অধুনালুপ্ত সন্দ্বীপ টাউনের দক্ষিণ অংশে পোলঘাট এলাকায় আমাদের বাসা ছিল। আমাদের বাসা সংলগ্ন পশ্চিম পাশে তালুকদারদের ঈদ গাহ ছিল। তার উত্তর পাশে বিরাট একটি দীঘির মত পুকুর ছিল। আমার দাদারা খনন করেছিলেন। আমরা পুরান পুকুর বলতাম। এই পুকুরের পশ্চিম পাড়ে মোক্তার চাচার বাসা ছিল। মিজান চাচার বাসার ছিল মোক্তার চাচার বাসার সাথে সীমানা ওয়ালের উত্তর পাশে। অর্থাৎ মুশিউর রহমান মুশিদের বাসা। যার ফার্মেসি আছে কমপ্লেক্সে ও নানাবিধ সামাজ কল্যাণমূলক কাজে জড়িত আছে। ফুটবলের প্রতি আসক্তি তার। সন্দ্বীপের বড় মাপের ফুটবলার ছিল। ফুটবল ও সন্দ্বীপ টাউনের টানে চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটি থেকে এম.এ. পাশ করার পর তখনকার দিনের স্বনাম ধন্য ব্যাংকে চাকরিতে জয়েন্ট করার পরও সন্দ্বীপে ফিরে আসে। ব্যাংকে জয়েন্ট করতে রংপুরে যাওয়ার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলে আমার ৬৩০ নং কক্ষে উঠেছিল। এই হাসি খুশি মানুষকে আমি মলিন ও কাঁদো কাঁদো দেখেছি। যদি কেউ বলে, এত পড়াশুনা করে ঘরে বসে আছে। তাই যাচ্ছে পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করতে। মুশি সকলের পরিচিত মুখ ও বন্ধু প্রতিম। সে কি সন্দ্বীপ টাউন, খেলাধুলা, বন্ধু বান্ধব ছেড়ে থাকতে পারে!
আমার সব সময় তাদের কথা মনে পড়ে। আমরা বড় বড় মাঠে ছোট কালে খেলাধুলা করতাম।থানার সামনে ডাক বাংলা মাঠে। কার্গিল স্কুলের মাঠে। মুশি, দিলীপ, লিঙ্কন, প্রদীপ, রিপন, বাবু ও স্বপ্না ছাড়াও আজ আরো অনেকের কথা মনে পড়ছে।
একবার সন্দ্বীপ টাউনে বলাবলি শুরু হলো পাকিস্তানী মানোয়ার (ম্যান অফ ওয়ার) আসছে। তাদের প্রতিহত করার জন্য দা, সুরখি, বল্লম ইত্যাদি সহ বোতলে মরিচের পানি নিয়ে সকলে পশ্চিম দিকে কাঠির (বেড়ি বাঁধের) দিকে অগ্রসর হতে থাকে। দিনভর রেখি হতে থাকে। সন্দ্বীপের স্বাধীনতার কিংবদন্তি পুরুষ দিলাল রাজার ফর্মুলায় কামান তৈরির কাজ শুরু হতে থাকে। ওই দিকে মানোয়ার ধেয়ে আসছে। নারী পুরুষ বলে কথা নেয়: হানাদার থেকে মাতৃভূমি সন্দ্বীপকে রক্ষা করতে হবে। প্রায় ৩ হাজার বছর ধরে স্বাধীন সন্দ্বীপ ইংরেজ ক্যাপ্টেন নলিকিংসের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ইংরেজ বেনিয়াধীন হয়ে পড়ে। আহা! সন্দ্বীপীদের সেই উদ্দীপনা, আবেগ, ঐক্য, স্বাধীনতার স্বপ্ন ও সন্দ্বীপ রক্ষা করার প্রবল জোয়ার বৈছে আবাল বৃদ্ধ বণিতার পরতে পরতে, পলক হেরি ক্লান্ত নয় বরং স্বাধীনতার আভা ভাসছে পলকে পলকে।
অতঃপর দূর সমুদ্রে একটি জাহাজ দেখা গেল। প্রবল সাহসকিতার সাথে ওখানে রেইড দিয়ে একজন পাকিস্তানি/বিহারীকে ধরে আনা হলো। উনাকে সন্দ্বীপ টাউনের থানায় রাখা হলো। জানা গেল, উনি তেলের ট্যাংকারে উচ্চ পদস্ত নাবিক ছিলেন। উনি প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিলেন। উনাকে প্রাণ ভিক্ষা দেয়া হলো। স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের সেক্রেটারী মোক্তার চাচার বক্তব্য ছিল, পাকিস্তানী আর্মীরা এই ঘটনা জেনে গেলে শান্তিপূর্ণ সন্দ্বীপে চরম হত্যাযজ্ঞ চালাবে। কারণ সন্দ্বীপে পাকিস্তানী হানাদারদের মোকাবেলা করার মত লজিস্টিক সাপোর্ট নেয়। মুক্তিযোদ্ধা নেই, অস্র নেয়। গোপন আস্তানায় বাঁশ দিয়ে অস্রের অনুকরণে ট্রেনিং শুরু হয়েছে মাত্র। সবে মাত্র ১৭ এপ্রিল প্রবাসী সরকার গঠন করা হলো। আমাদের কাছে যথেষ্ট ইন্সট্রাকশন নেয়। সন্দ্বীপ টাউনের গণ্য মান্য সন্মানীয় ব্যক্তিগণ ঐক্যমত হলেন ও উনাকে জাহাজে ফেরত পাঠানো হলো। উপস্থিত জনতা তাকে দেখতে চাইলো। থানার বারান্দায় একটি চেয়ার বা টুলের উপর দাঁড় করিয়ে সকলকে দেখতে সুযোগ করিয়ে দেয়া হলো। সকলে বিজয়ের বেসে বাড়ি ফিরে যায়।
এর কিছু দিন পর মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সন্দ্বীপে হানাদার বাহিনীর নিয়মিত আর্মি এলো। সন্দ্বীপে কয়েকজনকে শহীদ করলো। বাড়ি ঘর পোড়ালো। সম্ববত ৩ দিন ছিল। জাহিদুর রহমান মোক্তার চাচাকে পোলঘাটের লোহার ভীমের উপর নির্মিত কাঠের ব্রিজে বর্বর বাহিনী গুলি করে শহীদ করে। উনাকে সন্ধ্যা রাতে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় ও শেষ রাতে শহীদ করে। ভোররাতে হানাদার বাহিনী সন্দ্বীপ ছেড়ে চলে যায়। বলা হয়, বর্বরের প্রাণ নেয় – এরা পাষন্ড। যিনি যাদের প্রাণ বাঁচালেন; তারা তার প্রাণ নিলেন।
আমি ছোট ছিলাম ও ভাঙা ভাঙা উর্দু বলতে পারতাম। আমাদের পরিবার রহমতপুরে আমাদের ফুফুর বাড়িতে (লালখাঁর গো বাড়িতে) আশ্রয় নিয়েছিল। ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী বন্যায় পর ত্রাণ কাজে পাকিস্তানী আর্মিরা এসেছিল। সিঙ্গাপুর থেকে স্বেচ্ছাসেবী আসছিলেন দলবদ্ধভাবে। পাকিস্তানী আর্মিদের মেজর আমাদের বাসার দক্ষিণ পাশে ওয়াবদা রেস্ট হাউজে উঠেছিল। লোক মুখে জানাজানি হয়ে গেলো; ওই মেজর আবারও এসেছে। যেহেতু আমি তাকে চিনতাম, তার সাথে উচা লম্বা হাবিলদারকে চিনতাম। চিনতাম অন্যদেরও। তাই আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে আমাকে পাঠানো হলো, মোক্তার চাচাকে যেন বাসায় গিয়ে গোপনে বলে আসি, জেলে বেশে উনাদের বাসা সংলগ্ন হতাল (সাওঁতাল) খালে মাছ ধরার জন্য ঝাকি জাল নিয়ে বেরিয়ে যেন পালিয়ে যান। কারণ আর্মিরা মেজরের (ওই সময়ে কর্নেলের) নিরাপত্তার জন্য এলাকাতে টহল দিতে গিয়ে মোক্তার চাচার বাসাও টহলের আওতাভুক্ত করেছিল। ফলে সন্দেহ বাড়তে থাকে। এই ম্যাসেজ নিয়ে আসতে আমিও উৎসাহ বোধ করলাম। এক ডিলে দুই পাখি। বাবুর সাথেও দেখা হয়ে যাবে।
আমি ননী দত্ত চাচার বাসার পাশ দিয়ে মোক্তার চাচার বাসায় যেতে চেষ্টা করি। বাধাগ্রস্থ হই। তারপর আমি আমাদের বাসার ঈদ গাহ হয়ে যেতে চেষ্টা করি। আমার সাথে সেই ৭ ফুট লম্বা সুবেদার/হাবিলদার মেজরের সাথে দেখা হয়। উনি আমাকে ওই মেজর/কর্নেলের সাথে দেখা করতে বলে। আমি সালাম দিয়ে ফিরে আসি। উনাকে ওয়ারলেসে কথা বলতে দেখতে পাই।
তখন আমাদের মহান স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র ৪০/৪৫ দিন। সন্দ্বীপ থেকে মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিংএ যেতে সবেমাত্র যোগাযোগ শুরু করেছে।
মোক্তার চাচা ভীরু ছিলেন না। আদালতে যেমন মক্কেলদের পক্ষে ডিপেন্ড করতেন। ঠিক তেমটি স্বাধীনতার পক্ষে স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে শহীদ হলেন। আজকের এই দিনে ১০ এপ্রিল ১৯৭১। আজ ৪৯ তম শহীদ দিবস। দোয়া করি, আল্লাহ তাঁকে বেহেস্ত নসিব করেন। কারণ হাদিসে আছে, হুব্বল ওয়াতনে মিনাল ঈমান – দেশ প্রেম ঈমানের অংশ।
আমার যতটুকু মনে পড়ে, উনারা পরে গ্রামের বাড়িতে চলে যান। উনার মেঝু ছেলে মানিক ভাই চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটির গণিত বিভাগের (সহকারি/সহযোগী) অধ্যাপক ছিলেন। পিএইচডি করার জন্য আমেরিকা ছিলেন। শহীদ মোক্তার চাচার পরিবার আমেরিকা চলে গেলেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। অনেক চেষ্টা করেও সেই পোলঘাটের ব্রিজের নাম দেয়া গেলো না ’শহীদ জাহিদুর রহিম পোল।
আর দেখা হলো না মোক্তার চাচার সাথে ও তাঁর ছোট মেয়ে বাবুর সাথেও। এইভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে রইলাম ছোট কালের খেলার বান্ধবী বাবুর সাথে।
স্মৃতিচারণ:
শিব্বীর আহমেদ তালুকদার
আইনজীবী ও সমাজ সংগঠক
কথ্য ইতিহাস গবেষক।