আহমদ ছফা তাঁর বুদ্ধি বৃত্তির নতুন বিন্যাস গ্রন্থের শুরুতে লিখেছিলেন যে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা এককালে যা বলতেন, ওটা সঠিক হলে আজ বাংলাদেশ হতো না! আমি ছফা ভাইয়ের একজন গুনগ্রাহী ও বন্ধু হিসেবেই নয়, তাঁর বিদ্যা-বুদ্ধির ও একনিষ্ঠতার একজন ভক্ত হিসেবে তাঁর এই কথার সাথে সম্পূর্ণ একমত! তবে, বাংলাদেশ বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে সব বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীরা, যাঁরা একসময় পাকিস্তানের পক্ষে আর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কথা বলতেন বা কলম ধরতেন, তাঁদের সবাইকে পাকিস্তানী দালাল বলার ধৃষ্টতা আমার নেই, ছফা ভাইয়েরও ছিল না I ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ আর ১৬-ই ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আর তাদের দেশীয় সহযোগীরা বাঙালিদের উপর যে নির্যাতন করেছিল, তার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আপামর বাঙালি মুসলমান যারা পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল বা সমর্থন করেছিল, তাদের পক্ষে পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে বাংলাদেশ বা আর কোনো স্বতন্ত্র দেশ সৃষ্টি করার কল্পনাও এক দুরূহ ব্যাপার ছিল I তবে যাঁরা ১৯৭১ সালের ২৫ই মার্চের পরেও পাকিস্তানের অখণ্ডতা বহাল রেখে বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিলেন তাদের কথা আলাদা!
পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করা বা পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ তৈরী করার পেছনে আবার দুটো প্রেরণা, উদ্দীপনা, এবং উদ্দেশ্য কাজ পড়েছে: একটা ছিল নীতিগত বা আদর্শগত উদ্দীপনা, আরেকটা ছিল সুযোগসন্ধানী বা সুবিধাবাদী উদ্দীপনা/অনুপ্রেরণা I একটু বুঝিয়ে বলি I যাঁরা পাকিস্তান বা বাংলাদেশের জন্য সর্বশেষ ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন, তাঁরা আদর্শের জন্য সেটা করেছেন, এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় I তবে যাঁরা বিশ্বাস করতেন পাকিস্তান ভাঙবে না, এবং জানতেন বাংলাদেশের সৃষ্টি একটা ন্যায়সঙ্গত ব্যাপার, তবুও তাঁরা নিতান্তই সুবিধাবাদী এবং অসৎ দালাল হবার কারণে, বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছেন I এই দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষদেরকেই, তাদের ভেতর অনেক বুদ্ধিজীবী ছিল, আমরা সুবিধাবাদী, দালাল, কবির চৌধুরী-মুনতাসির মামুন টাইপ বর্ণচোরা দালাল বলতে পারিI
আহমদ ছফার বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের উপর নানান কারণে অনেক ক্ষোভ ছিল, থাকাটাই স্বাভাবিকI আমিও এই সুবিধাবাদী, আত্মসম্মানহীন দালাল শ্রেণীর প্রতি প্রচন্ড ক্ষোভ, এবং ক্ষোভ ও ঘৃণা মিশ্রিত এক বিচিত্র অনুভূতি লালন করিI আপনারা অনেকেই হয়তো জানেন, থানার সবচাইতে দুর্নীতিবাজ/ঘুষখোর দারোগা যেখানে কমপক্ষে (আজকের বাজার দরে) ৫০ হাজার টাকার কমে ঘুষ গ্রহণ করবে না, করলেও আপনার পক্ষে কাজ করবে না, সেখানে বহু বুদ্ধিজীবী উর্ধতন কর্মকর্তার হাত-পা ধরে একটা ইনক্রিমেন্ট বা অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে একটা দুর্নীতি করতে দ্বিধাগ্রস্থ হবেন নাI কবির চৌধুরীর মতো একটা বদলির জন্য গভর্নর মোনেম খানের পা ধরা যেমন আত্মসম্মান বিক্রি করা অর্থাৎ ঘুষ প্রদান করা, তেমনি একটা ছোট্ট বা বড় সুবিধার জন্য টাকাপয়সা (বা নারী হলে ম্যান-ইজ্জত-সম্ভ্রম বিলিয়ে দেয়া) একই ধরণের দুর্নীতি বই কি!
