কথিত লকডাউনে, বহু পুরনো একটি গল্প মনে পড়ে গেল। গল্পটা হয়তো অনেকেরই জানা আছে।
‘অজপাড়া গাঁয়ের সহজ সরল এক কৃষকের বেয়াড়া স্ত্রী, যার স্বভাব ছিল উল্টো পথে চলা। তাকে স্বামী যদি ডানে যেতে বলতো মহিলা বাঁয়ে যেত। উত্তরে যেতে বললে দক্ষিণে, পশ্চিমে বললে পূর্বে।অর্থাৎ স্বামীর কথার অবাধ্য হয়ে উল্টো কাজ করতে মহিলা সিদ্ধহস্ত ছিল।একদিন স্বামী-স্ত্রী দুই জনের মধ্যে খুব ঝগড়া হলো।মহিলা স্বামীর উপর রাগ করে আত্মহত্যা করতে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রবল স্রোতে মহিলা সাগরের দিকে ভেসে যায়।
কিছুক্ষণ পর স্বামী বেচারা, বেয়াড়া স্ত্রীকে খুঁজতে নদীর তীরে ছুটে আসে।
স্রোতের দিকে না খুঁজে তিনি বিপরীত দিকে ভাটির দিকে খুঁজতে হাঁটতে শুরু করেন। তার বিশ্বাস সারাজীবন যেহেতু সেই উল্টো পথে চলেছে, আজো নিশ্চয়ই উজানের স্রোতের দিকে না গিয়ে স্ত্রী উল্টো দিকে ভাটিতেই গিয়েছে। যে জন্য এই গল্পের অবতারণা।
লকডাউন যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘অবরুদ্ধ’ করে রাখা। সরল বাংলায় যার অর্থ ‘তালাবদ্ধ’ করে রাখা।
অর্থাৎ কোনো জরুরি পরিস্থিতির কারণে সাধারণ জনগণকে কোনো জায়গা থেকে বের হতে না দেয়া, কিংবা ঐ জায়গায় প্রবেশ করতে বাঁধা দেয়ার নাম হলো লকডাউন।
পুলিশ হেফাজতে থানায় বন্ধাবস্থাকে যেমন লকআপ বলে, তেমনি জাতীয় জরুরি অবস্থায় থানার বাহিরে ঘরের মধ্যে বা বিশেষ কোন স্থানে বন্ধাবস্থাকে লকডাউন বলে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯ কে বিশ্বমারী ঘোষণার পাশাপাশি বিশ্ববাসীকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলো, কোভিড – ১৯ বা করোনা ভাইরাসের কোন প্রতিষেধক এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে আবিষ্কৃত হয়নি। সুতরাং করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধের জন্য সামাজিক দুরত্ব বজায় চলার পরামর্শ দিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তারা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বলেছে সন্দেহভাজন মনে হলেই ‘পরীক্ষা ,পরীক্ষা এবং পরীক্ষা কর,’ তারপর নিশ্চিত হও তুমি করোনা মুক্ত কিনা।
১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যখন করোনাকে বিশ্বমারী ঘোষণা করে, জাতি হিসেবে আমরা তখনো উৎসবে মেতে ছিলাম। আমদানিকৃত ৭ মেট্রিক টন আতসবাজির রঙিন আভায় রাঙিয়ে বেড়িয়েছি সমগ্র দেশে। বিশ্ব যখন করোনার হিংস্র থাবায় বিধ্বস্ত এবং বিপর্যস্ত আমরা তখনো একে সাধারণ সর্দি কাশি বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছি।
চীনের উহান থেকে শুরু করে এশিয়ার ইরান, ইরাক থেকে ইউরোপের দেশ ইতালি, স্পেন,জার্মান, ফ্রান্সের সীমানা পেরিয়ে আমেরিকার মতো সমৃদ্ধ দেশ যখন করোনা প্রতিরোধে নিজেদের দেশে যুদ্ধাবস্থা ঘোষণা করেছে। তখনো আমরা আমাদের শিশুদের রক্ষার জন্য স্কুল কলেজ বন্ধ ঘোষণা করবো কি করবো না সেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগেছি।
পৃথিবীর সবদেশের বিমানবন্দর,নৌ বন্দর, স্থল বন্দরে ব্যাপক কড়াকড়ি চলছিল পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়া কাউকে কোন অবস্থাতেই দেশে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছিল না। তখনো আমরা ঢিলেঢালা পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই পর্যটক আর প্রবাসীদের অবাধে দেশে ঢুকতে সহযোগিতা করেছি।
সামান্য থার্মাল স্ক্যানারের অভাবে দেশে আগতদের পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
