আলী ইমরান: সীমিত সামর্থ্যের দেশ বাংলাদেশ করোনা মোকাবেলায় প্রথম থেকেই সব প্রস্তুতি আছে এরকম একটা আয়েশি ফর্মুলায় চলেছে। দেশের সর্ব মতের একটি কমিটিও করা হয়নি। হয়েছে শুরু থেকেই শুধু মন্ত্রী-আমলা-এমপি ও সরকার সমর্থিত ডাক্তার ও অনন্য পেশাজীবিদের নিয়ে করা হয়েছে কমিটি। যার ফলে প্রথম থেকেই দেখা গেছে একটা সমন্বয়হীনতা। তথাপি করোনা মোকাবেলার প্রথম দিকের পদক্ষেপে মানুষের সমর্থন ছিলো। যদিও সেটা ছিলো সাধারণ ছুটি রাষ্ট্র ঘোষিত বিশ্বের বাকি দেশের মত বাধ্যতামুলক লকডাউন না।
কিন্তু অল্প পরীক্ষার মাধ্যমে আইইডিসিআর প্রতিদিন বুলেটিনে হাজির হচ্ছে জনগণকে কয়জনের মৃত্যু হয়েছে সে তথ্যা প্রকাশ করতে। অন্যদিকে পোশাক কারখানা নিয়ে চলছে চোর পুলিশ খেলা! হঠাৎ করেই দেশের পোশাক কারখানাগুলো খুলে দেয়ার ঘটনা মানুষের মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে, ভেঙে গেছে ঘরবন্দি মানুষের ‘মনের লকডাউন’। এখন অনেকে রমজানে মসজিদ, ঈদ সামনে রেখে মার্কেটগুলো খুলে দেয়ারও দাবি তুলছেন। অবস্থা এমন, যেন কাল ভোর হলেই পুরো পৃথিবী স্বাভাবিক হয়ে যাবে!
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও ভাইরোলজিস্টরা বলছেন, লকডাউন শিথিল বা তুলে নেয়া হবে জাতির জন্য চরম আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দেশে চলছে অঘোষিত লকডাউন। আমাদের দেশে সরকারের তরফ থেকে এখন পর্যন্ত ‘লকডাউন’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। বরং বারবারই বলা হচ্ছে সাধারণ ছুটি।
কিন্তু চলমান অঘোষিত লকডাউনের এক মাসপূর্তির আগের দিন বিজিএমইএ-বিকেএমইএ পোশাক কারখানাগুলো খোলার জন্য বৈঠকে মিলিত হয় এবং তার পরের দিনই অর্থাৎ ২৬ এপ্রিল দেশের বিভিন্ন শহরের পোশাক কারখানাগুলো খুলে দেয়া হয়। কিন্তু কারখানাগুলো খোলার আগে যেসব ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছিল, তার কোন কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি বলে তথ্য পাওয়া যায়।
পোশাক কারখানাগুলো খোলার পরপরই বিভিন্ন পক্ষগুলো লকডাউন শিথিলের দাবি তুলতে শুরু করে। আসলে এ দাবির প্রস্তুতি বেশ কিছুদিন ধরেই নিচ্ছিলো এই গোষ্ঠীগুলো। কিন্তু তাদের সামনে কোনো উপলক্ষ ছিল না। কিন্তু পোশাক কারখানার মালিকরা সেই সুযোগ করে দিয়েছেন। এছাড়া লকডাউন নিয়ে মানুষের মধ্যে যে নিয়মানুবর্তিতা তৈরি হচ্ছিল, সেটাও ওই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গে ছেদ পড়েছে।
গত তিনদিন ধরে চট্টগ্রামের পরিস্থিতি সরেজমিন পর্যবেক্ষণ এবং দেশের গণমাধ্যমের সংবাদ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আগের চাইতে বেশি বাইরে আসছেন নগরবাসী। কারণে-অকারণেই তারা বের হচ্ছেন। পোশাক কারখানার কাজে যোগ দিতে হাজার হাজার মানুষ লকডাউন ভেঙে কাঁঠালবাড়ি-শিমুলিয়া ও দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাটসহ বিভিন্নভাবে রাজধানীতে প্রবেশ করছেন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আবার অনেকে রাজধানী ছাড়ছেন। যেখানে সামাজিক দূরত্বের বালাই নেই। কার্যত অঘোষিত লকডাউন অনেকটাই ভেঙে পড়েছে।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির বলেন, “এভাবে অপ্রস্তুত অবস্থায় পোশাক কারখানাগুলো খুলে দেয়ায় ভাইরাসের সামাজিক সংক্রমণের মাত্রা বেড়েই গেল। এভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। শুধু তা-ই নয় ‘ম্যাসাকার’ ঘটে যেতে পারে। বিষয়গুলো আমরা নির্ধারিত ফোরামে জানিয়েছি।”
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন শেখ ফজলে রাব্বি বলেন, ‘আমরা সরকারি সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো কথা বলতে পারব না। মানুষ বাইরে বের হলে ঝুঁকি তো থাকবেই। তাই স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। এর বেশি কথা বলা সম্ভব না।’
লকডাউন ডাউন
টানা এক মাস ধরে চলমান লকডাউন এখন কার্যত ভেঙে পড়ার উপক্রম। গণপরিবহন বাদে সব পরিবহন রাস্তায় নেমেছে। বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন সড়কে রিকশার যানজটও দেখা গেছে।
চট্টগ্রামের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেজ (বিআইটিআইডি) এর ল্যাবপ্রধান ও মাইক্রোবায়োলজিস্ট ডা. শাকিল আহমেদ বলেন, ‘চট্টগ্রামে সংক্রমণ শুরুর পর স্বাস্থ্য বিভাগ-মেট্রোপলিটন পুলিশ আক্রান্ত এলাকা লকডাউন করে এবং আক্রান্ত ব্যক্তিদের আইসোলেশনে পাঠিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। খেয়াল করলেই দেখবেন, এ কারণে নির্দিষ্ট কিছু এলাকা ছাড়া নগরের অন্যান্য এলাকাগুলো সুরক্ষিত ছিল। কিন্তু এখন ইপিজেডসহ পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমিকরা যে হারে আসা-যাওয়া করছেন, তাতে ভাইরাসের কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং করে সম্ভাব্য রোগীদের শনাক্তের কোনো পথ রইল না। এদের মাঝে কোনোভাবে একজন আক্রান্ত হলেই রোগটা ছড়িয়ে যাবে সারা শহরে।’
প্রসঙ্গত, গত ২৬ এপ্রিল থেকে চট্টগ্রামের ইপিজেডসহ ২৫৫টি পোশাক কারখানা খুলে দেয়া হয়েছে। এসব কারখানার কর্মরতদের অধিকাংশের বসবাস নগরের ইপিজেড থেকে পাহাড়তলী পর্যন্ত। সর্বশেষ গত বুধবার (২৯ এপ্রিল) ইপিজেড এলাকার বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) মেরিন ওয়ার্কশপের কর্মচারী (৫২) করোনা ‘পজিটিভ’ হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন। এর আগে বন্দর এলাকায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে এক নারীর মৃত্যু হয়। পাহাড়তলীতে এক গার্মেন্ট কর্মকর্তার পুরো পরিবার করোনায় আক্রান্ত হন। পোশাকশ্রমিক অধ্যুষিত পাহাড়তলী ও আশপাশের আকবরশাহ-হালিশহর থানা এলাকাকে চট্টগ্রামে করোনার সবচেয়ে বড় ক্লাস্টার হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগ।
করোনার জেরে লকডাউনে বহু দেশ, মানুষের সাধারণ জীবনযাপন আজ বিপন্ন। করোনাকে বাগে আনতে কোনো না কোনো ধরনের লকডাউনের খোলসে ঢুকে পড়েছে প্রায় ৮৭ শতাংশ বিশ্ব। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ লকডাউন পদ্ধতি বেছে নিলেও স্রোতের বিপরীতে গিয়ে হার্ড ইমিউনিটি পদ্ধতি গ্রহণ করতে দেখা গেছে সুইডেন, নিউজিল্যান্ডসহ প্রথম দিকে যুক্তরাজ্য-কেও। অবস্থাদৃষ্টে অচল হয়ে পড়া অর্থনীতি সচল করতে বাংলাদেশও সেই পথে এগোচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
কিন্তু ভাইরোলজিস্ট ডা. জাহিদুর রহমানের মতে, “‘হার্ড ইমিউনিটির তত্ত্ব’ কখনও-ই লকডাউনের বিকল্প হতে পারে না। এটি শুধুই ভাগ্য, একটি অন্ধকার ভাগ্য।”
শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় আরও ২ জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৭০ জন হয়েছে। এর বিপরীতে ১৪ জন জন সুস্থ হয়ে ওঠায় এ পর্যন্ত মোট ১৭৪ জন সুস্থ হয়েছেন।