রূপের বিভাবরী
সিনথিয়া আজকাল “ক্ষ্যাত পাবলিকে”র লকডাউন অমান্য করে করোনা সংক্রমণ বাড়ানোর হতবুদ্ধি দেখে অত্যন্ত ক্ষিপ্ত। সে ফেসবুকে মাঝে মাঝেই পোস্ট দেয়, এই অসচেতন মানুষের বুদ্ধিহীনতার জন্য আজ আমরা করোনা মোকাবেলায় ব্যর্থ হচ্ছি।
সেইখানে ফাইরুজ এসে মন্তব্য করে, এই বাঙ্গিদের নিয়ে বাঁচিনা। এরা আর মানুষ হইলো না। এরা নিজেরাও মরবে; আমাদেরও মারবে।
নিউজিল্যান্ড প্রবাসী সায়মা ভেংচি দিয়ে বলে, সার্ভস ইউ রাইট। কত করে বললাম তোরা নিউজিল্যান্ডে চলে আয়; এখন বোঝ ঠ্যালা। এই শোন; আজ রাতে জুম কনফারেন্স হচ্ছে। ইউনির বন্ধুরা অনেকেই যোগ দেবে। আমি তোদের দুজনকে ইনভাইট করবো। রেডি থাকিস; তোদের রাত ১২টায়।
সিনথিয়ার বুকের মধ্যে ধক করে ওঠে। ইনবক্সে গিয়ে সায়মাকে অনুরোধ করে, দোস্ত আইজকা আমারে মাফ কইরা দেওন যায়না!
–ক্যান কী হইছে থ্রেডিং করা হয় নাই; আপার লিপসে কী ইরানি রাজকুমারীর মতোন গোঁফ গজাইছে; ভ্রুগুলি কী বিচ্ছুর মতোন দেখাইতেছে?
সায়মা হাহাহাহাহা করতে থাকে। অন্যসময় ইনবক্সে হাহা লেখে। করোনার সময় চারটা হাহা বেড়েছে।
সিনথিয়া ফাইরুজকে হোয়াটস এপে কল করে, রুজ “পার্লার কী খুলছে নাকি!”
–ক্যান জুম কনফারেন্সে তোর ইউনির ক্রাশ রুশদী আইবো বইলা!
–দুষ্টুমি করিস না দোস্ত। একটু খোঁজ নিয়া জানা।
সিনথিয়া বার বার আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়; তার ওয়ার্ক ফ্রম হোম চাঙ্গে ওঠে। স্টাডি রুমে হাবি “ওয়ার্ক ফ্রম হোম” করছে।
সিনথিয়ার বিশ্বাস হয়না আয়নার দিকে তাকিয়ে; হিড়িম্বা রাক্ষসীর মতো দেখাচ্ছে চুলগুলো। সায়মা তার মনে ঢুকিয়ে দিয়েছে বিচ্ছু; সে এসে চোখের ওপরে ভ্রু হয়ে বসে আছে।
ফেসবুকের ইনবক্সে সে আবার সায়মাকে অনুরোধ করে, আজ আমারে বাদ দে দোস্ত।
–তা হইবো না দোস্ত। রুশদী রিকুয়েস্ট করছে; সিনথিয়া যেন অবশ্যই থাকে।
সিনথিয়া আবার ফাইরুজকে ফোন করে। ফাইরুজ ফোন ধরেই গান গেয়ে ওঠে, পার্লার খুইলাছেরে মওলা; পার্লার খুইলাছে; কানিজ আলমাস মাইজ ভান্ডারি পার্লার খুইলাছে।
সিনথিয়া দ্রুত গাড়ি চালিয়ে গিয়ে ফাইরুজকে তুলে নিয়ে পার্লারে পৌঁছায়। সেইখানে লম্বা কিউ। কিন্তু পুরোনো কাস্টমার বলে পার্লারের এক মেয়ে এসে বলে, দেখতেছি আপা কী করা যায়!
পার্লারের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে; ধোলাইখালে রিকন্ডিশন্ড গাড়িগুলিকে “পেইন্ট ইওর রাইড” চলেছে।
চুল কাটা শেষ হলে ফেসিয়াল, মেনি-পেডিকিওর, থ্রেডিং-এর কাজ।
পার্লারের মেয়েরা নিরলসভাবে বিউটি রিকন্ডিশনিং-এর কাজ করছে। যে মেয়েটা থ্রেডিং করছে; তার মুখটা শুকনো দেখে সিনথিয়া জিজ্ঞেস করে, কী রোজায় ধরছে নাকি!