প্রবাসীদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন দূরের কথা হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা পর্যন্ত নিশ্চিত করতে পারিনি আমরা।
অন্যরা যখন একে একে বহিঃবিশ্বের সাথে নিজেদের বিমান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা তখনো একচেটিয়া বাণিজ্য করেছি।
মার্চের শুরু থেকে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ যখন লকডাউন ঘোষণা করে অফিস আদালত, কলকারখান সহ সকল প্রকার যানবাহন বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা তখনো জাতীয় উৎসবের আগে দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ঘোষণা দেওয়া উচিত হবে কি, হবে না সেই সিদ্ধান্তহীনতায় মার্চ মাসের অর্ধেক শেষ করে দিয়েছি।
করোনার ভয়ে সমগ্র বিশ্ব যখন আতঙ্কে কাঁপছে। আমরা তখনো করোনার চেয়ে নিজেদের অনেক শক্তিশালী বলে প্রলাপ বকছি। অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ, উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং অবকাঠামোর দিক দিয়ে এগিয়ে থাকা দেশ গুলো যখন নিজেদের দেশে তৈরী ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের রপ্তানি নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। আমরা সেখানে বিদেশে রপ্তানি করার স্বপ্ন দেখাচ্ছি জাতিকে।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অভিমতে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়া সংক্রামণ ব্যাধি করোনার চিকিৎসা সেবা প্রদান যেখানে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ,
সেখানে আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে অফিস অর্ডার জারি করে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়া চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ প্রদান করছি।
অন্যরা যখন করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে, সেখানে আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দাবি করোনা আক্রান্ত ৮০ ভাগ রোগীর কোন চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঘোষিত নির্দেশনা অনুযায়ী অন্যরা যখন করোনা সন্দেহভাজন রোগীদের পরীক্ষার জন্য নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে,
আমাদের তখনো আইইডিসিআর’এ একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান টিমেটালে পরীক্ষা করে চলছে।আইইডিসিআর’এর কর্তৃত্ব প্রদর্শন ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ, পিজি হাসপাতাল সহ অন্যান্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও প্রতিষ্ঠানে নমুনা পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে তিন সময় চলে যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশনা ছিল সন্দেহভাজন হলেই নমুনা পরীক্ষা করো। আমরা সেখানে জীবিত অবস্থায় নয় বরং মৃত্যুর পরে লাশের নমুনা সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। একমাসে করোনা সন্দেহে সারাদেশের প্রায় ৬ লক্ষ মানুষ হটলাইনে টেলিফোন করে নমুনা পরীক্ষা ও চিকিৎসা সেবা গ্রহণের জন্য যোগাযোগ করে। এই সময়ের মধ্যে মাত্র ৭ থেকে ৮শ’ মানুষের নমুনা পরীক্ষা করে মাত্র ৩৩ জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সনাক্ত করতে আমরা সক্ষম হই। প্রবল সমালোচনার মুখে পরীক্ষার পরিধি বৃদ্ধি করার ফলে দেশে বিগত ১৮ দিনে ২০ হাজার লোকের নমুনা পরীক্ষা করে ২১শ’ উপরে করোনা আক্রান্ত রোগী সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যখন তাদের গোপন রিপোর্টে আশঙ্কা করছিল বাংলাদেশে করোনা সামাজিক সংক্রমণের ফলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারন করবে। এই সংক্রমণের ফলে প্রায় ২ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হতে পারে বলে তারা আশঙ্কা কথা তাদের গোপন রিপোর্টে উল্লেখ করেছিল।