তাই, এক কথায় বলা যায়, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের এক বিরাট অংশ দুর্নীতিগ্রস্থ, এবং তাঁরা দুর্নীতিকে কোনো অন্যায় বা অনাচার বলেও মনে করেন না I আমি আগেই বলেছি, আত্মসম্মান বা ইজ্জত-সম্ভ্রম লুটিয়ে দেয়া আর ঘুষ দেয়ার ভিতর কোনো পার্থক্য নেই! আর বুধদ্ধিজীবীদের এই ভীমরতি কোনো নতুন ব্যাপার নয়, এটা সর্ব যুগেই ছিল, কম আর বেশি! দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, চাকুরী ও ব্যবসা বাণিজ্যের স্বল্পতা বা এক কথায় জীবন ধারণের মানবৃদ্ধি সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষেরই নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটায় I
তবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বা রুটি-রুজির সংকট মানুষের নীতি বিসর্জনের একমাত্র বা প্রধান কারণ হতে পারে না I যদি তাই হতো, তাহলে বাংলাদেশের সকল আধ-পেটা খাওয়া, অতি দারিদ্র মানুষেরা সারা দেশে এক লুটপাটের রাজত্ব সৃষ্টি করতো! সবদেশেই, সর্বকালে লুটেরাদের কমপক্ষে ৯০% মানুষ আসে রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, আর বুদ্ধিজীবী শ্রেণী থেকে I ক্ষুধা বা দারিদ্র নয়, লোভ হলো দুর্নীতির সবচেয়ে বড় চালিকা শক্তি I আর লোভ বা লালসা অর্জনে বুদ্ধির প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি! এর মানে কিন্তু এই নয় যে অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীরাই চোর! জ্ঞান-বুদ্ধি মানুষকে নীতি, মহানুভবতা, ত্যাগ, সেবা, ও সততা শেখায় I তাই বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধির প্রাচুর্য থাকলেও, তারাই যে কোনো সমাজে সবচেয়ে সৎ জীবন যাপন করেনI তবে এর ব্যাতিক্রম আছেI আর এই ব্যাতিক্রমী, নীতিহীন, আত্মসম্মনাহীন,লোভী বুদ্ধিজীবী আর রাজনীতিকের খপ্পরে আজ বাংলাদেশI
আমি আরো কিছু ধুরন্ধর, কপট, মিথ্যুক, সুবিধাবাদী, ও চরম নির্লজ্য বুদ্ধিজীবী আর রাজনীতিকের কিছু অপকীর্তি আপনাদের সামনে তুলে ধরার আগে বলে নিচ্ছি, এদের অনেকেই, অতি অল্প টাকায় নিজেদের বিক্রি করে দেয়, বা এদের কেউ-কেউ এতটাই নির্বোধ যে ভবিষ্যতে একটা কিছু অনুগ্রহ পাওয়া যাবে এই আশায় এরা ক্ষমতাশালী ও ধনবানদের চাটুকারী আর দালালি করেI আপনাদের নিশ্চই মনে আছে, এক বা একাধিক সাংবাদিক, শেখ হাসিনার সুনজরে পড়ার জন্য তাঁর পক্ষে কতগুলো উদ্ভট গুজব সৃষ্টি করলো! আর তারা কেউই কাজটা এতো পারিদর্শিকতার সাথে করলো যে স্বয়ং অবৈধ প্রধান মন্ত্রী হাসিনা বিশ্বাস করে বসলো যে নোবেল পুরস্কারের একটা শর্ট লিস্ট প্রকাশ করা হয় (যেটা কোনোদিনই প্রকাশ্যে আসে না) এবং অন্তত দু’বার তার নাম সেই শর্টলিস্টের অন্তর্ভুক্ত হয়! একবার ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে তথাকথিত শান্তি চুক্তি সই করার পর, আরেকবার ২০১৭ সালে প্রায় দশ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেবার পর! দুটোই ভুয়া খবর, নির্জলা গুজব!
