হাবিব খান : দেশে করোনার রোগীর সঙ্গে বাড়ছে মুত্যুুর সংখ্যা কিন্তু সেই সময়ে সরকারের নির্দেশে খুলছে অফিস। আগামী ৩১ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত আকারে অফিস করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।। তবে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগামী ১৫ জুন পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন- সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে করোনা পরিস্থিতির মারাত্মক রূপ নিতে পারে। গত ৪ এপ্রিল পোশাক কারখানা খোলা নিয়ে বিভ্রান্তির কারণে পোশাক শ্রমিকদের ঢাকায় আসা এবং ফিরে যাওয়ার ফলে টেস্ট অনুপাতে সংক্রমণের হার ৪.৬ শতাংশ থেকে এক লাফে বেড়ে যায় ১২.৫ শতাংশে। এরপর ২৬ এপ্রিল সীমিত পরিসরে অফিস ও পোশাক কারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলে আবারও সংক্রমণ বাড়ার আভাস পাওয়া যায়। এরপর ১০ মে মার্কেট ও শপিং মল খুলে দেওয়া হলে টেস্ট অনুপাতে শনাক্তের হার গিয়ে পৌঁছায় গড়ে ২০ শতাংশে।
গত ২৪ মে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় সমন্বয় কমিটির উপদেষ্টা অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ দ্য ডেইলি স্টার কে জানিয়েছেন দেশে করোনার ঝুঁকি বেড়ে গেছে। ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার অনুমতি সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘ঘোষণাটি সম্পূর্ণভাবে সাংঘর্ষিক হয়েছে।’ ‘সরকারের কথা ও কাজের মধ্যে মিল থাকছে না’ বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন। তার মতে, আগামী পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যে দেশে করোনার ঝুঁকি আরও বাড়বে। প্রয়োজনে সরকারকে কারফিউ দিতে হবে বলেও মনে করছেন তিনি। তবে, কারফিউ জারির মতো জল্পনার অবসান ঘটিয়ে সীমিত আকারে গণপরিবহন চালুসহ অর্থনীতি সচল করার দিন-তারিখ ঘোষিত হয়েছে বুধবার।
কখন গতি বেড়েছে সংক্রমণের
৯ এপ্রিল ঢাকায় সংক্রমিত এলাকার সংখ্যা ছিল ৬১টি এবং আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৯৬ জন। এরপর ২৬ এপ্রিল সংক্রমিত এলাকার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৫৪ এবং আক্রান্তের সংখ্যাও বেড়ে দাঁড়ায় দুই হাজার ৪৮৫ জন। তার ঠিক এক মাস পর অর্থাৎ ২৬ মে ঢাকায় আক্রান্ত এলাকার সংখ্যা ২১০টি এবং এসব এলাকায় আক্রান্তের সংখ্যা ১৪ হাজার ৩৪৮ জন।
উপরোক্ত তথ্য এর দিকে তাকালে দেখা যায়, এক একটি শিথিলতার সিদ্ধান্তের পরে শহরে সংক্রমণের গতি বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়ে যায় ১০ মে পরবর্তী সময়ে, আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ১৬ মে’র পর থেকে। গড় ইনকিউবেশন পিরিয়ডকে ৬ দিন ধরে নিলে মার্কেট ও শপিং মল খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রভাব ১৬ মে থেকে পরিলক্ষিত হওয়ার কথা। সেই হিসাবে গত ১০ দিনে সংক্রমণের গতি বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে মার্কেট ও শপিং মল খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের যোগসূত্রের আভাস পাওয়া যায়।
শহরে দৈনিক নতুন শনাক্তের দিনগুলো এই ১০ দিনের মধ্যেই পড়ে। ১৯, ২০ ও ২২ মে ঢাকা শহরে নতুন শনাক্তের সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ, এই দিনগুলোতে যথাক্রমে ৯৩৯, ১৫০১ ও ১০৮৮ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। কেবল এই তিন দিনই নয়, বরং ১০ মে’র পর থেকেই শহরে দৈনিক নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ব্যাপক গতি পেয়েছে। আগের চেয়ে যা কমপক্ষে দ্বিগুণ বেশি। যা সংক্রমণের সঙ্গে ১০ মে পরবর্তী সময়ে মার্কেট ও শপিং মলে মানুষের যাতায়াতের সঙ্গে সম্পর্ককেই পুনরায় সামনে আনে।
এর আগেও একবার এমনটি হয়। ৪ এপ্রিল নানান বিভ্রান্তির কারণে পোশাক শ্রমিকদের ঢাকায় এসে ও চলে যাওয়ার পর ঢাকা শহরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে সংক্রমণ ব্যাপক মাত্রায় গতি পায়।
