২০২০ সালের ২১ মার্চ আমার জীবনে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি ঘটে যায়। আব্বা ১৭ মার্চ ফোনে বলেন, ঠিক যেমনটা চেয়েছি; তেমনি জীবন পেয়েছি। আমার নিজের শিক্ষকতার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। স্ত্রী-সন্তান-নাতিদের নিয়ে আমার আকাংক্ষা পূরণ হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা ছাত্ররা যোগাযোগ রাখে। তাদের জীবন বিকশিত হয়েছে; সেই বিকাশের মাঝে আমি রয়ে গেছি। এখন জীবনের ওপারে কী আছে; তা দেখতে সাধ হয়; পৃথিবীর গেট পার হয়ে নিঃসীম শুন্যতার জগতের মায়া টানে আমাকে। আমি বললাম, আশি রানেই ক্রিজ ছাড়বেন আব্বা, সেঞ্চুরি করলে কী অসুবিধা ছিলো! উনি অনেকক্ষণ হাসলেন, হাঁটতে হাঁটতে; হাসতে হাসতে গ্রিনরুমে ফিরতে চাই। আর তোমার লেখা ট্যুর গাইড “প্যাসেজ টু হেভেন” তো দু’বার পড়েছি। সমাজ-রাজনীতি-দর্শন নিয়ে তোমার এই শব্দের খেলা; বাক্যের হেয়ালি; ভাবনার ঋজুতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমাকে খুশি করতে তুমি সিভিল সার্ভিস-সাংবাদিকতা-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা; সবই তো করলে। ছোট ছেলেটাও ভালো মানবাধিকার গবেষক হয়েছে। ছিমছাম পেশা তোমাদের। যা করে আনন্দ পাও; সেটাই তোমার পেশা। আমার যেমন শিক্ষকতাই ছিলো প্যাশন। এখন বোঝোতো কেন আমি তোমার দাদার ব্যবসা-জমিজমার মোহরের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে গিয়ে জীবনানন্দ খুঁজেছি। ভালো থাকো। ভেবোনা, মিদ্রাহ’র ফাউন্ডেশন ঈশ্বরদীতেই তোমার আম্মা আর আমি তৈরি করেছি। ইংরজি-অংক-দর্শন শিখেছে; ফলে যা খুশী তা করতে পারবে সে। বাকিটা তো আল্লার ইচ্ছা।
তারপর.২১ মার্চ সকালে বাজার থেকে ফিরে বিছানায় একটু কাত হলেন। আম্মা তাঁকে ঈশ্বরদী হাসপাতালে নিয়ে গেলেন; অনুজপ্রতিম মানাম আব্বার কলিগের ছেলে; আম্মাকে সাহায্য করলো। আমার ছোট খালু
ফয়সাল জানালেন, তোমার বাবার স্ট্রোক করেছে। এম্বুলেন্সে বেহুলার মতো লখিন্দরকে নিয়ে রাজশাহী হাসপাতালের দিকে ছুটছেন যখন; আমি ফোন করলাম, আম্মা কথা বলতে পারলেন না স্বাভাবিক ভাবেই। আমার বড় মামা হিরু রাজশাহীতে হার্ট স্পেশালিস্টকে অনুরোধ করলেন, একবার আসতে। কিন্তু গরীব ঘরের ছেলে ডাক্তার হলে; স্বার্থপর হয়। ১৯৮৩ সালে আমার এমেরিকা থেকে দেশে বেড়াতে আসা মামাতো বোনকে নিয়ে রাজশাহী হাসপাতালে গেলে; বারবার ফোন করলেও এলো না নিষ্ঠুর ডাক্তার; বলে দিলো সে বৃহস্পতিবারের বিশেষ নামাজে আছি। আব্বা সকালে কোলে করে, ফারিহাকে সমাহিত করতে যাবার সময় কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, মেয়েটা মরতে এসেছিলো এই ভঙ্গুর চিকিতসা ব্যবস্থার দেশে।
