কবি ও কথা সাহিত্যিক আনিসুল হকের করোনাকালের কবিতা “ইশতেহার”-এ উনি বিশ্বের নানাদেশের নেতাকে দায়ী করেছেন মানুষের দুর্দশার জন্য। কিন্তু ভুল করেও স্বদেশের নেতার নাম মুখে আনেননি। একজন আলোকিত কথা-সাহিত্যিকের মাঝে এই যে, “গোটা দুনিয়া বদমাইশ আর আমরা সাধু”– এ জাতীয় মনোভঙ্গি; একে বলা হয় ডিনাইয়াল বা অস্বীকার প্রবণতা; ভাবখানা এমন; “আমার কোন দোষ নাই; সব দোষ অন্যের”।
আনিসুল হক লিখছেন, “ট্রাম্প, আপনি কি জানেন, হাজার হাজার আমেরিকানের মৃত্যুর জন্য আপনি দায়ী?”
ঠিক আছে আমেরিকানের মৃত্যুর জন্য ট্রাম্প দায়ী। নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট; সুতরাং আমেরিকানের মৃত্যু দায় ট্রাম্পকে বহন করতেই হবে।
মি হক লিখছেন, “জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, আপনি কি জানেন, আপনার মহাব্যর্থতাই দায়ী দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়া এই মারণ-ভাইরাসের জন্য?”
জাতিসংঘ মহাসচিবকে দায়ী করে, মৃত্যু আমাকে নেবে জাতিসংঘ নেবে না জাতীয় কবিতা আমরা পড়েছি। সুতরাং আনিসুল হক জাতিসংঘ মহাসচিবকে দায়ী করতেই পারেন তার কবিতায়।
কবি আরো লিখছেন, “বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড, আপনি কি জানেন, মানুষের এই অশ্রু আর্তনাদ আতঙ্কের জন্য আপনি দায়ী? ”
ছোট বেলায় আমরাও কথায় কথায় বিশ্বব্যাংক-আইএম এফকে বকা দিতাম। সুতরাং কবির সহমত ভাই হতে এ পর্যন্ত আপত্তি নেই।
কবি লিখেছেন, “কিম, আপনি কি জানেন মুন, আপনি কি জানেন লি, আপনি কি জানেন আবে, আপনি কি জানেন বরিস, আপনি কি জানেন আপনারা প্রত্যেকে মানুষের চোখে এনেছেন অশ্রু মনে এনেছেন ভয় আত্মায় এনেছেন অসুখ।”
কবিতায় উত্তর কোরিয়ার কিমের আগমনে পাঠক হিসেবে আমি উল্লসিত। তার মিম ছাড়া ফেসবুকে একটি দিনও কাটেনা আমাদের।
কবি লিখছেন, “এখন ভেন্টিলেটর কেনার টাকা নেই! পিপিই কেনার টাকা নেই নিউইয়র্ক হাসপাতালে। ডাস্টবিনের ব্যাগ গায়ে জড়িয়ে কাজ করছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা!”
ভেন্টিলেটরে স্বয়ং সম্পূর্ণ বাংলাদেশের কবি অবশ্যই এ কথা গর্ব করে বলতে পারেন।
কবি বলেন, “মোদি, আপনার পরমাণু বোমার এক বছরের বাজেট দিয়ে আপনি ভারতের প্রতিটি মানুষকে দিতে পারতেন পানীয়জল।”
অত্যন্ত সহি বচন। মোদি খলনায়ক। উনি ভারতের মানুষের দুর্দশার জন্য দায়ী।
কবি কহেন, “ইমরান খান, আপনার পরমাণু বোমার এক বছরের খরচ দিয়ে আপনি বানাতে পারতেন এক লক্ষ প্রাইমারি স্কুল!
আর বেলুচিস্তান ইরানের সীমান্তে হাজার হাজার মানুষ প্রচণ্ড গরমে তাঁবুর নিচে গাদাগাদি করে সেদ্ধ হচ্ছে, বাথরুম নেই, পানি নেই…লক্ষণ থাকা সত্ত্বেও পরীক্ষা নেই! তারা নিজেরা সংক্রমিত হচ্ছে, আর সংক্রমণ ছড়াচ্ছে পুরো পাকিস্তানে! নো ফ্যাসিলিটি! নো হিউম্যানিটি!”
সমস্ত ফ্যাসিলিটি আর হিউম্যানিটির মাতৃক্রোড়ের কবি এ কথা অবশ্যই লিখবেন।
কবি বলছেন, “আইএমএফ বস ক্রিস্টিয়ানা, আপনি কি জানেন, মানবতার এই অবমাননার জন্য আপনি দায়ী? জেফ বেজোস, আপনি কি জানেন, যে ছয় মাসের শিশু করোনাভাইরাস বুকে নিয়ে মারা গেছে, তা ছড়িয়েছেন আপনি? আম্বানি, আপনি কি বুঝতে পারছেন, টাকা কোনো নিরাপত্তা নয়?”
