“যুদ্ধেআপনি পরাজিত হলে মারা যাবেন আর যদি আপনি বিজয়ী হোন তাহলে আপনাকে পরাজিতদের ধ্বংস করে দিতে হবে।”
আমার শ্রদ্ধেয় একজন ব্যক্তির নামে এই রকম একটা বাণী ছড়িয়ে পড়েছে দেখলাম। এই বাণী সমর্থনযোগ্য না। আমার বন্ধু অধ্যাপক আহমেদ শামীম প্রত্যুত্তরে যেমনটা বলেছেন, সেটাই সমর্থন করি: ছাত্ররা নিয়োগ দিয়েছে বলে তাদেরকে দুর্বুদ্ধি দেবেন না।
শেখ হাসিনাকে নিয়ে বাংলাদেশের খুবই উল্লেখযোগ্য একজন মানুষের একটা অভিজ্ঞতার কথা শুনেছিলাম মাস কয়েক আগে। ১৯৯৫ সালের কথা। পরিচিত একজনের বাড়িতে দাওয়াতে গিয়ে দেখলেন তখনকার বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে।
একটা মোড়ায় বসে তিনি কেশচর্চা করছিলেন আর উপবিষ্টদের সাথে কথোপকথন চলছিল। ঘন্টা দুয়েক হয়তো তিনি তার ওখানে ছিলেন। পুরোটা সময় জুড়ে শেখ হাসিনা একটাই কথা বলছিলেন, ক্ষমতায় গিয়ে অমুককে অমুক অমুককে মারতে হবে, অমুককে অমুককে অমুককে সাইজ করতে হবে, অমুককে অমুককে অমুককে একদম উৎপাটন করতে হবে, অমুককে অমুককে অমুককে…
তো শ্রোতা হিসেবে তিনি আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে গেলেন। তার ভাষ্যটা এরকম, দূর থেকে দেখে যেটুকু শ্রদ্ধা ছিল, একদম নাই হয়ে গেলো। এই মানুষটা তো দেশের নেতা হবার উপযুক্ত না! প্রতিশোধস্পৃহাই ছাড়া আর কোন সংবেদন নেই এর। ক্ষমতায় আসলে তার প্রধান কাজ হবে অমুক এবং অমুককে নিকেষ করা, আর তার জন্য যা যা করার তিনি করবেন। প্রতিশোধ নিতে এই মানুষ তো দেশের যে কোন স্বার্থ জলাঞ্জলি দেবেন!
এই গল্পটা আমার কাছে মূল্যবান লেগেছে। কিন্তু গল্পটার বাইরেও আমার কিছু কথা আছে।
ফ্যাসিস্ট আর স্বৈরতন্ত্রীর মাঝে অজস্র মিলের পরও একটা গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো এই যে, স্বৈরতন্ত্রী কেবলই নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চায়। ফ্যাসিস্টের আছে কিছু বাস্তব বা কাল্পনিক শত্রু, যাদের খতম করাকে সে প্রজন্মান্তরের দায়িত্ব মনে করে। ফ্যাসিস্ট মনে করে তার একটা আলাদা মতাদর্শ/জাতি/ধর্ম আছে, অন্য সকলকে তার অধীনস্ত হয়ে থাকতে হবে। স্বৈরাচার সুবিধাবাদী, ফ্যাসিস্ট এমনকি লম্বা বিচারে আত্মধ্বংসী।
জাতিদম্ভী প্রতিহিংসার রাজত্ব ফ্যাসিস্ট গড়তে চায়, কারণ সেটা তাকে ক্ষমতার জ্বালানি দেয়। কিন্তু ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে প্রায়ই মানুষ ফ্যাসিস্টের প্রতিহিংসার প্রবণতা নিজের ভেতরে জন্ম দেয়। এটা অস্বাভাবিক না, মানবিক বৈশিষ্ট্যই।
কিন্তু এই প্রতিহিংসার বৃত্ত রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য অত্যন্ত বিপদজনক। মহৎ রাষ্ট্রনেতা তিনিই যিনি এই বৃত্ত ভাঙার দায়িত্ব নিতে পারেন, আহবান জানাতে পারেন এবং সহকর্মী ও সঙ্গীদের এই হিংসার ফাঁদে পড়া থেকে প্রতিহত করতে পারেন।
এটা যদি না করা হয়, ফ্যাসিবাদ একদিকে আবারও সমাজে শক্তি ও সমর্থন জড়ো করতে থাকবে। অন্যদিকে, ক্ষমতা-ঘনিষ্ঠ কিছু দানব তৈরি হবে, প্রতিহিংসায় জ্বালানি সরবরাহ হবে যাদের বিত্ত ও প্রভাবের উৎস।
সেই ভীতিকর সম্ভাবনা কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি।
প্রতিহিংসার চক্র ভাঙার মানে কিন্তু সর্বদাই মনে রাখতে হবে, অপরাধের বিচারের সাথেও প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। ফ্যাসিবাদের দোসরদের সকলের বিচার হতে হবে। পূর্ণাঙ্গ বিচার ছাড়া কোন সমঝোতা বা পুনর্বাসন না। সেই অর্থে, ফ্যাসিবাদী বন্দোবস্তের পূর্ণাঙ্গ উচ্ছেদের দুটি অংশ থাকবে। একদিকে বিচার হবে, আরেকদিকে হবে একটা জাতীয় পুনর্গঠন প্রক্রিয়া।
– ফিরোজ আহমেদ, রাজনৈতিক সংগঠক ও বিশ্লেষক