প্রজার মৃত্যু সংখ্যা, পান্ডার মৃত্যু সংবাদ
ইউনাইটেড হাসপাতাল যখন পুড়ছিলো; আমি তখন নীরোর পাশে বসে বেহালা শুনছিলাম। এ বড্ড সেনসিটিভ সময়; আমরা মানুষকে ভালো না বাসলেও আমাদের একটা মানবতা অনুভূতির আতর মেখে ঘুরতে হয়।
দক্ষিণ এশিয়াই পৃথিবীর একমাত্র জনপদ; যেখানে একটি শিশু জন্মায় কাস্ট সিস্টেমের এঁটে দেয়া গরিব কিংবা বড়লোক তকমা নিয়ে। এ সমাজ এতো নিষ্ঠুর যে, এখানে জীবনের মৌলিক চাহিদা শুধু পূরণ হয় হ্যাভদের। হ্যাভস নটরা ধর্ম-রাজনীতির গেম অফ থ্রোনস-এ প্রাণ দেয়; বেঁচে থাকলে মরে যাওয়া সঙ্গীদের মাংস খেয়ে স্বাস্থ্যবান ও বলশালী হয়ে ওঠে।
সে এতো বলশালী হয়ে ওঠে যে সে বাহুবলির মতো বাংলাদেশ ব্যাংককে তুলে নিয়ে গিয়ে সুইস ব্যাংকের গ্যারেজে ঢোকায়।
কোন জায়গা দেখে পছন্দ হওয়া মাত্র গিয়ে বলতে পারে, বুঝেছো উপেন; এ জমি লইবো কিনে!
রাত বিরেতে ভোট কেন্দ্র দখল করে সে বাহুবলি গণতন্ত্রের দফার রফা ফিশরোল বানিয়ে খায়। তারপর বিরাট জিডিপি গ্রোথের একটা জাদু গল্প ফেঁদে বসে।
রাস্তার টোকাইকে ডেকে স্বপ্ন দেখায়; আমিও টোকাই আছিলাম; অহন বাহুবলি; পারবি আমার মতোন হইতে।
টোকাই হেলমেট পরে, বন্দুক হাতে নেয়; ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ইস্টের ব্যাংকে ঢুকে ঋণ চায়; ম্যানেজার গড়িমসি করলে তাকে ঢিঁচুয়া বলে গুলি করে দেয়।
খবরের কাগজে কিছুটা তোলপাড় হলে, বাহুবলি আশ্বস্ত করে, ভয় নেই আমি দেশপ্রেমমূলক এক নির্মিতব্য চলচ্চিত্র প্রযোজনা করছি; আমরা পোচন্ড দেশপ্রেমের সঙ্গে এমনভাবে মিশে আছি যে; দুটি গুলি করে পাখি মারলে এমন কিছু হয়না।
বাহুবলির সহবলি মনে করিয়ে দেয়, সহবলিরা রাস্তায় গুলি কইরা বা গাড়ির নীচে মানুষ মারছে না; তাতে কী হইছে; কচু হইছে। খুব সমস্যা হইলে ইসলাম সম্মতভাবে রক্তমূল্য পরিশোধ করলেই শেষ। ওভার এন্ড আউট।
বাহুবলি উল্লাস করে, ড্যামশিট; এতো মনেই ছিলো না।
লকডাউনে ওএসডি হয়ে যাওয়া সহবলিদের নৌবিহারে ওরা বলাবলি করে, জন্মাইলে মরিতেই হইবে; করোনারে এতো ভয় পাওয়ার কী আছে।
এক তরুণ সহবলি বলে, কাম কাজ বন্ধ থাকলে আমদানি হয়না; গা ম্যাজ ম্যাজ করে। হুদাই লকডাউন। ওস্তাদ মা জননীরে কন খুইলা দিক দোকানদারির মহাফেজখানা। ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে ৪-৫ লাখ ঝইরা গেলে অসুবিধা কী!
এক কবি প্রকৃতির সহবলি বলে, বসন্তে গাছেরও পাতা ঝরে; তাই বইলা কী গাছ কখনো লকডাউন করে।
গত দশ বছরে প্রতিষ্ঠিত সহবলিদের দেখে স্পিড বোটে গান পকেটে দাঁড়িয়ে থাকা টোকাই; আগামি দশবছরের স্বপ্ন দেখে। দখল করা চিংড়ির ঘের থেকে গলদা চিংড়ি আনা হয়েছে; সেই চিংড়ির মালাইকারি পরিবেশন করতে দেখে টোকাইয়ের মনে হয়, করোনায় এরা মরলে; এগো চিংড়িং ঘের আমি দখল করুম।
সহবলিরা বলাবলি করে, করোনার কারণে বিদেশে মাউন্ট এলিজাবেথে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ বলে ইউনাইটেড হেলথ ক্যাসিনোর বুকিং দেখা আছে। এক সহবলি টোকাইকে উদ্দেশ্য করে বলে, শোন আমার করোনা হওয়া মানে তোর হইছিলো; সেই থিকা আমার হইছে; আমি হাসপাতালে গেলে তুই প্লাজমা দিবি বুঝছোস।
টোকাই জ্বি বস ইয়েস বস বলে পারলে তখনই প্লাজমা নিবেদন করে।
ইউনাইটেড হাসপাতাল যখন পুড়ছিলো; আমি তখন নীরোর পাশে বসে বেহালা শুনছিলাম; কারণ ভি আই পি হাসপাতালে বাহুবলি আর সহবলি ছাড়া আর কেউ নেই। এখানে ভুল করে সাধারণ মানুষ ঢুকে পড়লে বহু লক্ষ টাকার আক্কেল সেলামি দিয়ে লাশ ছাড়িয়ে আনতে হয়।
পৃথিবীর আর কোন দেশে মৃত্যুতে এমন কাস্ট সিস্টেম নেই; গুরুত্বপূর্ণ বাহুবলির জন্য মেডিকেল বোর্ড, সি এম এইচ, ঋণখেলাপি সহবলি হলে ইউনাইটেড ও ইত্যাদি বুটিক হাসপাতাল।
আর নরোত্তম নামের কোন সাধারণ প্রজা হলে, সে হাসপাতালের সামনে মাঠে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে; “ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা” ভঙ্গিতে।
তারপর নরোত্তম সংখ্যা হয়ে যায়; অথচ ইউনাইটেড হেলথ ক্যাসিনোতে পুড়ে যাওয়া সহবলি সংবাদ হয়।
সুতরাং নীরো বেহালা বাজায়; আমি সেই বেহালা শুনি অনুশীলিত নির্লিপ্ততায়।
ক্রমশ:
– মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক
Editor-in-Chief : E-SouthAsia