আমার ডাক্তার বন্ধু শামীম ফোন করে করে; বন্ধুদের আব্বার শয্যাপাশে ডাকলো। তার বন্ধুরা এসেছিলো। কিন্তু স্পেশালিস্ট আসেনি। সরাসরি বলে দিলো, করোনাকালে এমন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাসপাতালে যেতে পারবো না। গরীবের ছেলে ডাক্তার হলে, বেতনটা হালাল করে খায়না। আর তার তো ক্লিনিক আছে; সেখানে করোনাকালে রোগী দেখতে আরাম। আওয়ামী লীগের নেতা গালি দিয়ে ফোন করলে ঠিকই এসব ঠ্যাঁটা ডাক্তার উঁজু হয়ে হাসপাতালে দৌড়ে আসে। কিন্তু দর্শনের অধ্যাপক আহসান উল্লাহ, যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে পাশ করে এসে অন্য সব “ক্ষমতার পদে”র অফার হেসে উড়িয়ে দিয়ে রামদিয়া শ্রীকৃষ্ণ কলেজ, ঈশ্বরদী কলেজ, পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ, সিলেট এমসি কলেজ, রংপুর কারমাইকেল কলেজে দর্শন-যুক্তিবিদ্যা-ইংরেজি পড়িয়ে; শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে টেনে এনে তাদের জীবন বিকাশের বন্ধু হয়েছেন; অবসরের পর ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য দর্শনের বই লিখেছেন, তিনি তো যে “গরীবের ছেলে” স্পেশালিস্ট হয়ে “বিরাট ডাক্তার” হয়েছে; তার মনোযোগ পাবেন না; সেটাই তো আজকের সমাজ বাস্তবতা।
বারবার গরীব ঘরের ছেলে ডাক্তার জাতীয় অপ্রিয় বাক্য ব্যবহার করার কারণ; আব্বা রাজশাহী হাসপাতালে “অবহেলা” পাবার কিছু আগে; করাচীতে আমার স্ত্রীর খালুর স্ট্রোক করেছিলেন। আমি বার বার বলেছি, মাসলোর হায়ারারকি অফ নিড পূরণ হয়ে বড় হওয়া সচ্ছল পরিবারের কোন ডাক্তারকে ডাকা হোক। গরীব ঘরের ডাক্তার ছেলে এতো বড় সাহেব; গভীর রাতে হাসপাতালে আসবে না। দৈবচয়নে ফোন করে ঠিক মিলে যায় আমার কথা। খালু বেঁচে যান। নিয়তিবাদীরা বলবেন ভাগ্যে ছিলো তাই বেঁচে গেছেন। কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়; রোগী বাঁচাতে চেষ্টা তো করতে হবে! তারপর ইটস আ ম্যাটার অফ চান্স।
সেই খালু আমার আব্বা চলে যাবার সংবাদে দ্রুত চলে এলেন আমার কাছে, বললেন, পিতা হারানোর শোক; এমন এক শোক; যা আজীবন থাকে। ভুলতে পারবে না। উনার আত্মার জন্য প্রার্থনা করো।
আমার মামাতো ভাই উতসব, ছোট মামা মিনার আর ছোট ভাই এঞ্জেল যখন আব্বাকে বড়াল নদীর ধারে সমাহিত করছিলো; আব্বার প্রিয় লোকালয়ে; তার জমিজমার জীবনের বন্ধুদের কাছে; ভালোবাসার আজিমউদ্দিন ভাই আরো কৃষক পরিবারগুলো; যাদের জন্য নদীর ঠিক ওপাশেই আব্বা একটা স্বপ্নের গ্রাম সৃজন করেছিলেন; নাতি মিদ্রাহকে নিয়েও যে গ্রামে গিয়ে আব্বা অনেক সময় কাটাতেন; সেই উষ্ণ মৌলিক মানুষদের প্রার্থনা সীমায় তাঁকে কবরে শুইয়ে দিচ্ছিলো; আমি তখন ফোনের এপাশে সব হারানোর বেদনায় ডুকরে কেঁদে উঠে স্মৃতির মেঘে বৃষ্টি নামাচ্ছিলাম। জীবনের সেরা বন্ধুর বিদায়ে পৃথিবী উথাল-পাথাল হয়ে যাচ্ছিলো; আর বার বার দুঃশ্চিন্তা হচ্ছিলো; আম্মা তো নিজের বাড়ি “দ্যুতি-অরণী” ছেড়ে নড়বেন না; কী হবে তাঁর!