মারণঘাতী শেয়ার ব্যবসা আর ফেইক করোনা ওষুধ বিক্রির দরবেশমুক্ত দেশের কবি আম্বানিকে দুটি বকা দেবেন ক্ষতি কী!
এইখানে কবি খুব সম্ভব প্রথম নিজের কথা বলছেন, “আমাদের আত্মাভরা ভাইরাস।” তবে ভাইরাসের মালিকানা ছুঁড়ে দিচ্ছেন বুধোর ঘাড়ে ঠিক এভাবে,” আর আপনারা হলেন সেই ভাইরাসের প্রধান পোষক ট্রাম্প, পুতিন, লি, মোদি, ইমরান, বরিস, আবে।”
এক্ষণে আমরা বুঝলাম গোটা দুনিয়ার খলনায়কেরা করোনাভাইরাসের জন্য দায়ী আর কবি জসিমউদ্দীনের “সোজন বাদিয়ার ঘাটে”র নায়ক এর ভিকটিম। সোজন বাদিয়ার ঘাটে ভেন্টিলেটর আছে, গার্মেন্টস মালিকরা গলায় গামছা দিয়ে গাদাগাদি করে হাঁটিয়ে আনেনা গার্মেন্টস শ্রমিকদের, আজ পর্যন্ত লকডাউন ঠিকঠাক বাস্তবায়ন না হলেও; দোষ তো ট্রাম্প, পুতিন, লি, মোদি, ইমরান, বরিস, আবে “হালার”।
সোজন বাদিয়ার ঘাটে শ্রম শোষণ নেই; ত্রাণচুরি নেই; গুম নেই; অব্যবস্থাপনা নেই, আছে কেবল জিডিপির আলকাপ নৃত্য; আর কবিদের উত্তরীয় পরা পিঠেপুলির সাঁঝ।
সোজনবাদিয়ার সুখ তাহাজ্জুদের নামাজ দিয়ে শুরু হয়; প্রগতিশীলতার পূজা-অর্চনা দিয়ে শেষ হয়। ঋণখেলাপির জন্য প্রণোদনায় জমে ওঠে রথযাত্রা; শতমাইলের শ্রমিক মিছিল।
ট্রাম্প, পুতিন, লি, মোদি, ইমরান, বরিস, আবে “হালার” দেশে তলে তলে ভি আই পি হাসপাতাল নেই, মহাজনের জন্য মেডিকেল বোর্ড নেই। নেই করোনাকালেও আনুষ্ঠানিকতার আতশবাজি।
আনিসুল হকের “ইশতেহার” কবিতাটির কনসেপ্ট অনন্য। শুধু আত্ম-প্রবঞ্চনা আর অস্বীকারের বিষে বিষাক্ত এই চিন্তাকাব্য। বাংলাদেশে এইভাবে আধা গ্রামীণ ও আধা শহুরে তালগাছ মনোজগতের দূষণে একসময়ের গ্রামীণ কবি লালন-হাসন রাজা-শাহ আবদুল করিমের বিশ্বজনীন নৈর্ব্যক্তিক মানবদর্শনের অস্থিটি ভেঙ্গে পড়েছে।
এই আনিসুল হক নব্বুই-এর গণ অভ্যুত্থানের সময় তাঁর বিপ্লবী কবিতা দিয়ে আমাদের তরুণ মনকে আলোড়িত করেছেন। অথচ স্বৈরাচারের নিত্যতাসূত্র অনুযায়ী যখন কর্তৃত্ববাদ ভিন্ন অবয়বে বেঁচে থাকে; তখন সেই আনিসুল হক রাজকবি টেড হিউসের-এর কবিতার মৃত “পাইক” মাছের স্থির একচক্ষু-র কবি হয়ে ওঠেন।
১৯৬০-৯০-এ গড়ে ওঠা বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের দেউটি একে একে নিভে গেলে; এই দেউলিয়া শিল্প সাহিত্যের রাজ প্রণোদনার ঋণখেলাপি কবির কোলাহলে ধূসর যুগের বেদনা সুস্পষ্ট করে। নৈর্ব্যক্তিক অরাজ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “হঠাৎ দেখা ” কবিতায় লিখেছিলেন,
“আমাদের গেছে যে দিন
একেবারেই কি গেছে,
কিছুই কি নেই বাকি।”
– মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক
Editor in Chief : E-SouthAsia