনে চমকাইয়া উঠতেছিলাম। গ্রিণ ডেল্টার ভয়েস খুবই কর্কশ। করোনার কন্ঠ অনেক সুন্দর। সে এসে কী সুন্দর ইয়ার্কি ঠাট্টা করে। গরুর হাটে মানুষের ভিড় দেখে আমার কানের কাছে ফিস ফিস করে করোনাভাইরাস বলেছে,
দেখে করোনা বিনিময় ওরস মনে হচ্ছে। এইবার প্রকৃত কুরবানি ঈদ হচ্ছে।
একজন দর্শক প্রশ্ন করে, করোনা আর কী কী বললো!
–গ্রিণ ডেল্টা ভাইরাস নাকি করোনাকে ঘুষ দিয়ে কুরবানি ঈদের জীবন ও জীবিকার স্বার্থে; কয়েকদিনের আনলক ডাউনের সুযোগ আদায় করে নিয়েছে। করোনাভাইরাস বলেছে, সেই পরিসংখ্যানই সত্য; যা রচিবে তুমি কবি। তবে তাই হোক।
এক দর্শক প্রতিবাদ জানায়, গ্রিণ ডেল্টা ভাইরাসের অভিধানে ঘুষ শব্দটি নেই। আর পরিসংখ্যান নিয়ে অযথা সন্দেহ ছড়াবেন না; ভরসা রাখুন গ্রিণ ডেল্টা ভাইরাসের ওপর। প্লিজ আমাদের গ্রিণ ডেল্টা ভাই অনুভূতিতে আঘাত দেবেন না।
মার্সিয়া দর্শকদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে। গরু পান্তা খেয়ে খানিকটা টিপসি। ভুলভাল বকছে। কেউ মাইন্ড করবেন না যেন। আর ভেবে দেখুন বেচারা কয়েকদিন পরেই এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে। তার ওপর রাগ করবেন না। ফেসবুক লাইভ এখানেই শেষ করছি; এই গরু আবার কোন অনুভূতিতে আঘাত করে বসে।
মার্সিয়া গান গাইতে গাইতে ঘরে ফিরে যাচ্ছিলো। ফেরার আগে গরুকে একটা উড়ন্ত চুম্বন দেয়।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ফিমেল গরু ঠাট্টা করে বলে, বুদ্ধিজীবী গরু নিয়ে ফেসবুক লাইভ করে নিশ্চয়ই অনেক লাইক পেয়েছেন আফা; তাই এতো আনন্দ।
মার্সিয়া স্নিগ্ধ হেসে বলে, তোমাকে নিয়েও ফেসবুক লাইভ করবো।
ফিমেল গরু উত্তর দেয়, আমি ঐ বুদ্ধিজীবী গরুর মতো ইন্টারভিউ দিবো না। আমার কস্টিউম চাই। বাঁধনের জামদানি ছাড়া আমি শো করবো না।
মার্সিয়া বিস্মিত হয়। তুমি বাঁধনের জামদানির কথা কী করে জানলে!
ফিমেল গরু উত্তর দেয়, এইখানে যারাই আসে মোবাইলে বাঁধনের জামদানির ছবি দেখে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তো। কেউ প্রশংসার ছলে বাঁধনের জামদানির ছবি দেখে; কেউ সমালোচনার ছলে বাঁধনের জামদানির ছবি দেখে। আর নারীতান্ত্রিক সমাজ তো ফ্যাশান পছন্দ করেই। কেউ প্রশংসার ঢঙ্গে কেউ বা সমালোচনার ঢঙ্গে আসলে পছন্দই করে।
মার্সিয়া জিজ্ঞেস করে, শুধু কী বাঁধনের শাড়ির কথাই বলে সবাই, কান ফেস্টিভ্যালের কথা বলে না! ফিল্ম নিয়ে আলাপ করে না!
বুদ্ধিজীবী গরু কাশতে কাশতে বলে, ফিল্ম তো দেখে নাই কেউ; খালি ফিল্মের নাম দিয়া তো আলোচনা হয় না। গল্পটাই তো জানে না কেউ। তাই শাড়ির গল্পটাই হিট হইলো। পরে ফিল্ম নিয়ে আলাপ হবে; কিন্তু আমরা তো আর অতোদিন বাঁচবো না।
মার্সিয়ার মাঝে অনুতাপ তৈরি হয়। বাসায় ফিরে ডিনারে শুধু কিশোয়ারের পান্তা খায় ভর্তা দিয়ে ওপরে পোড়া লাল মরিচ রেখে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, সে ভেজিটেরিয়ান হয়ে যাবে। সে তার বাবাকে বলে, গরুটা বেশ কাশছিলো; কভিড পজিটিভ নয়তো আব্বু!