এরপর ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস নিতে ফিরে স্তব্ধ হয়ে ছিলাম, ভয়েস অফ এমেরিকার আনিস স্যার ফোন করলে, অনেক চেষ্টা করে ভূ-রাজনীতির একটা শব্দ উচ্চারণ করতে পারছিলাম না। একাত্তর টিভির কমপক্ষে ২০ টি ফোন কল ধরিনি। কী বলবো শোতে গিয়ে; আমার মাথাতে কিছুই আসে না। দ্য এডিটর, ই-সাউথ এশিয়ার কাজ থমকে যায়। তুষার ভাই-বুলবুল-শামীম বার বার ফোন করে একটু জীবনানন্দ ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করে। আমি যেন কাফকার মেটামরফসিসের গ্রেগর সামসার মতো অসহায়। আমাকে আপেল ছুঁড়ে ধাক্কা দেয়ার মানুষটাই তো চলে গেছেন। আব্বা যে কাপুরুষতাকে অপছন্দ করতেন, সেই আত্মহত্যার ইচ্ছাও জেগেছে; সারাক্ষণ মাথার মধ্যে আম্মাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা। ঈশ্বরদীর সাংবাদিক আলাউদ্দিন ভাই, সাংস্কৃতিক নেতা হাসান ভাই বলছেন, আমরা আছি তো পাভেল। বন্ধু রনী, তার স্ত্রী আসমা সবাই আম্মার জন্য আছে। আর আম্মা তো কখনোই শুধু নিজেরটা নিয়ে ভাবেননি; পুরো কলেজ পাড়াকেই একটা সম্প্রসারিত পরিবার ভেবেছেন। প্রতিবেশী হাসেম মামা-মামী, রজব মামা-মামী, বন্ধু শফি ও তার স্ত্রী, মোজাফফর মামা, আম্মার স্নেহের সাবেক সহকর্মী শিক্ষক রত্না; সবাই আছেন। তাঁর তো নির্ভরতা কেবল রক্তীয়দের ওপর নয়; আত্মীয়দের ওপর; আত্মার বন্ধুদের ওপর।
কিন্তু আমার মন মানেনি; আমি জীবন যাপনের আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। স্যাটায়ারিস্ট সিমু বার বার আইডিয়া দেয়, জাগাতে চেষ্টা করে; বন্ধু জোবায়েন সন্ধি-কাকন রেজা ফোন করে একটু ফান করার চেষ্টা করে। বন্ধু কবি রাজু আহমেদ মামুন ফোন করে বলে, না লিখলে কী; আগের লেখাই ধাবমানে ছাপছি।
ঈশ্বরদী কলেজপাড়ার অনুজপ্রতিম স্বপন ফোন করে, কলেজপাড়া মসজিদে স্যারের জন্য দোয়া পড়ানো হচ্ছে ভাইয়া। আব্বার কলেজের সহকর্মী ফজলুল হক চাচা যার সঙ্গে স্টাফরুমে উনার বিতর্ক হতো; সেই হক চাচা বিছানাগত; কিন্তু আব্বার চলে যাওয়ায় মর্মাহত। আব্বা হক চাচা বিছানাগত হবার পর দৌড়াদৌড়ি করে উনার পেনশন যাতে উনার ছেলে প্রিন্স তুলতে পারে; সে ব্যবস্থা করেছেন আমার শৈশবের খেলার সাথি প্রিন্সকে সঙ্গে নিয়ে।
একদিন আম্মাকে ফোনে না পেয়ে বিচলিত হয়ে ফোন করি রনীকে; রনীর ফোন পেয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রিন্স পৌঁছে যায়; আম্মার কাছে। আমার ফোন পেয়ে অনুজপ্রতিম জুয়েল পৌঁছে যায়। ইন্টারনেট কানেকশন বিভ্রাটে আমি আম্মাকে পাচ্ছিলাম না; সেটা জুয়েল ফোন করে জানায়। সবার এই ভালোবাসার রিফ্লেক্স আমাকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক করতে থাকে।
আব্বা নিরাপোষ মানুষ ছিলেন, স্পষ্টবক্তা ছিলেন, কিন্তু তাঁর জীবনে কোন তিক্ততা ছিলো না। মৃত্যুর পর বোঝা গেলো উনি অজাতশত্রু ছিলেন। আব্বা সবসময় একটা কথা বলতেন, কারো সঙ্গে ভিন্নমত মানেই তিক্ততা নয়; সম্পর্ক ভেঙ্গে চুরমার করা নয়। নানান অভিমতের বৈচিত্র্যই তো জীবনের সৌন্দর্য। ভিন্নমত পোষণ হচ্ছে বিতর্ক বা সংলাপ। আর এই সংলাপই হচ্ছে সভ্যতার ভিত্তি।
– মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক
প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া