ঢাকার সবচেয়ে সর্বাধিক সংক্রমিত ১৬ এলাকার প্রায় সবক’টিতে শেষ ১০ দিনে সংক্রমণ গতি পেয়েছে। এই সময়ের মধ্যে নতুন আক্রান্তের হিসাবে সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে মহাখালী, উত্তরা, মগবাজার ও মুগদায়। এই চারটির প্রতিটি এলাকা থেকে শেষ ১০ দিনেই আক্রান্ত বেড়েছে ১০০ জনের বেশি। অন্য এলাকাগুলোর মধ্যে কেবল কাকরাইল ও রাজারবাগ বাদে সবক’টি এলাকাতেই এই ১০ দিনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আক্রান্ত বেড়েছে।
সীমিত গণপরিবহন
সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নির্দিষ্ট সংখ্যক যাত্রী নিয়ে আগামী ৩১ মে থেকে গণপরিবহন চালানোর অনুমতি দিয়েছে সরকার। বৃহস্পতিবার (২৮ মে) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ আদেশ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এছাড়া করোনা বিস্তার রোধে সাধারণ ছুটি না বাড়িয়ে শর্তসাপেক্ষে সার্বিক কার্যক্রম এবং জনসাধারণের চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আগামী ১৫ জুন পর্যন্ত বাড়িয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাঠ প্রশাসন সমন্বয় অধিশাখার সিনিয়র সহকারী সচিব তৌহিদ ইলাহী স্বাক্ষরিত আদেশে এ তথ্য জানা গেছে।
সীমিত ট্রেনে, টিকিট বিক্রি হবে অর্ধেক
আগামী রোববার থেকেই সীমিত আকারে যাত্রীবাহী ট্রেন চালু করবে রেলওয়ে। সংস্থাটির নেওয়া পদক্ষেপগুলো হচ্ছে—১. দুই দফায় ১৭টি আন্তনগর ট্রেন চালু করা হবে। ২. চলাচল করা ট্রেনের অর্ধেক আসনের টিকিট বিক্রি করা হবে। ৩. মাঝপথে কম যাত্রাবিরতি থাকবে। ৪. হ্যান্ড সেনিটাইজার এবং বাথরুমে সাবানের ব্যবস্থা করা হবে।
রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, রেলের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে শতাধিক আন্তনগর ট্রেন চলাচল করে। রোববার থেকে ৮টি ট্রেন চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে ঢাকা–চট্টগ্রাম পথের সোনার বাংলা ও সুবর্ণ এক্সপ্রেস। ঢাকা–সিলেট পথে কালনী এক্সপ্রেস। ঢাকা–পঞ্চগড় পথে পঞ্চগড় এক্সপ্রেস। ঢাকা–রাজশাহী পথে বনলতা এক্সপ্রেস। ঢাকা–লালমনিরহাট পথে লালমনিরহাট এক্সপ্রেস। চট্টগ্রাম–সিলেট পথে উদয়ন/পাহাড়িকা এক্সপ্রেস। ঢাকা–খুলনা পথে চিত্রা এক্সপ্রেস ট্রেন।
যুক্তরাষ্ট্র আমাদের মডেল?
করোনায় যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে তখনও ট্রাম্পের উদ্ভট ধরণের সব তথ্যর সংবাদ দেখেছে বিশ্ব। লকডাউনের বিপক্ষে তার ও তার দলের অবস্থান যুক্তরাষ্টকে আজকের এই পরিস্থিতিতে নিয়ে এসেছে সেটা আজ তাদের চিকিৎসাবিশেষজ্ঞদের দেয়া বৈজ্ঞানিক তথ্যেই প্রমাণিত। এখনো যুক্তরাষ্ট্রের গতিধারা দেখে মনে হচ্ছে, মৃত্যুর সংখ্যা যা-ই হোক না কেন, দেশটি পুরো জনগোষ্ঠীকে সংক্রমণের বিপদ মোকাবিলার মুখে ঠেলে দেওয়ার পথেই অগ্রসর হচ্ছে। যাঁদের রোগপ্রতিরোধী ক্ষমতা আছে, তারা টিকে যাবেন। আর টিকবেন তারা, যাঁরা চিকিৎসার সুযোগ পাবেন। সেখানে করোনায় মৃত্যুর সারিতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় আছে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মানুষেরা। স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের লাশের সারি দীর্ঘ হবে। ভারত আর ব্রাজিলেও একই নীতি অনুসরণের আলামত মিলছে। তবে কি বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রকেই অনুসরণ করছে।
প্রসঙ্গত, গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২ হাজার ২৯ জনের শরীরে শনাক্ত হয়েছে ভাইরাসটি। এ নিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৪০ হাজার ৩২১ জনে। এছাড়া বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ১৫ জন মারা গেছেন। এ নিয়ে প্রাণঘাতি এই ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা ৫৫৯ জনে দাঁড়াল। মৃতদের মধ্যে ১১ জন পুরুষ ও ৪ জন নারী। ৭ জন ঢাকা ও ১০ জন চট্টগ্রাম বিভাগের বাসিন্দা ছিলেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে নিয়মিত অনলাইন ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা এ তথ্য জানান।