মার্সিয়ার বাবা বলেন, করোনাভাইরাস শুধু মানুষের দেহে সংক্রমিত হয়।
–আমাদের গরু বলছিলো, করোনাভাইরাসকে ঘুষ দিয়ে নাকি ঈদের জন্য
আন লকডাউনের সমঝোতা হয়েছে।
–দ্য কাউ মাস্ট বি ক্রেজি!
মার্সিয়া তার ঈদের জন্য কেনা বাঁধনের জামদানি শাড়ি আলমিরা থেকে বের করে আবার নীচে গিয়ে ফিমেল গরুটিকে পরিয়ে দিয়ে আসে।
ম্যাড কাউ মার্সিয়াকে জিজ্ঞেস করে, আপনার আব্বা কী ঘুষ খেতেন অনেক! নইলে এতো দাম দিয়া গরু কিনলেন; আবার আপনি ফস কইরা এতো দামি শাড়ি আইনা দিলেন। আইজ পান্তা খাওয়াইছেন ঠিক আছে; আগামিকাল পাস্তা চাই। অর্ডার কইরা দিয়েন; আইসা পড়বো। আমার তো ফুড রাইডারদের সঙ্গে সারাক্ষণই দেখা হয়।
মার্সিয়া রেগে গিয়ে বলে, আমার আব্বুকে নিয়ে বাজে কথা বলায় তোমার খাওয়া দাওয়া বন্ধ। থাকো অনাহারে। বুঝবে কত কষ্ট অনাহারের।
গরু উত্তর দেয়, পথে পথে ক্ষুধা দেইখা আসলাম; এই এপার্ট্মেন্টের এক কর্মচারি আজ বিদায় নিয়ে গেলো, বললো, হয়তো আমার লাশ ফিরে আসবে। কী করবো দুই ঈদে দেশে যাই নাই। আর আপনি আমারে অনাহারের গল্প শোনাচ্ছেন। কাল পাস্তা অর্ডার করবেন মনে থাকবে তো।
মার্সিয়া ফিরে যাবার পর অদূরে বাঁধা দুটি ছাগল, ছ্যা ছ্যা করে ফিমেল গরুর দিকে তাকিয়ে। সমস্বরে বলে, ঐ মেয়ে তোমার পিঠ খোলা কেনো! সঠিকভাবে পরো শাড়িটা।
বুদ্ধিজীবী গরু প্রতিবাদ করে, পিঠ তো পিঠই; পিঠ নিয়ে এতো কথা কেন!
একটি ছাগল ধমক দেয়, চুপ কর বুদ্ধিজীবী কুনহানকার!
এমন সময় কিছু করোনাভাইরাস এসে গরু ছাগলদের বলে, আমাদের বাঁচান। আমাদের বেশ কিছু করোনাভাইরাস মানুষের সঙ্গে পুড়ে মরেছে জুস কারখানায়।
ফিমেল গরু করোনাভাইরাসকে কটাক্ষ করে, গ্রিণ ডেল্টাভাইরাসের বুদ্ধির সঙ্গে আপনাদের পারার উপায় নাই। আপনারা যতই চেষ্টা করেন, এদের মতো এতো মানুষ মারতে পারবেন না। আবার নৈশ পরিসংখ্যানের মারপ্যাঁচে আপনারা পিছায়া পড়বেন; নিজেরাও মরবেন ঝাড়ে বংশে।
বুদ্ধিজীবী গরু আশ্বস্ত করে, চিন্তা নিয়েন না; এই এপার্ট্মেন্ট বিল্ডিং-এ নানা কিছিমের মানুষ আছে; তারা আপনাদের লিফটে করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে নিয়ে যাবে। আপনারা কপাল কইরা জন্মাইছেন
ভাইরাসতন্ত্রের করোনাস্যারেরা। আর আমরা পশুপ্রাণীরা এইখানে গরমে কষ্ট পাই দিন রাত। মৃত্যুর আগেই একী দোজখে আইসা পড়লাম!
এক করোনাভাইরাস বলে, চলো এয়ারকন্ডিশনে ঘুমাইতে যাওয়ার আগে সামনের দোকান থেকে চা খেয়ে আসি। গ্রিণ ডেল্টাভাইরাস শুনলাম, দোকানে একটা শাটার খোলা থাকলে ৫০০ টাকা আর দুইটা শাটার খোলা থাকলে ৮০০ টাকা করোনা শুল্ক নিচ্ছে। আবার কেটলি গুণেও করোনাকর কেটে নিচ্ছে; কর না দিলে, কেটলিদের গ্রেফতার করা হচ্ছে করোনা-সন্ত্রাসীর পক্ষের কেটলি বলে। গ্রিণ ডেল্টা ভাইরাসের জন্য এই সময়টা যেন করোনা বসন্ত।