সুপোরী গালে দিয়ে ভস ভস করে কিছু পচা হিন্দু এইরকম ইতিহাসান দাদা হয়ে বিরাজ করেন আমাদের আড্ডাগুলোতে। ব্লগ আসার পর; আগে পত্রিকা যাদের লেখা ছাপার উপযুক্ত মনে করতো না; তারা ব্লগার হয়ে এইসব ন্যারেটিভের ঘুঁটের ডালি মাথায় নিয়ে ঘুরছে।
ব্লগের সেকুলার মানে তাকে এইরকম হীন ন্যারেটিভের প্রচারক হতে হবে যেন। মানে আপনাকে এই ন্যারেটিভের ভক্ত হলে, অসাম্প্রদায়িকতার পৈতে পরিয়ে দেবেন বলদাদা।
আমার শৈশব-কৈশোর-তারুণ্য কেটেছে, হিন্দু ধর্মের আত্মীয়-বন্ধুদের সান্নিধ্যে। আড়ানীতে ক্ষিতিশ মৈত্র আর আমার ছোট নানা মোমতাজ আহমেদ প্রতিবেশী ছিলেন, আম্মার দাদী ছিলেন, ক্ষিতিশ মৈত্রের মায়ের মতো । আমি আড়ানীতে গেলে ক্ষিতিশ মৈত্রের বাড়ি ছিলো আরেকটি নানা বাড়ি।
ঈশ্বরদী আব্বার সাংস্কৃতিক সক্রিয়তার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলেন উনার সহকর্মী অধ্যাপক নর নারায়ণ রায়। অধ্যাপক অরবিন্দ ঘোষ ছিলেন আব্বার থিয়েটারের সখা। আমি স্কুলে গেলে আব্বার কলিগ অসিত কাকার বাসায় টিফিন পিরিয়ডে যেতাম লাঞ্চ করতে।
স্কুলে বন্ধু পরিমল, সত্যজিত ছিলো প্রাণের সখা। ইউনিভার্সিটি জীবনের শুরুতে ভারতে পড়ার তাল তুলে কলকাতায় গিয়ে লাক্সমির সঙ্গে যে বন্ধুত্বের অধিক সখ্য; সেখানে হিন্দু মুসলমানের মাঝে জোর করে তুলে দেয়া বিভেদের প্রাচীর দেখিনি।
ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে কবি বন্ধু তাপস জগন্নাথ হলে নিয়ে গিয়ে লাঞ্চ করিয়ে ওর রুমে নিয়ে যেতো। ওর বিছানায় আমি সিয়েস্তা করতাম; আর ও টেবিলের সামনে বসে ওর লেখা নতুন কবিতা পড়তো।বিতর্কের প্রস্তুতিতে বিনায়ক সেন, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য যেভাবে অর্থনীতি শেখাতেন, নিজের অমূল্য সময় একজন তরুণের জন্য বরাদ্দ করতেন; সে কৃতজ্ঞতা আজো আমাকে আচ্ছন্ন করে।জার্মানীতে যাবার পর সুপ্রিয়দা, সঞ্জীব, উজ্জ্বলদা, অরুণদা, মহেশদা, চঞ্চল ছিলো; প্রাণের খুব কাছের মানুষ। সুপ্রিয়দা সরস্বতী পূজার অনুষ্ঠানে আমাকে মঞ্চে বসিয়ে দিতো এমনভাবে যে ছবি দেখলে কৌতুক বোধ হবে যে, আমি সেখানে পুরোহিত কীনা। আমি রোজা রাখলে, ইফতার জোগাড়ে দৌড়ে যেতো সঞ্জীব, প্রবাসের ঈদে ভালোমন্দ খাবার আয়োজন করতো সুপ্রিয়দা।
সেইসময় ভারত থেকে লেখক-কবি-সাংবাদিক যে-ই আসতেন, সুপ্রিয়দা আমাকে নিয়ে গিয়ে তাদের সঙ্গে জুড়ে দিতেন।
