স্ট্রেইট ডায়ালগ প্রতিবেদন: করোনার থাবায় স্থবির হয়ে পড়েছে সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতি। যার ধাক্কা এসে পড়েছে বাংলাদেশেও। এক মাসের লকডাউনে এরই মধ্যে চাপে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ। বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে চাপ পড়বে অর্থনীতিতে। এ অবস্থায় সরকারের নেয়া উদ্যোগে সুশাসন নিশ্চিত না হলে ঝুঁকিতে পড়বে করোনা পরবর্তী অর্থনীতি।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সৃষ্ট অচলাবস্থায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন দেশের কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ। এ তালিকায় আছে অন্তত কয়েক লাখ নরসুন্দর বা ক্ষৌরকার। তাদের মধ্যে রাজধানীর সেলুনগুলোর কর্মীরা পড়েছেন চরম দুর্দিনে। তারা বলছেন, দীর্ঘ সময় কর্মহীন থাকলেও সরকারি-বেসরকারি কোনো সহায়তা পাননি। ফলে পরিবার বাঁচাতে অনেকে রিকশা চালাচ্ছেন, ভ্যানে সবজি বিক্রি করছেন।
করোনাভাইরাস সৃষ্ট দুর্যোগে ঢাকার নিম্ন আয়ের মানুষ যে ভয়াবহ সংকটে পড়েছে সম্প্রতি এ চিত্র উঠে এসেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ (জেপিজিএসপিএস), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের এক গবেষণায়। এতে দেখা যায়, আয় উপার্জন থমকে গেছে ঢাকার এমন লোকজন ব্যাপক মানসিক চাপে আছে। ওই গবেষণায় যাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে ৫৮ শতাংশের আয় বন্ধ রয়েছে। আংশিক আয় আছে ২৯ শতাংশের আর আয়ের ওপর কোনো প্রভাব নেই ১৩ শতাংশের। উত্তরদাতা ৩৭ ভাগ বলছে, তারা প্রধানত ভাত, ডাল এবং আলু খেয়ে জীবনধারণ করছে।
রায়েরবাজার এলাকার হেমায়েতগাজী বস্তির বাসিন্দা হালিমা বেগম (৭০) পেশায় গৃহকর্মী। গত মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে করোনা আতঙ্কে তার গৃহকর্ত্রী কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। তখন মজুরি হিসেবে সামান্য যে মজুরি পেয়েছিলেন তা দিয়ে কোনোরকম সংসার সামলেছেন। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে তার হাতে কোনো টাকা নেই। ফলে কোনো বেলা খেয়ে আর কোনো বেলা না খেয়ে দিন কাটছে এ বৃদ্ধার। তিনি বলেন, ‘উপোসে দিন কাটতাছে বাজান। পানি খাইয়া রোজা রাখতাছি।’
বাংলাদেশ নরসুন্দর কল্যাণ সমিতি কেন্দ্রীয় পরিষদের হিসাবে, দেশে মোট নরসুন্দর বা সেলুনকর্মীর সংখ্যা ১০ লাখের কিছু বেশি। ঢাকা শহরে এ সংখ্যা ৫২ হাজার। এ ছাড়া গোটা দেশে প্রায় ৩ লাখ বিউটি পারলারকর্মী রয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ করেন। করোনাকালে কাজ না থাকায় দিন দিন পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠছে। কিন্তু তাদের জন্য পর্যাপ্ত সরকারি ত্রাণ যায়নি। ঢাকার অনেক কলোনিতে সিটি করপোরেশনের ত্রাণ গেলে জনপ্রতিনিধিরা ভোটার আইডি দেখে দুই-চারজনের বেশি দিচ্ছেন না বলে অভিযোগ তাদের।
দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা এখন প্রায় ৪ কোটি। সম্প্রতি এক গবেষণা প্রতিবেদনে পিপিআরসি ও বিআইজিডি জানায়, করোনা মহামারীতে দিন আনে দিন খায় এমন প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষের আয় বন্ধ হয়েছে। পরিবারের ব্যয়ভার বহনে হিমশিম খেতে হচ্ছে মধ্যবিত্তকেও।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গেল এক দশকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশ এগিয়েছে দেশ। তবে, বেড়েছে আয় বৈষম্য, গড়ে ওঠেনি উপযুক্ত মানবসম্পদ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ। তাই করোনার ধাক্কায় কিছুটা বেসামাল হতে পারে অর্থনীতি।
সানেম নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ২০১৯ সালে যেখানে সরকারি হিসেবে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০.৫ ভাগ, এই মুহূর্তে দারিদ্র্যের হার বেড়ে প্রায় ৪১ ভাগ হবে।
অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ বলেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষার সুযোগ দেয়া, ট্রেনিং দেয়া এই বিষয়গুলো যদি করা হয় তাহলে সুযোগের সুব্যবহার করা যাবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ অবস্থায় সরকারের নেয়া বিশেষ উদ্যোগগুলোতে সুশাসন নিশ্চিত করতে পারলে, অনেকটাই সহজ হবে করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলা।
যেমন আছে পরিবহন শ্রমিকরা
চট্রগ্রামের কাপ্তাই রাস্তায় গাড়ি চালান সোলাইমান বিগত ২০ বছর ধরে। কিন্তু বিগত এক মাস কার্যত তিনি গাড়ি চালাতে পারছেন না। যার ফলে তার বাসায় খাবারও জুটছে না বলে তিনি অভিযোগের সুরে বলেন, আমাদের বলে এত এত শ্রমিক সংগঠন, কিন্তু এই বিপদের দিনে এরা কই?
চট্রগ্রামের নিউমার্কেট রুটে বাস চালান নুরুল্লাহ, তিনি বলেন এই এক মাসে আমরা কি কষ্টে দিন পার করছি তা শুধু আমরা আর আমাদের খোদা জানেন। ঘরে খাবার নেই সামনে আসছে ঈদ। কি করবো এই অবস্থা কতদিন চলবে কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। আমাদের কওে ত্রাণও দেয় না কেও খোঁজ ও নেয় না।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে সারা দেশের প্রায় ৭০ লাখ পরিবহন শ্রমিকের জীবন। অথচ এসব শ্রমিকের কাছ থেকে কল্যাণ তহবিলের নামে প্রতিদিন ৭০ টাকা করে চাঁদা আদায় করেছে মালিক সমিতি। সেই তহবিলে বছরে জমা হওয়া প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, এই টাকার কোনো হিসাব নেই। বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে জর্জরিত পরিবহন খাতের মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। তারা পরিবহন খাতের চাঁদাবাজিতে মিলেমিশে একাকার। ফলে শ্রমিকদের ভ’য়াবহ দু’র্দিনেও পাশে নেই শাজাহান খান, মসিউর রহমান রাঙ্গা, শিমুল বিশ্বাস, ওসমান আলীর মতো পরিবহন খাতের নেতারা। শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের নামে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা চাঁদা আদায় হলেও করোনা ভাইরাসের এই চরম দু’র্দিনে শ্রমিকদের পাশে নেই নেতা নামধারীরা।