সুহৃদ, গতকাল প্রবাদপ্রতিম সংগীত শিল্পী লতা মংগেশকারের মৃত্যুর পর দেখলাম, তোমরা বলছো, ইসলাম ধর্ম একজন বিধর্মীর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন সমর্থন করে না। তোমরা হয়তো ‘মদিনা সনদ’ বিশদভাবে পড়োনি। আমাদের মহানবী পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম মানব সভ্যতাকে অসাম্প্রদায়িক এই বিধান উপহার দিয়েছিলেন। এই মদিনা সনদ মদিনায় ইহুদি ও অন্যান্য ধর্মের মানুষের পূর্ণ অধিকার নিশ্চিত করেছিলো। এই সনদের আলোকে খলিফা হজরত আলী একটি মামলার নিরপেক্ষ রায়ে হেরে গিয়েছিলেন এক ইহুদির কাছে। এমনকী মহানবীর একজন ইহুদী কর্মী ছিলেন যিনি রান্নায় সহযোগিতা করতেন। ইহুদি পাচকের রান্না করা খাবার নবীজী খেতেন; আর তাকে পরিবারের অন্যান্য সদস্যের মতো সমান মর্যাদা দিতেন। এখানে আমরা একটা জিনিস শিখি মহানবীর কাছ থেকে; মানুষে মানুষে ধর্মের ভিত্তিতে বা আর্থিক সামর্থ্যের ভিত্তিতে বিভেদ না করা।
কেমন উম্মত তোমরা যে মহানবীর শিক্ষা ছেড়ে দুই ইটের মসজিদ গড়ে ফতোয়া দিচ্ছো।
এবার আসি সংগীত প্রসঙ্গে। আল্লাহতায়ালা হজরত দাউদকে সুর সৃষ্টির ক্ষমতা দিয়েছিলেন। আল্লাহ সংগীত ভালো না বাসলে নিজের প্রেরিত পুরুষকে সুর সৃষ্টির ক্ষমতা দেবেন কেন!
তোমাদের কন্ঠ দেখো এতোই বেসুরো যে একটু শ্রুতিমধুর করে আজানও দিতে পারো না। আল্লাহ নিশ্চয়ই কম ভালোবেসেছেন তোমাদের; যাদের কন্ঠে সুর নেই; বরং সুরের প্রতি বিদ্বেষ আছে।
লতা মাঙ্গেশকর মুসলমান ও হিন্দুদের বন্ধুত্বের ওপর গান গেয়েছেন; মানববন্ধনের আহবান জানিয়েছেন।
তোমরা লতার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছো, উনি হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদিকে সমর্থন করেছেন। মোদি অনাথ ছেলে, গরীব ছেলে; তিনি পরিবারতন্ত্রের অভিজাত শেকল থেকে ভারতের রাজনীতিকে মুক্ত করেছেন। লতা তাকে এজন্য পছন্দ করতে পারেন। আর লতা তো রাজনীতিবিদ নন, সংগীত শিল্পী। তাকে বিচার করতে হবে সংগীত গুণ দিয়ে।
তোমরাও তো ইসলামপন্থার সমর্থক, হিন্দুদের পাড়ায় হামলা করেছো, তাদের উচ্ছেদ করেছো; তোমরা খেয়াল করে দেখো; হিন্দু উচ্ছেদ করে তাদের বসত ভিটায় রাজার হালে আছো। মোদি ঠিক তোমাদেরই জমজ ভাই। সে মুসলিম উচ্ছেদ করেছে। মোদির হাতে মুসলমানের রক্ত; তোমাদের হাতে হিন্দুর রক্ত। মনে রেখো অপরাধের শাস্তি এ দুনিয়াতেও হবে, আখেরাতেও হবে। মোদি আর তোমরা; যারা অন্যধর্মের মানুষের প্রতি বিদ্বেষ প্রচার করো, তাদেরকে তো নরক বা দোজখের আগুনে পুড়তে হবে।