–পরশুদিন করোনায় আমার ছোট ভাইটা মারা গেছে ম্যাডাম।
এরপর এক দীর্ঘ নীরবতা নেমে আসে। ওপাশে এলাকার যুবলীগ নেত্রী শাপলা আপার পেডিকিওর চলছিলো। শাপলা আপা পার্লারের মেয়েটাকে ধমক দিয়ে বলে, বিহারি নাকি তুমি; দেশের শত্রুতা করতেছো কেন! ভাই মরছে সর্দি-জ্বরে; আর তুমি বলতেছো করোনায় মরছে। মিথ্যা বলবানা। প্যাকেট কইরা পাকিস্তানে পাঠাইয়া দিমু। পাকি কুনহানকার।
পার্লারের মেয়েটির সুপার ভাইজার মালতী দিদি এসে শাপলা আপাকে বলে, ওকে মাফ করে দেন নেত্রী। ও আর কক্ষণো বলবে না ওর ভাই করোনায় মারা গেছে। আমার ভাইও জামাতের ক্যাডারের হাতে খুন হয়েছিলো। আমরা ধমক খেয়ে স্বীকার করে নিয়েছি, ওর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।
শাপলা আপা এমন কট মট করে মালতী দিদির দিকে তাকায়, যেন জল দিয়ে জ্যান্ত গিলে খাবে!
ফাইরুজ ঝগড়াটা থামায়। শাপলা আপাকে বলে, একটা মেয়ের ভাই মারা গেছে; সিমপ্যাথি না দেখাতে পারেন; ধমক দিয়েন না।
শাপলা আপা বিড় বিড় করে বলে, ঐ যে আইসা পড়ছে একজন সুশীল। অল্প দুঃখে তো আর সুশীল গো বামাতি কইয়া ডাকিনা।
সিনথিয়া বাসায় ফিরতেই তার হাবি বলে, এতো বড় লকডাউন গেলো; কই আমার জন্য তো একদিনও সাজলানা! আজ তোমার ক্রাশের সঙ্গে দেখা হবে বলে, রীতিমতো পার্লার থেকে সেজে এলে যে!
সিনথিয়া ধমক দেয়, গিভ মি আ ব্রেক সুজন। তোমার এই একই বক বক আর কতোদিন শুনবো। বেশি কথা কইলে আপামনিদের টিভি চ্যানেলে ফোন কইরা তোমার বিরুদ্ধে টকশো করামু কিন্তু। দেখবা ফেসবুকে কীরকম ট্রায়াল আর ট্রল হয় তোমার। হেই দিন আর নাইরে নাতি; হাবলা হাবলা হাতু খাইতি।
ওদিকে রুশদী বিপদে পড়েছে তার বিশাল টাকটি নিয়ে; চারপাশ থেকে কিছু চুল এসে পরিচর্চাহীন স্টেডিয়ামের মতো দেখাচ্ছে। সে ভয়ে ভয়ে গিয়ে ওয়াইফকে অনুরোধ করে; টাকের চারপাশের চুলগুলি কেটে দিতে।
ওয়াইফ হাতে তুড়ি দিয়ে বলে, দি আইডিয়া! মাথা ন্যাড়া করে ফেলো; দ্যাটস কুল। হলিউডের একশান হিরো ব্রুস উইলিসের মতো দেখাবে।
ওয়াইফ খুব যত্ন করে রুশদীর মাথাটা ন্যাড়া করে দেয়। জুম বৈঠকে তাকে দেখে মনে হয়; সে যেন আত্মীয়ের মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধের জন্য মাথামুণ্ডন করেছে।
ওদিকে সিনথিয়াকে দেখে রীতিমতো বলিউডের বিদ্যাবালানের মতো লাগছে।
অনেকদিন পর যেন ইউনিভার্সিটির দিনগুলো ফিরে এসেছে; অনেক আড্ডা হয়। একসময় ফাইরুজ আলাপ তোলে, অনেক হাহা হিহি তো হইলো, এখন শোনো সবাই, করোনার সঙ্গে সঙ্গে মঙ্গা ফিরে আসছে; আমরা বন্ধুরা যদি কিছু ফান্ড রেইজ করতে পারি।
সবাই রাজি হয়ে যায়। ফাইরুজ আর সিনথিয়া করোনাকালে মঙ্গার মানুষের হাতে সে বন্ধুত্বের হাতগুলো পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব নেয়।
জুম বৈঠক শেষ হলে সিনথিয়ার হাবি টিপ্পনি কাটে, ভার্চুয়াল ডেটিং কেমন হইলো বেগম!
সিনথিয়া হেসে বলে, আলেমপনা আমরা তো আপনাগো মতন সারাদিন হারেমের চিন্তায় মগ্ন থাকিনা। আমরা করোনায় যারা অভাবে পড়লেন; তাদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেবো বুঝলে; সে আলাপ ফাইনাল হলো আজ।
(ক্রমশঃ)
– মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক
Editor in Chief : E-SouthAsia