এটা কি আমি ঠিক জানি না। সম্ভবত মিনি আইপিএস। বড় নয় বেশি ওজন অনেক বেশি। চার্জিং মেশিন সহ অনেকগুলি তার। ভাল্ব সহ বড় একট বাজারের ব্যাগ, তোড়াছেঁড়া। এটা বহন করার সাধ্যি তানজিনা কেনো আমারই নেই। তানজিনা ষোলো/সতেরো বছর বয়সী একটি মেয়ে যার পরিচয় অন্য কোথাও দেবো আশা আছে। যাই হোক রওয়ানা হলাম এগুলো নিয়েই। রিকশায় রামগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড গেলাম। হেল্পারদের টানাটানি। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম
-সোনাপুর যাবেন?
-হ্যাঁ।
বলতেই ছোঁ মেরে আমার সেই ভারী ব্যাগটা টান দিয়ে গাড়িতে ওঠাতে গেলেই ব্যাগের তোড়া বাকিটাও ছিঁড়লো। ব্যাটা খ্যাঁক করে উঠলো
এতো ভারী ব্যাগ কেউ এমন করে নেয়! রিকশা থেকে নামার পথ আটকে আর একটা হেল্পার দাঁত কেলিয়ে জানতে চাইলো
-খালাম্মা কই যাইবেন?
-নামতে দিবেন তো!
-আফা কই যাইবেন?
দেখছেন অন্য গাড়িতে উঠছি, তবু ঘ্যানঘ্যান করেন! সরেন তো!
আমি আমার ব্যাগটা নামালে হয়তো ছিঁড়তো না। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো। আমি রাস্তার মাথা থেকে বাড়ি পর্যন্ত এটা নেবো কিভাবে! ওখানে রিকশাও সাধারনতঃ পাওয়া যায় না।
ট্যাবেই বুদ্ধদেব বসুর দশটি উপন্যাস ডাউনলোড করে দিয়েছে ফারাবী, ওটায় মন লাগাতে চাইলাম। মিলছে না। যেমন মেলে না গলার সা এর সাথে হারমোনিয়ামের সা। চোখ বইতে তো মন অন্য কোথাও।
দূরে কোথাও দূরে দূরে
আমার মন বেড়ায় ঘুরে ঘুরে
দূরে কোথাও দূরে দূরে
গলায় সুর তুলতে গেলাম, ওঠে না।
এদিক সেদিক তাকাই। নাহ্ কেউ মনে হয় খেয়ালই করে নি।
মনে হয় কিছু পাগলের ভাব আছে আমার ভেতর। নইলে এমন কেনো হয় যে পাবলিক বাসে গান গাইতে ইচ্ছে করবে! গলা খারাপ যে তা নয়। ঠান্ডা জল খেয়ে আর প্রাইমারী স্কুলে চিৎকার দিয়ে গলার তেরোটা বাজিয়ে রেখেছি যে!
বাবার পায়ে কখনও চামড়ার জুতা দেখি নি। এ ব্যাপারে কিছু বললে বলতেন
-নজর অতো নিচের দিকে দিতে নেই। ঈদ এলে বলতেন
-তোদের জাকাত ফিতরার টাকা আমায় দিস্, আমি এতিম। তোর মায়ের তো একখান স্বোয়ামী (স্বামী) আছে। আমার তো তাও নেই।
ইদানীং এমন সময় জাহীদ ভাইকে মনে পড়ে। তিনি বলেছেন
-আপনি বড় কমেডিয়ান হবেন।
কেন বলেছেন জানি না। তবে আমি হবো নয়, আসলে হয়েই আছি। পায়েপায়ে যার কান্না জড়ানো তার হাসি দেখে পটে যায় নি এমন মানুষ কমই জানি। বুঝতেই পারে না যে এই মায়াবী হাসি কেবলই নকল আর নকল। জাহীদ ভাই কে? সেটা বলবো না। তাঁকে অনেকেই চিনে ফেলবেন, সামান্য পরিচয় দিলেই।
-সোনাপুরের ভাড়া কতো?
-খালাম্মা, এইটাতো চৌমুহনী যাইবো।
-ফাইজলামি পাইসো তোমরা! আমি ওঠার সময়ই জিজ্ঞেস করে উঠেছিলাম, আমার সাথে ভারী বোঝা। আমি যাবো কি করে! যা ব্যাটা ভাড়াই দিমু না!
-খালাম্মা চেইতেন না। আমি আপনার ব্যাগ গাড়িতে উঠাইয়া দিমু।
-হ আর দিসো!
বকাঝকা করলেও ভাড়াটা দিয়েই দিলাম।
মাঝবয়সী মহিলা পাশে। অনর্গল কথা বলছে অহেতুক কৌতুহলে। সব কথার জবাব না দিলেও একটা দুইটা কথার জবাব দিচ্ছি খুবই বিরক্তিকরভাবে।
-দিদি, যাইবেন কই?