সুনন্দা রাও, মৃদুলা সিং, দেবারতি গুহ ছিলো জার্মানির জীবনের প্রাণদায়ী বন্ধু। দেশে ফেরার সময় বিমানবন্দরে আমাকে বিদায় জানাতে যারা এসেছিলো, ফারুক ভাই-মুনাযযা ছাড়া, সবাই আমার ভারতীয় বন্ধু।
জীবনের এই অনুপম সুন্দর অভিজ্ঞতার পর ব্লগে এসে দেখলাম জীবনের কুতসিত এক চেহারা। হিন্দুত্ববাদী কুলদাদুর সঙ্গে নিও সেকুলার কিছু কুদ্দুস সংস্কৃতায়ন, ঝুলে ঝুলে বলছে, নিম্ন বর্ণের হিন্দুরাই মুসলমান হয়েছিলো। বাঙালি মানে বাঙালি হিন্দু, বাঙালি মুসলমান নীচু জাত।
আমি এই প্রশ্ন নিয়ে গেলাম আমার স্ত্রী মুনাযযা ও বন্ধু সুনন্দা রাও-এর কাছে।
মুনাযযা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার মানুষ। সে বললো, তুমি তো আমার চেয়ে অনেক বেশি এভলভড।
রাজপুত সুনন্দা হাসতে হাসতে বলে, আজকাল কার কার সঙ্গে মিশো বলো তো! এসব ছাড়ো তো; চলো দেখা করি; কতদিন শিভা লাউঞ্জে যাইনা আমরা!
দক্ষিণ এশিয়ার ডিএনএ নিয়ে ডিএনএ এক্সপার্টদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলাম। এর আগে ২০০২ সালে মাল্টায় এক বৃটিশ রাষ্ট্রদূত ছিলেন ডিএনএ এক্সপার্ট, তিনিই শেকড় খুঁজে বের করার পদ্ধতিটি প্রথম শেখান আমাকে।
গোবরায়তনের নোংরা ন্যারেটিভে বিরক্ত হয়ে আবার নিজের ডিএনএ হয়ে শেকড়ের কাছে পৌঁছাতে বাধ্য হচ্ছি আমি।
এরকম পূর্ণাঙ্গ ডিএনএ গবেষণা ভারতে হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, আফ্রিকা, পারস্য, মধ্য এশিয়া আর ফার ইস্ট থেকে চারটি অভিবাসন ঢেউয়ে মানুষ এসে বসতি গড়েছে ভারতবর্ষে। তার মানে সান অফ দ্য সয়েল বলে কিছু নেই এখানে। তাহলে বর্ণ আসলো কোত্থেকে! উচ্চ বর্ণ-নিম্নবর্ণ এগুলো কী!
এই জায়গাটা ব্যাখ্যা করি, ভারতবর্ষে হিন্দু ধর্মের যারা ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হলো, ধরা যাক আওয়ামী লীগ, তারা বলে দিলো, যারা ফর্সা-উঁচা-লম্বা; এইগুলি উচ্চ বর্ণ; মানে ভি আই পি কালচারের স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি। সেইকালের ইতিহাসান দাদু মুনতাসির ফ্যান্টাসি লিখলো,ভারত গড়ে উঠেছে ব্রাহ্মণ লীগের শৌর্যে বীর্যে। ক্ষত্রিয়রা ভারতমাতার পাহারাদার হিসেবে ক্ষত্রিয় লীগ। বৈশ্যরা চাঁদা দিয়ে মন্দির প্রতিষ্ঠায় ভূ্মিকা রাখায় তারা টেকাটুকা লীগ।
কিন্তু বাকিরা ভারতের স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি; ওদের দলিত বানানো প্রয়োজন। ওরা নিম্নবর্ণ।
মুনতাসির ফ্যান্টাসিতে আসক্ত হয়ে সবাই দলিতের দলাই মলাই শুরু করে।