তোমরা গরীব ঘরের ছেলে, ধর্ম ব্যবসা করে ফর্সা জামাকাপড় পরে ঘুরছো। এই শখটাই মোদির হয়েছে, ধর্ম-ব্যবসা করে ফর্সা কাপড় পরা। মোদি আর তোমরা একই মুদ্রার দুই পিঠ।
খেয়াল করে দেখো তোমরা যেমন জনজীবন অচল করার ভয় দেখিয়ে সরকারের খাসজমি খাও; একই ভাবে ভয় দেখিয়ে কথিত প্রগতিশীল জনজীবন , ফর্সা পাঞ্জাবি পরে গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে ঘোরে উন্নয়ন বাজেট খেতে। তোমরা যেমন ওদের চাপাতি দিয়ে মানুষ হত্যা করেছো; ওরাও তেমনি ওদের এলিট ফোর্স দিয়ে ক্রসফায়ারে তোমাদের মেরেছে। তোমরা কিন্তু বাংলা মায়ের পেটের সহোদর। রাজনৈতিক বিভাজন ব্যবস্থার বলী তোমরা। তোমাদের নিয়ে জামাত বিএনপি খেলেছে, এখন আওয়ামী লীগ-হেফাজত খেলছে। আর তোমাদের প্রগতিশীল জমজ ভাইদের জীবন নিয়ে খেলে আওয়ামী লীগ ও এর কোলধরা বামেরা। বড় রাজনৈতিক দলের নেতারা নিজেদের ছেলেমেয়েদের বিদেশে রেখে পড়ায়; আর তোমাদের মতো অধিকার বঞ্চিত ছেলেদের কাউকে পাজামা-পাঞ্জাবি-টুপি পরিয়ে, কাউকে জিনস-টি শার্ট-হেলমেট পরিয়ে ফুট সোলজার বানিয়েছে।
তোমাদের জাদুটোনা করেছে জামায়াতের হুজুর, তোমাদের মতই হতভাগ্য জিনস টি শার্ট ভাইদের জাদুটোনা করেছে আওয়ামী লীগ-বিএনপি। কখনো দেখেছো কোন বড় হুজুরের বা বড় নেতার ছেলেদের লাশ হতে। অথচ তোমাদের লাশের বিনিময়ে উটের সওদা করে হেফাজতের হুজুর। তোমাদের মতো কষ্টমলিন জিনস টিশার্টদের লাশ দেখিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপি বার বার ক্ষমতায় গেছে। অথচ তোমরা সেই তিমিরেই রয়ে গেছো।
এমনকী হিন্দুত্ববাদী শিবসেনারাও তোমাদের মতো হতভাগ্য। এই ফেসবুকে তোমরা একজন প্রবাদপ্রতিম সংগীত শিল্পী লতার লাশ খুবলে খেলে। কত বড় গুণাহের কাজ, তা কী বোঝো! ঠিক একইভাবে শিবসেনারা কদিন আগে জীবিত কিংবদন্তীর গায়ক কবির সুমনকে কামড় দিলো। প্রবাদপ্রতিম কবি আল-মাহমুদের লাশ খুবলে খায় জিনস টিশার্ট প্রগতিশীলরা। ওরা আবার প্রগতিশীলতা মানে শিবসেনাশীলতা মনে করে।
যে মানুষটাকে গালি দিচ্ছো, একবার ভেবে দেখো, তার জুতোটার বাজার মূল্য তোমার চেয়ে কম না বেশি। আমি যেমন মনে করি লতা-আল মাহমুদের জুতার দাম আমার চেয়ে বেশি। নিলামে নিজেকে তুলে দেখো, দেখবে, লতা-মাহমুদের জুতার চেয়ে তোমাদের দাম কম।
– মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক
প্রধান সম্পাদক, ই সাউথ এশিয়া