সোনাপুর না বলে বললাম -মাইজদী। মেয়েমানুষের মুখে এই নামটা শুনেও পুরুষ তপ্ত হয়। ওরা রাজার জাত। ওদের অনুতপ্ত হতে নেই। জন্মেই ওরা তপ্ত হবার জন্য। কিছু মেয়ে মানুষও ন্যাকার মতো মুচকি হাসে। অনেকেই এই গ্রামের নাম বলে ইজ্জতপুর। বলে আবার চোখ চাওয়া চাওয়ি করে। সন্ধ্যার পর ওরা এই নামটা বেশি ব্যবহার করে। তথাকথিত শিক্ষিত শ্রেণিও আছে এই তালিকায়।
-ক্যামন মিষ্টি চেহারা গো দিদির। ছেলেমেয়ে কয়জন? কী করে?
কথা বলতে বিরক্ত লাগছিলো। হুঁ হাঁ করে সারছিলাম।
-দিদির ফোন আছে নি গো?
-হুম। কেন গো?
-আহা হা যেমন মিষ্টি দিদি, তেমন তার ব্যবহার!
এতক্ষণে আসলে কথাটা বের হলো। মহিলার মেয়েকে সামনের একটা যায়গায় দাড়ানোর জন্য বলতে হবে। কি আর করা।
-দেন নম্বর।
তড়িৎগতিতে বের করলেন। ওটা হাতে নিতেই এতো মিষ্টতা। ডায়াল লিস্টে নম্বর উঠিয়ে ফোন তাঁর কানের কাছে নিতেই তিনি এমন ভাব করলেন যেন, জানালা দিয়ে বাইরে লাফ দিবেন। আমি মোবাইল সরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি হইসে? আমার ডর লাগে দিদি, আমনে কই দেন।

কই দিলাম। এবার তিনি নামবেন। তিনটা পোটলা। হেল্পার নামাচ্ছেন আর গজগজ করছেন। তিনি নামতে গিয়ে আরও বিপত্তি। সিন্থেটিক শাড়ি প্রচন্ড গরম।। এতোগুলি কাপড়ের বোঝা মেয়েদের ঘাড়েই চাপিয়ে দিলো। মুসলিম হলে তো কথাই নেই। পোশাক হবে আবহাওয়া অনুযায়ী আরামদায়ক। আর আমাদের মেয়েদের কি অবৈজ্ঞানিক পোশাক। কী আর করা!
তিনটা পোটলা। হেল্পার নামাচ্ছেন আর গজগজ করছেন। তিনি নামতে গিয়ে আরও বিপত্তি। শাড়ির অনেকাংশে খুলে পড়েছে। একটু পর তিনি নামবেন। নিজের শরীর বয়ে নিতেই যার কষ্ট। বাঙ্গালী মেয়েদের শাড়ীতেই সুন্দর লাগে এটা ঠিক। কিন্তু এর মতো যন্ত্রণাদয়ক পোষাক আর আছে কিনা জানি না। কোনো বিদেশী মেয়েকে শাড়ীতে কিন্তু ভালো লাগে না। সব আমাদের চোখের অভ্যাস মাত্র।
-দিদি, আমনে কই?
হেল্পার নামাচ্ছেন আর গজগজ করছেন।শাড়ি সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক পোষাক। যত্তসব অনাচার পোষাকের নামে!
মেয়েমানুষটি নেমে গেলে মনে মনে আমি আকাশ পাতাল কতো কী ভাবি! বয়স্ক মেয়েমানুষ, তবু এতো বড়ো বোঝা তাঁকে এখনও টানতে হয়। না জানি তরুণ বয়সে কতো বোঝাই না তাঁকে বইতে হয়েছে। সঙ্গে নিজেকেও মিলাই। আমারও তো কেবল বোঝা টানতেই জীবন গেলো। আমাদের দু’জনের জীবনে কতো মিল। কেবল বোঝা টানা! অথচ এই মেয়ে মানুষটির কাছে আমি কতো ভাগ্যবান। মনে মনে বোধ করি তিনি আমাকে ঈর্ষাই করেন। মেয়ের কাছে গিয়ে হয়তো গল্প করবেন… দেখেছি এক মহিলা, মোবাইল আছে দুইটা একটা বড়, একটা ছোট। কী জানি প্রযুক্তির যে ছড়াছড়ি তাতে ট্যাবের নাম জানলেও জানতে পারেন।
তিনি জানেন না তাঁতে আর আমাতে তফাৎ নেই খুব একটা। বমি ভেতরে নিয়েই যাপিত জীবন আমার। এই জীবনে একটা তুমি ছাড়া আমি তৃষ্ণায় ছটফট করি।
– শামা আরজু, লেখক, বাংলাদেশ।