কিন্তু বাংলাদেশের কিছু চাটুকার বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, আর সাংবাদিক কিভাবে শেখ হাসিনার আরো ঘনিষ্ঠ হওয়া যায় সে চেষ্টায় মাঠে নেমে পড়লো! একজন পত্রিকা সম্পাদক (কিছুদিন হলো প্রয়াত) শেখ হাসিনার সামনে, টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে ঘোষণা করলেন যে, এইবার শেখ হাসিনার শান্তিতে নোবেল পাওয়া প্রায় নিশ্চিত! সাংবাদিকদের একাংশ হাসিনা কে কে বা করা “Mother of Humanity” খেতাব দেন করেছে, এটাও প্রচার করে! আমি কবির চৌধুরীর সামান্য একটা বদলির জন্য মোনেম খানের পা চেপে ধরা আর এই সাংবাদিকদের এ ধরণের চাটুকারিতার ভিতর কোনো তফাৎ দেখি নাI
এই জাতীয় বুদ্ধিজীবীরা বা রাজনীতিকরা স্বার্থের জন্য তাদের মান-সম্মানের প্রায় সর্বস্ব উৎসর্গ করতে আদৌ দ্বিধাগ্রস্থ নয়I ভালো কথা, এদের সংখ্যা কিন্তু বেড়েই চলছে! আমি আজ একজন চাটুকার কিন্তু দিনশেষে যিনি চোখ উল্টে দিয়েছিলেন, তাঁর কথা বলছিI তিনি খন্দকার মুশতাক আহমদI মুশতাক আহমদ. শেখ মুজিবের চাইতে বয়সে দু’বছরের বড় ছিলেনI একে অপরকে তুমি করে বলতেন! তাঁরা দুজনই আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাI বাংলাদেশ না হয়ে পৃথিবীর যে কোনো সভ্য স্বাধীন দেশ হলে জাতির পিতা হিসেবে শেখ মুজিবের পাশে আরো অনেকের সাথে তাঁর নাম থাকতো, যেমন আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে ওয়াশিংটন-এর সাথে আরো কয়েকজনের নাম সংযুক্ত ভাবে জাতির পিতৃবৃন্দ হিসেবে স্বীকৃত!
যাই হউক, খন্দকার মুশতাক আহমদ শেখ মুজিবের এতটাই বিস্বস্থ ছিলেন যে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চের সাংসদীয় নির্বাচনে শেখ মুজিব নিজের আগ্রহে পরাজিত মুশতাক আহমদকে ভোট রিগিং বা ভোট জালিয়াতির মাধ্যমে বিজিত ঘোষণা করেনI আরেকটি ছোট্ট ঘটনা বলছিI শেখ মুজিব প্রধান মন্ত্রী থাকা কালে তাঁর পিতৃ বিয়োগ হয়I আমরা টেলিভিশনে দেখলাম মুশতাক আহমদের চোখে পানির ধারা, আর তিনি এক পর্যায়ে নিজেই শেখ মুজিবের বাবার লাশ নিয়ে কবরে নেমে খুব যত্ন করে লাশটা শুইয়ে দিলেনI আমরা সবাই খুব অভিভূত হলাম, আর বলা বাহুল্য, শেখ সাহেব তো নিশ্চয়ই ভালোবাসায় আর কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত!
উল্লেখ্য, অবৈধ প্রেসিডেন্ট এরশাদের মা মারা যাবার পর তাঁর তথাকথিত প্রধান মন্ত্রী কাজী জাফরও একই ভূমিকা পালন করেছিলেন! সবচেয়ে মজার ব্যাপার যে কাজী জাফরের বাঁধভাঙা কান্নায় অনেকেই ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না যে কার মাতৃবিয়োগ হয়েছে, এরশাদের, নাকি কাজী জাফরের! যাকগে, মোসাহেবদের কান্নাকাটির কথা!
মোদ্দা কথা হলো রাজনীতিক (এরশাদ-হাসিনা-মুশতাক-জাফর) বা সুবিধাবাদী (কবির-মামুন টাইপ) বুদ্ধিজীবীর ভালোবাসা, দয়া-মায়া আর কান্না দেখে কারো এ সিদ্ধান্তে আশা উচিত নয় যে এরা আসলেই মনে-প্রাণে কাউকে ভালোবাসে বা কারো জন্য ভালো কিছু করতে চায়! এরা সব, শেখ মুজিবের ভাষায়, “চাটার দল”! যতক্ষণ স্বার্থ আছে, এরা শুধু পা জড়িয়ে ধরেই ক্ষান্ত নয়, দরকার হলে জুতার তলি চেটে দেবে স্বার্থ উদ্ধারে! নইলে কি মোশতাক আহমদ শেখ মুজিবের হত্যায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারতেন?
–ড. তাজ হাশমী
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, হিস্ট্রি এন্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ, কলেজ অফ সিকিউরিটি স্টাডিজ, হাওয়াই।
প্রাক্তন শিক্ষক, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিংগাপুর,
ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিটিশ কলম্বিয়া ( কানাডা),
আইইউবি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (বাংলাদেশ)।