এইসময় মেভলানা রুমীর সূফি দর্শন গীতিকার গায়ক পাখিদের পরিব্রাজনে নৌপথে ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ মুক্তির বারতা পায় তাতে; সাম্যের আহবান পায়।
এই কোমল চিন্তাপথে ঢুকে পড়ে আরেক ভি আইপি দল; এরা মুসলিম শাসক। রোটি কাপড়া মকানের শ্লোগান দিয়ে এসে; আবার তারা আশরাফ সহমত ভাই গড়ে। তাদের ইতিহাসান ভাই, মজহার ফ্যান্টাসিতে নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের মুক্তির অগ্রসেনানী বলে গুনগান করে মুসলিম শাসকের। নিশান-ই-তারিখ পদক জিতে ইতিহাসান ভাই বিরাট ন্যারেটিভের ডিব্বা হয়ে পড়ে। উচ্চ নগরীতে থাকে তখন আশরাফ ভি আইপি। আর নিম্ননগরীতে চলে আতরাফের দলাই মলাই।
বৃটিশ এই ব্রাহ্মণ আর আশরাফদের বাহাদুর খেতাব দিয়ে উপনিবেশের গোড়াপত্তন করে; হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের ফাটল রেখার সুযোগে, দিল্লীর কোহিনূর নিয়ে গিয়ে লন্ডনে কুইনকে উপহার দেয়। ভারতবর্ষের দুর্নীতির টাকায় তৈরি হয় থাগস-দের সেকেন্ড হোম।
ঐ হিন্দু মুসলমান ফাটল পথে আর ব্রাহ্মণ-আশরাফ দ্বন্দ্বে ভারত ভেঙ্গে দুইখানা হয়। কংগ্রেস চায়, হিন্দু মুরগী থাকবে ভারতের খোয়াড়ে। মুসলিম লীগ চায়, মুসলমান মুরগী থাকবে পাকিস্তান খোয়াড়ে।
এর মাঝে পূর্ব বঙ্গ ছিলো সরল নদী মানুষের দেশ। এইখানে প্রথম হিন্দু জমিদাররা সাধারণ মানুষকে দলাই মলাই করে; টাকা চুরি করে কলকাতায় সেকেন্ড হোম বানায়। এরপর মুসলমান জমিদার সাধারণ মানুষকে দলাই মলাই করে, পিন্ডিতে সেকেন্ড হোম বানায়।
দুই জমিদার খেদিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও বিতাড়িত হিন্দু ও মুসলমান জমিদারের প্রেতায়িত আত্মা এইখানে ন্যারেটিভের প্রক্সি ওয়ার করে। তৈরি হয় গোবরায়তন। চলতে থাকে, গালাগালিভারস ট্রাভেলস।
মুনতাসির ফ্যান্টাসি বনাম মজহার ফ্যান্টাসি নিয়ে দৌড়া দৌড়ি করে দুইদল লোক। মুনতাসির ফ্যান্টাসির কাছে সংস্কৃতি মানেই হিন্দু সংস্কৃতি, মজহার ফ্যান্টাসির কাছে আবার সংস্কৃতি মানেই মুসলিম সংস্কৃতি।
এই “ফইন্নির ঘরের ফইন্নির” যুদ্ধের বাইরে, আমাকে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, রুমী। আমাকে মিলনের আহবান শুনিয়েছিলো লালন। আর হাসন রাজা বলেছিলো, যদি এই শ্বাপদ সংকুল ফইন্নি সাম্রাজ্যে তোমার ঘর বাড়ি ভালা না লাগে, ঘর বানাও শূন্যেরও মাঝার।
দক্ষিণ এশিয়া থেকে তাই আবার হাঁটতে শুরু করলাম রুমীর হৃদনগরীর দিকে। কনিয়েতে হৃদনগরীতে সাম্য চিন্তার বন্ধুত্বের আবাহনে শুনলাম জীবনের মন্ত্র, লিভ, লাফ এন্ড লাভ।