তখনো আমরা দিব্যি দাবি করছি বাংলাদেশে এখনো করোনার সামাজিক সংক্রমণ ঘটেনি এবং পরিস্থিতি সম্পুর্ন আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দের অভাবে যেখানে জরুরি করোনা চিকিৎসা সেবা প্রদানকারী ডাক্তার নার্স, কর্মকর্তা কর্মচারী এবং রোগীদের জন্য মানসম্মত খাবারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে স্থানীয় প্রশাসন হিমশিম খাচ্ছে। অথচ সেখানে অকার্যকর সার্ক চিকিৎসা তহবিলে আমরা তখন ১৫ লাখ ডলার অনুদান দিয়ে নিজেদের আর্থিক সক্ষমতার পরিচয় বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে কৃপণতা করছি না।
লকডাউনে সমগ্র বিশ্ব যখন অচল হয়ে পড়েছে। আমরা তখন সাধারণ ছুটিতে উৎসব পালনের জন্য কেউ সমুদ্র সৈকত আবার কেউ আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীর সাথে মিলিত হতে বাসে, লঞ্চে,নৌকায়, ফেরিতে, ট্রেনে চড়ে গ্রামে ছুটে চলেছি ।
লাখ লাখ মানুষ পঙ্গপালের মত হাটে মাঠে ঘাটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠেছে।
পুলিশ বিজিবি র্যাব সেনাবাহিনী নামিয়ে সাধারণ ছুটির উৎসবে মেতে উঠা জনগণকে কোন ভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
অনেকেই শুধু শুধু সাধারণ মানুষকে গালমন্দ করছে, দোষারোপ করছে এবং বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ব্যঙ্গাত্মক ট্রল করছে।২০৫০ সাল নাগাদ একটি জাতি নাকি শুধু বাজার করার কারণে বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে ট্রল করেছে। ট্রল করার আগে একবার ভাবুন তো, কোন দেশে সাধারণ ছুটিতো উৎসব পালন করতে দেয়া হয়, তাই নয় কি ?
ঈদ,পয়লা বৈশাখ, জন্মাষ্টমী, ক্রিসমাস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসে উৎসব পালনের জন্য সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। এই ছুটি গুলো উপভোগ করার জন্য আমাদের দেশের মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আত্মীয় স্বজনের সাথে মিলিত হতে গ্রামে গঞ্জে ছুটে যায়। দল বেঁধে বন্ধু বান্ধবের সাথে আড্ডায় মেতে ওঠে। বিত্তবানরা পরিবার পরিজন নিয়ে দেশের বাইরে চলে যায়।
সাধারণ ছুটিতে দিনে দুপুরে দল বেঁধে সবাই বাহিরে হৈ হল্লোল করে পাড়া মহল্লা মাতিয়ে রাখে।আর রাতে পুলিশ বিজিবি র্যাব সেনাবাহিনীর পাহারায় দিব্যি নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে।
সবাই লকডাউন করে দিনে, সন্ধ্যা বা দিনের কোন এক সময় সামান্য কিছু সময়ের জন্য নিয়ম শিথিল করে জরুরি প্রয়োজনীয় ঔষধ সহ অন্যান্য দ্রব্য ক্রয়ের জন্য। আর আমরা সারা দিন শিথিল রেখে রাতে কড়াকড়ি করে কারফিউ বা সন্ধ্যা আইন জারি করেছি।
কি বিচিত্র এই দেশ! বিশ্ব যে পথে হাঁটছে আমরা ঠিক এর উল্টো পথে হাঁটছি।
করোনা ভাইরাসের মত মরণঘাতি মহামারী নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের উন্নত দেশ গুলি যেখানে যুদ্ধকালীন কারফিউ ঘোষণা করে মানুষকে ঘরে আটকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে আমাদের মত নিম্ন মধ্যবিত্ত দেশের দরিদ্র পীড়িত,অক্ষরজ্ঞানহীন বা অর্ধশিক্ষিত ও ক্ষুধার্ত মানুষকে সাধারণ ছুটি দিয়ে করোনার মত বিশ্বমারী ঠেকানো বা নিয়ন্ত্রণে রাখার চিন্তা করা আর বোকার স্বর্গে বাস করা একই কথা।
– এ কে এম বেলায়েত হোসেন কাজল