ছোট্ট এই হিউমারে উনি আমাকেও একটু সাহস জোগালেন।
এরকম হিউমারে আমি ছোট বেলা থেকে অভ্যস্ত। আমার নানা, আব্বা, আমার কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক রমজান আলী, ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, কর্মজীবনের দুই বস সাজাহান ফারুক ও আবদুল্লাহ আল ফারুক এমন রম্যের মানুষ ছিলেন।
ফলে বোরিং মানুষের সঙ্গে এক মিনিট কাটাতে দম বন্ধ লাগে। করাচীতে এসে এক বোরিং উপাচার্যের সঙ্গে বেশি সময় কাটানোর বোরডোমে; তাকে অবাক করে দিয়ে রিজাইন করেছিলাম।
এখানে আসার পর বাংলাদেশ থেকে দুজন অতিথি এসেছিলেন। শাহরিয়ার কবির আর ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন। তাদের সঙ্গে দেখা হবার পরে আমার স্ত্রী নিশ্চিত হয়েছে, রসিক লোক ছাড়া কেউ আমার জীবনে নেই।
ইদানিং ফেসবুকে যে সিনিয়র সাংবাদিক ভাইদের সঙ্গে আড্ডা দিই; তারা প্রত্যেকে সেন্স অফ হিউমারের ডিপো। হিউমারহীন সাংবাদিক; প্রায় অসম্ভব।
ইউরোপের সঙ্গে বাংলাদেশ কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার পার্থক্য এই অনায়াস হিউমারে। ইউরোপের মানুষ একটু রসিক হবার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করে। তবে ডয়চেভেলেতে যে জার্মান বস, ফ্রিডেমান শ্লেন্ডারের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো; উনি প্রাচ্য বিদ্যার ছাত্র ছিলেন, পিয়ানো বাজাতেন; আর বেজায় রসিক ছিলেন। নিজেকে কখনো ফরিদ কখনো শৈলেন্দ্র বলে পরিচয় দিতেন শ্রোতাদের সামনে।
ইউরোপের সুবিধা হচ্ছে, শ্লেন্ডারকে রস করতে দেখেই তার সহমত ভাই; একই রস করতেন না। সব জিনিস সবার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যায়না।
শেখ হাসিনা শেখ মুজিবের আদরের মেয়ে, মায়ের কড়াকড়িতে বড় হয়েছেন; তেল-পেয়াজ ছাড়াও রান্না শিখেছেন, গান গাইতে আর ছবি আঁকতে শিখেছেন। হাসিনা এতো সামাজিক যে, গাছের সঙ্গেও গল্প জুড়ে দেন, এই গাছ বল তো পদ্মা সেতুতে তুমি খুশি না অখুশি।
গাছ উত্তর দেয়, আমি তো ভয়ে থাকি; আবার কবে মোল্লারা ক্ষেপে গাছ কেটে নেয়! আমি তো গাছ; একমাত্র কেটে কাঠ চুরি না করলে ট্রাকে করে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যাওয়া হবে না আমার।
–গাছ তুমি কী বিএনপি নাকি জামাত, নাকি পাকিস্তান আমলের গাছ!
গাছ চুপ করে থাকে। মুদ্রা দোষের পিঠে গাছ কিছু বলেনা। মানুষ মাত্রেই মুদ্রা দোষ থাকে। গাছের থাকে না।
শেখ হাসিনা স্কুলের ঐ শিশুটি যে নিজে বুলি করে কিন্তু অন্য কেউ বুলি করলে ক্ষেপে ওঠেন।
অবশ্য লেখক হিসেবে এ অভিযোগ আমি বোধ হয় করতে পারিনা। শেখ হাসিনাকে নিয়ে স্যাটায়ার করে আমি দিব্যি ভালো আছি। অবশ্য এটাও হতে পারে। শেখ হাসিনার সেন্স অফ হিউমার আছে। ফলে উনি রম্যরচনা পড়ে আনন্দ পান। যেমন আনন্দ জওহরলাল নেহেরু পেতেন, তাঁকে নিয়ে আঁকা কার্টুন দেখে।
কিন্তু উনার যে পারিষদ, গৃহকর্মী; তারা যেহেতু দারিদ্র্যের অগম দুর্গম থেকে শেখ হাসিনার আশীর্বাদ পেয়ে নতুন ধনী হয়েছেন; তাদের জন্য শেখ হাসিনা হচ্ছেন ঈশ্বর। কারণ দক্ষিণ এশিয়ার হিন্দু-বৌদ্ধ ও ইসলাম ধর্মে যুক্তির পরিবর্তে আবেগ বেশি; সহিষ্ণুতার পরিবর্তে হিংস্রতা বেশী। ফলে রাজনীতিটা যখন ধর্মীয় আত্মপরিচয় হয়ে দাঁড়ায়; তখন সমাজে ডগম্যাটিক ডগ ফাইট চলতে থাকে।
সেই খানে শেখ হাসিনার হিউমার একটা রিলিফ। আপনাকে দলান্ধ ও জন্মান্ধদের ঘেউ ঘেউ শোনার পরিবর্তে টিভিতে, শেখ হাসিনা হিউমার শো দেখানো হচ্ছে; তবু আপনি অখুশী কেন!
