এক সময়ে যাদেরকে প্রগতিশীল বলা হতো, গত এক দশক ধরে তারা অনেকেই আলীগে যোগ দিয়েছেন।প্রতিক্রিয়াশীলদের ক্ষেত্রেও অনেকটা তাই হয়েছে। দীর্ঘদিন দল ক্ষমতায় থাকলে সেটা রাষ্ট্রের সমার্থক হয়ে ওঠে। দল ও রাষ্ট্রের সঙ্গে লেনদেন ছাড়া অনেকে বাঁচে না। সবার নাম ধরে বলার দরকার নেই। নানা কারণে জাতির উল্লেখযোগ্য কবি নির্মেলেন্দু গুণের নাম ধরে বলা দরকার। আমরা জানি, গত ২০/২৫ বছর ধরে বাংলাদেশ নামছে, দ্রত গতিতে। এই অধোগতির একটা লক্ষণ অধ্যাপক, ডাক্তার, রাজাকার, কবি, বুদ্ধিজীবী নানান সুবিধার জন্য বিভিন্ন দলে যোগদান করেছেন। এ পতন এই যুগের প্রবণতা, গুণ এর পক্ষে এর বাইরে থাকা সম্ভব হয়নি।
এদেশের কবিরা নেরুদা কিংবা নাজিম হিকমত নয়। বিশ্ব-ইতিহাসের বড় পাটাতনে দাঁড়াবার যোগ্যতা তাদের হয়নি। গুণ কিংবা মধ্যে যাদের মধ্যে প্রগতিশীলতা দেখা যায়, সেটা তারা তাদের যুগের নানান আড্ডা ও আবহাওয়া থেকে সংগ্রহ করেছেন, সেটা তাদের জ্ঞানচর্চা কিংবা চেতনার মৌলিক অর্জন নয়। ফলে এটা ঘোষনা করে বর্জন করাটাও তাদের জন্য কঠিন কিছু নয়। এর আগে আমরা কবি আল মাহমুদের ক্ষেত্রে দেখেছি- প্রগতিশীল ও সমাজতন্ত্রের এই কবি ঘোষণা দিয়ে ফিরে গেছেন ব্রাম্মণবাড়িয়ার মোল্লাবাড়িতে। সময় যখন নামে তখন অনেকেই যার যার আসল জায়গায় ফিরে যান।
গুণ অনেক আগেই ফিরতে চেয়েছিলেন, তিনি আ‘লীগের এমপি হতে চেযেছিলেন না? কিন্তু আমরা জানি, গোর্কি লেনিনের অনুরোধ প্রত্যাখান করে বলেছিলেন, আমি দলে যোগ দেবো না, দলে যোগদানের দরকার নেই। তিনি জানতেন, কবি লেখকের যে স্বকীয় সৃষ্টিশীল স্পেসটা দরকার সেটা দলীয় রাজনীতি করলে হয় না, তা যত মহৎ দলই হোক না কেনো। দল কথা বলে বড় জোর একশ-দেড়শ বছরের মেয়াদ নিয়ে, কবি-লেখককে বলতে হয় হাজার বছরের পরিধি ও প্রাঙ্গণে দাড়িয়ে। এমন ছোট দেশে অত বড় জায়গায় দাঁড়িয়ে লাভ কি? গুণ হয়তো এভাবেই নিজেকে বুঝিয়েছেন।
একটা কনস্টিটিউন্সিতে লাখ খানেক চোর-ডাকাত, জমি দখলকারী, ধর্ষকের সঙ্গে একজন এমপিকে ইন্টারএ্যাকশন করতে হয় প্রতিনিয়ত- সৎ অসৎ নানা রকম সম্পর্ক ঠিক রাখতে হয় এদেশে। গুণকে প্রত্যাখ্যান করে সে যাত্রায় আ‘লীগ বাঁচিয়ে দিয়েছিল। এবার তিনি স্বউদ্যোগে নিহত হয়েছেন। তাঁর ক্ষেতে এমনিতে এখন আর ফসল ফলছিল না বলে তিনি কি নিজের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন? এটা কেনো তাঁর জন্য জরুরী ছিল তা আমরা জানি না, তবে আন্দাজ করতে পারি।
আমার যখন দেখছি, কবি, মুক্তিযোদ্ধা, সমাজবিদ, বিচারক, সচিব দলে দলে সবাই দলে যোগ দিচ্ছেন এবং বাংলাদেশ ক্রমেই একা হয়ে পড়ছে, তখন গুণ যুগধর্ম পালনে তাঁর গুণের পরিচয় দিয়েছেন মাত্র। বিপ্লবীর মতো কবিরও বোধহয় দীর্ঘায়ু হতে নেই। আমরা হয়তো তাঁর হুলিয়া জাতীয় কবিতাগুলি পাঠ করবো, একইসঙ্গে বলবো, ভূপেন হাজারিকার বেলায় যেমন বলা হয়, দলে যোগ দেবার আগেই মানুষটা বোধহয় মারা গেলে ভালো হতো।
ড. শেখ বাতেন : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক