সেইসব রাজনীতিবিদকে ক্ষমা করা যাবে না; যারা মানুষকে মাতৃ-পিতৃভিটে থেকে উৎখাত করে।
করোনাকালের আয়নায় সোনালি যুগের মৃত্যুর খবর স্পষ্ট হলে ধরা পড়ে; সম্প্রতি প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। ঔপন্যাসিক দেবেশ রায় ১৯৩৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর বর্তমান বাংলাদেশের পাবনা জেলার বাগমারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সংগীত পরিচালক আজাদ রহমানের জন্ম ১৯৪৪ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায়।
এই বাংলাদেশ বিভাগের ফলাফলের ছবি দেখার পর; ১৯৪৭-এর বাংলাদেশ বিভাজনের মূল খলনায়ক যারা; তাদের কোন সৃকৃতিতে ফুল দেই আমরা! কোন সে আদর্শের গল্প; যা আমরা মুখে সুপারি পুরে টিপে টিপে বলি; কিংবা চোখ গোল গোল করে শুনি।
একজন মানুষের উন্মূল উদ্বাস্তু হবার চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি আর কী হয়! ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ অগাস্টে সাধারণ মানুষ যারা শতবছরের তিল তিল পরিশ্রমে একটা গৃহ গড়ে তুলেছিলো; তারা জেনেছিলো এ গৃহে থাকার নিরাপত্তা আর নেই।
নেহেরুর কংগ্রেসের লোকেরা পশ্চিমবঙ্গ এঁকে নিয়ে সেখানকার মুসলমানদের ঘরে ঘরে খবর পাঠিয়েছিলো; পূর্ববঙ্গ হচ্ছে মুসলমান কবুতরের খোপ; তোমাদের সেইখানে ঢুকে পড়তে হবে। আর জিন্নাহর মুসলিম লীগের লোকেরা পূর্ববঙ্গ এঁকে নিয়ে সেখানকার হিন্দুদের ঘরে ঘরে খবর পাঠায়; পশ্চিমবঙ্গ হচ্ছে হিন্দু কবুতরের খোপ; তোমাদের সেইখানে ঢুকে পড়তে হবে। এরকম নৃশংস রাজনীতির উত্তরাধিকারই হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার আজকের রাজনীতির ক্যানিবালিজম।
মানুষের জীবন, তার অনেক স্বপ্নের গৃহ, স্বজনের বন্ধন; এগুলো ১৯৪৭ সালের রাজনীতিকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না। সেই খল রাজনীতির খুনে সন্তানরাই আজকের দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির মহাজনেরা।
আজকের বিভীষিকাময় করোনাকাল শুরুর কিছুটা আগে গত ২১শে মার্চ; আমি আমার জীবনের প্রথম ট্র্যাজেডির মুখোমুখি হয়েছি। আমার আব্বা চলে গেলেন; অসুস্থতার বিন্দুমাত্র লক্ষণ ছাড়াই।
ষাটের দশকে কলকাতা দাঙ্গার সময় তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের ছাত্র ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ দিকে কলকাতা দাঙ্গার রাতে কারমাইকেল হোস্টেলের ছাদে কাটিয়েছিলেন অন্যদের সঙ্গে। বিভিন্ন ঘর থেকে আলমিরা-টেবিল-বেঞ্চি এনে সেই ছাদের যাবার সিঁড়ি আটকে রাখা হয়েছিলো যাতে খুনে দাঙ্গাকারীরা সেখানে উঠতে বাধা পায়। চারদিক থেকে মানুষের মৃত্যু চিৎকার ভেসে আসছিলো। আমার আব্বা মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছিলেন মৃত্যুর। সেই সারা রাতের বিভীষিকায় ২৪ বছর বয়সের সেই তরুণের মনে হয়েছিলো, খুনে দাঙ্গাকারীদের ধারালো অস্ত্রে আজ রাতে যদি মৃত্যু না হয়; এমন কোথাও চলে যাবো; যেখানে আর কিছু নয়; একটু স্বাভাবিক ভাবে মৃত্যুর নিশ্চয়তা থাকবে।
সৌভাগ্যক্রমে সে কাল রাত অতিক্রান্ত হয়েছিলো। সকালে হোস্টেল স্যুপার পরামর্শ রাখেন, পারলে কোনভাবে বাড়ি চলে যাও। গত রাতে বেঁচে গেছো বলে আজ রাতে যে বাঁচবে এমন কোন নিশ্চয়তা যে নেই।
কারমাইকেল হোস্টেল থেকে বেরিয়ে হেঁটে যাবার সময় রাস্তায় লাশ পড়ে থাকতে দেখেন তিনি; ট্রামে চড়ে যাবার সময় চারপাশে রক্তাক্ত লাশ চোখে পড়ে।
এরপর বহরমপুরগামী ট্রেনে চেপে একটা খবরের কাগজ কিনে মুখ ঢেকে রাখার জন্য খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তা পড়ার অভিনয় করেন। পরনে ধুতি থাকায় খুনে দাঙ্গাকারীরা ট্রেনে উঠেও তাকে সন্দেহ করেনি। যাদের মুসলমান মনে হয়েছে; তাদের নামিয়ে নিয়ে গেছে ট্রেন থেকে। ট্রেন বহরমপুর পোঁছানো পর্যন্ত এই পুরোটা সময় কেটেছে জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি ভীতিপ্রদ স্নায়ুচাপে।
বহরমপুর পৌঁছালে আমার দাদার বাসের ব্যবসার অংশীদার ও বন্ধু মহেশবাবু আব্বাকে একটি বাসে করে তার বাড়ি সাহেব নগরে পৌঁছে দেন।
বাড়ি পৌঁছেই আব্বা দাদাকে জানিয়ে দেন তার দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত। দাদা তাকে বুদ্ধি দেন, অনার্স-মাস্টার্স যখন হয়েছে তখন লন্ডনে গিয়ে বার এট ল পড়তে। দাদা এ ব্যাপারে কিছু প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। কিন্তু ছাত্রজীবন থেকেই আব্বার ছিলো ছাত্র পড়ানোর নেশা। আর পাকিস্তানের উপনিবেশের অধীন বাংলাদেশে তখন কলেজে পড়ানোর অফুরন্ত সুযোগ। আমার দাদির বাড়ি যেহেতু কুষ্টিয়ায় সে কারণে আব্বার সিদ্ধান্ত নেয়া কিছুটা সহজ হয়ে যায়।
দাদা তার সাহেবনগরের বাড়ি-ব্যবসা-স্বজন ফেলে অন্য কোন দেশে যাবার কথা কখনো কল্পনা করেননি। এই প্রথম আব্বা গৃহত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলে কয়েকপুরুষ ধরে গড়ে ওঠা পিতা-পুত্রের উষ্ণ বন্ধনের বাড়িটি ভেতরে ভেতরে খালিদালান হয়ে গেলে; দাদা তখন ভেতরে ভেতরে একা হয়ে যান। পদ্মা নদীর ধারে খুব ভোরবেলা ছেলেকে নৌকায় তুলে দিয়ে নৌকাটা একটু ঠেলে দিয়ে দাদা বলেছিলেন, আহসান তোকে ভাগ্যের ভেলায় ভাসিয়ে দিলাম। দুজন দুজনের দিকে ততক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন যতক্ষণ দৃষ্টিসীমা অশ্রুবিন্দু হয়ে বাষ্পে মিলিয়ে না যায়।
আমি আব্বাকে বার বার জিজ্ঞেস করেছি, দাদা যেখানে প্রতিষ্ঠিত মানুষ; কংগ্রেস ও বামপন্থীদের পৃষ্ঠপোষক ব্যবসায়ী; এখনো দাদার বড় ভাইয়ের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিরা যেখানে ভালোই আছে; আপনি কেন চলে এলেন।
আব্বা ঐ একটাই কথা বলতেন, দাঙ্গার রাতের কারমাইকেল হোস্টেলের ছাদের সেই মৃত্যু বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার পর আমি একটা স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চেয়েছিলাম মাত্র। চেয়ে দেখো, যেহেতু শিক্ষক ছিলাম; ছাত্রদের ভালোবাসায় কী সুন্দর একটা জীবন কাটালাম।
বাংলাদেশে যেহেতু আব্বার মায়ের বাড়ি আর পরে স্ত্রীর বাড়ি; ফলে স্বজনের অভাব তার হয়নি। এ অভাব কোন মানুষেরই হয়না। কিন্তু নিজের গৃহ ত্যাগে বাধ্য হবার যন্ত্রণা মানুষ কখনোই ভুলতে পারেনা।
শিক্ষকতা থেকে অবসর নেবার পর আব্বা; সারাক্ষণ টিভিতে কলকাতার নাটকের সিরিয়াল দেখতেন। আর দুপুরে শুয়ে শুয়ে স্মৃতির ভেলায় চড়ে চলে যেতেন; সাহেবনগরে তার বাড়ির পড়ার ঘরটিতে; যার জানালা খুললেই সবুজ আমবাগান। সেই আমবাগানের পথ ধরে একটি কিশোর হাঁটতো। এটাই আব্বার জীবনের স্মরণীয় স্মৃতির ঘর; যেখানে গেলে সবচেয়ে শান্তি পেতেন।
রাজনীতিবিদরা জাতীয়তাবাদ, সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্র, সংবিধান, গণতন্ত্র, উন্নয়ন, জিডিপি গ্রোথ; ইত্যাদি বিরাট বিরাট বিষয় নিয়ে ভাবেন তো; আর সৃষ্টিকর্তা তাদের যেহেতু দেশপ্রেমের মনোপলি ব্যবসা দিয়েছে; তাই মানুষ; তার জন্মস্থান, বসতবাড়ি, স্বজনের বন্ধন এসব ছোট খাট বিষয় তাদের মাথায় আসেনা। আর ধর্মপ্রেম ও দেশপ্রেমের দালালির ব্যবসার ফড়িয়ারা যেহেতু রীতিমত অস্ত্র ও পেশি নিয়ে ঘুরে; ফলে মানবতা বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা পূজনীয় হয়। ইতিহাসের পুরুত ঠাকুরেরা আবার চোখ বুঁজে মন্ত্র পড়ার মতো “উচ্ছেদের রাজনীতির মহাপুরুষ”-দের জন্য বন্দনাগীতি রচনা করে।
আমার আব্বা ঠিক এ কারণেই দাদার মতো কোন রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষক হতে যাননি। উনি বলতেন, আমি জানি কীকরে ছাত্র পড়াতে হয়; কীকরে তাকে দেশের সেবায় অনুপ্রাণিত করা যায়। সাধারণ মানুষের দুঃখ লাঘবে সক্রিয় নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা যায়।
কলকাতা দাঙ্গার রাতে কারমাইকেল হোস্টেলের ছাদের বিভীষিকার স্মৃতি, আবার একাত্তরে পাকিস্তানের দখলদার বাহিনীর ভয়ে স্ত্রী আর কোলের সন্তান নিয়ে গ্রামে গ্রামে পালিয়ে বেড়ানো; এসময় স্ত্রী তাকে এও জিজ্ঞেস করেছিলো, মিলিটারির ভয়ে মেয়েরা মাথার চুল কেটে; নিজেকে যতটা পারা যায় অসুন্দর করে ফেলছে; আমিও কী তা করবো? তারপর আর জীবনের ঝুঁকি না নিয়ে ভারতে চলে যাওয়া; ফিরে এসে দেখা; বাসাটা লুট হয়ে গেছে। রাজনীতির জুয়াখেলা এইভাবে তাকে বার বার বিদীর্ণ করেছে।
এরপর আব্বা অনেক মনোযোগ দিয়ে ঈশ্বরদীতে একটা বাড়ি বানিয়েছেন; ইচ্ছাটা যেন, সেই সাহেব নগরের বাড়ির যত কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া যায় তাকে। আমি জিজ্ঞেস করতাম, আপনাদের দুজন মানুষের জন্য এতো ঝামেলা করার দরকার কী! কিন্তু আম্মা এই ঝামেলাটা হতে দিয়েছেন। উনি উপলব্ধি করেছেন; এ আর কিছু নয়; রাজনীতির নরভোজি খেলায় ঘর হারানোর বেদনার প্রশমন; এর নাম দ্যুতি-অরণী। ঝড়ের সময় গাছের শুকনো ডালে ঘষা লেগে যে আলোর আগুণ জ্বলে ওঠে; অরণ্য দীপিত হয়।
– মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক
Editor in Chief : E-SouthAsia