আপনার হাছান মাহমুদের বিএনপি বিষয়ক বোরিং ব্যর্থ হিউমার, ওবায়দুল কাদের দেশপ্রেম অপেরার বিবেকের কান্না, রিজভীর আওয়ামী লীগ বিষয়ক বোরিং ব্যর্থ রস, মির্জা ফখরুলের সাদাকালো ছবির বাবা আনোয়ার হোসেনের আহাজারি, ইউটিউবের কলতলায় আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপির ডগফাইট; এইসবের চেয়ে শেখ হাসিনার সিট ডাউন কমেডি অনেক মনোহর।
খালেদা জিয়ার পদ্মা সেতু বিষয়ক কটাক্ষও হিউমারাস ছিলো। উনি লাইলাতুল ইলেকশন হিসাব না করে পদ্মা সেতু হাসিনার শাসনামলে শেষ হবে না; এরকম বলেছিলেন।
আর ইউনুস হচ্ছেন ক্লাসের ফার্স্ট বয়; নোবেল পদক নিয়ে বিশ্বভ্রমণ করে বেড়ান। এমন সুখের জীবন কজনের হয়। ক্লাসের মেয়েরা তাকে নিয়ে কটাক্ষ করার মাঝে দোষের কিছু নেই। ইউনুস নিজেও অত্যন্ত রসিক মানুষ।
শেখ হাসিনা তার সিট ডাউন কমেডিতে খালেদাকে পদ্মার পানিতে (যদি থাকে) টুস করতে চেয়েছেন। আর ইউনুসকে পানিতে চুবনি দিতে চেয়েছেন। ফাইনেস্ট হিউমার আর এক্সেকিউশন।
এই হিউমার বোঝার প্রস্তুতি লাগে, সারাদিন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ইসলামি চেতনা, হিন্দু চেতনা, বৌদ্ধ চেতনার দোয়াদরুদ পড়ে; আত্মপরিচয়ের গভীর সংকটে ম্রিয়মাণ লালসালুর গ্রামের লোকেদের পক্ষে রস বোঝা অসম্ভব কাজ।
যেহেতু দারিদ্র্যে বিশীর্ণ জীবনে ছোট বেলা থেকে নানাভাবে অপমানিত হবার অভিজ্ঞতা এসব ডগম্যাটিক সোসাইটির; ফলে তাদের সম্মান যাবার ভয়টিও বেশি। যার কিছু নাই; যার জীবনে ভালোবাসা নাই; সেই ভিখিরির একমাত্র আশ্রয় ধর্মীয় ও দলীয় অন্ন ও অনুভূতি। অন্ন ও অনুভূতি পরস্পর প্রবিষ্ট। যে ভাবে আল্লা-ভগবান অন্ন জোগায়; তার ধর্মীয় অনুভূতি প্রবল; যে ভাবে হাসিনা-খালেদা অন্ন জোগাচ্ছে; তার দলীয় অনুভূতি প্রবল।
রসবোধ সম্পন্ন কিছু মানুষ শেখ হাসিনার সমালোচনা করেছেন, তিনি ৫৭ ধারা আর ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট দিয়ে; তাকে নিয়ে হিউমার করা বন্ধ করেছেন; অনেকে গ্রেফতার হয়েছে, হাসিনা অনুভূতিতে আঘাতের দায়ে। অথচ মার্গারেট থ্যাচার বা আঙ্গেলা মেরকেলকে নিয়ে ক্যারিকেচার করে কেউ কখনো গ্রেফতার হননি।
শেখ হাসিনার বয়স ৭৫ অতিক্রম করেছে; তাঁকে যদি বলি সেন্স অফ এনটাইটেলমেন্ট বা এই দেশ আমার, আমার বাবা স্বাধীন করেছেন; অতএব আমি যা খুশি বলবো; এই অধিকার আমার এনটাইটেলমেন্ট; এমনটা ভাবলে তা খানিকটা অযৌক্তিক শোনায়। একবিংশ শতকে তো প্রজা নেই; সবাই নাগরিক, প্রত্যেকের সমান সম্মান। হিউমারের মানুষকে হতে হয় প্রতিপক্ষের হিউমার শোনার জন্য প্রস্তুত।