করোনাকালের মৃত্যুগুলো কী লুকিয়ে রাখা মিথ্যার ইতিহাসের অন্ধকার ফুঁড়ে সত্য উন্মোচনের সময়!
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ইতিহাস বিকৃতির অন্ধকার ফুঁড়ে সত্য অনুসন্ধানের জন্য ২০০৫ থেকে ২০০৬ সালে ডয়চেভেলে প্রচার করেছিলো “৩৫ বছরে বাংলাদেশ” নামে একটি সিরিজ।
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শব্দ সৈনিক আবদুল্লাহ আল ফারুকের সঙ্গে যৌথভাবে এই ধারাবাহিক নির্মাণের সুযোগ এসেছিলো। এর আগে সিভিল সার্ভিসের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ বেতারে কাজ করতে গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসেনাদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে কাজ করার সুযোগ হয়েছিলো। শেরে বাংলা নগরের জাতীয় বেতার ভবনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান সংগঠক সাজাহান ফারুক থেকে সংগীত পরিচালক সুজেয় শ্যামের মতো জীবন্ত ইতিহাসের সঙ্গে কাজ করার সুযোগে দীর্ঘ আলাপচারিতায়; একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের গলিঘুঁচি সব জানা হয়ে গিয়েছিলো।
সত্যি বলতে কী এই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়তে আমাকে কখনো কোন বাঘা ন্যারেটিভ নির্মাতা অমুক্তিযোদ্ধার লেখা পড়তে হয়নি।
আমাদের পরিবারে মুক্তিযুদ্ধে স্বজন হারানো; বিধবা ও অনাথ আত্মীয়ের সঙ্গে বেড়ে ওঠায় যাপিত জীবনে এই যুদ্ধের ক্ষত ছিলো; এমনকী রাজশাহীর আড়ানীতে পাকিস্তানি দখলদার সেনার পুড়িয়ে দেয়া নানাবাড়ির দালানে এখনও ইতিহাসের এই অমোচনীয় চিহ্ন যেন আজো রয়ে গেছে। রাজশাহীর সারদাতে আমার আম্মার চাচার পরিবারে ১৯৭১ সালে ঘটে যায় এমন ট্র্যাজেডি; যা থেকে এখনো বের হয়ে আসতে পারেনি তারা। একটি পরিবারের ছয় জন পুরুষকে হত্যা করার পর আর কী থাকে!
ফলে মুক্তিযুদ্ধ আমার সাংবাদিকতা জীবনে নিরন্তর অনুসন্ধানের বিষয়। বাংলাদেশ বেতারে কাজ করার সময়টিতে মুক্তিযোদ্ধাদের ইন্টারভিউ নেয়া আর একাত্তরের বধ্যভূমি খননের সময় সেখানে গিয়ে স্বজন হারানো পরিবারের সদস্যদের স্মৃতিচারণ বাণী বদ্ধ করার কাজটি সাধ্যমত করেছি।
ফলে মুক্তিযুদ্ধের একটা স্পষ্ট ছবি যেন অবচেতনে আঁকা হয়ে গেছে। চ্যানেল আই টিভি চালু হবার পরপরই কবি হুমায়ূন রেজার সঙ্গে “খোলা চোখে” নামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন মূলক অনুষ্ঠান করার সময়; শেরপুরের মুক্তিযুদ্ধে বিধবাদের গ্রাম নিয়ে প্রামাণ্য অনুষ্ঠান করতে গিয়ে মনে হয়েছে; এ যেন রাজশাহীর সারদার মুক্তিযুদ্ধে বিধবা গ্রাম; একই রকম বেদনার ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন আমার বিধবা খালার মতো আত্মীয়েরা।
আমার বেড়ে ওঠা ঈশ্বরদীতে। সেখানে মেরুদন্ড সম্পন্ন মানুষেরা কারো পরাভব মানে না। প্রাচীন এই রেল-জংশন শহরের মানুষেরা এতো সাহসী যে সেখানে বৃটিশ-পাকিস্তানি বা স্বাধীন বাংলাদেশের কোন শাসক তার মিথ্যা ন্যারেটিভ তৈরির নাক গলাতে পারেনি।
ফলে ঈশ্বরদীতে কোন ইতিহাস বিকৃতি ঘটে না। শিষ্টাচার সম্পন্ন জেদি মানুষেরা ইজম বেচে খাওয়া রাজনীতির দোকানদের ঘৃণা করে। ফলে বঙ্গবন্ধু সেখানে সব সময় বলতে পারেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও হত্যাদিবসে তাঁর ভাষণ সবসময় ঈশ্বরদীতে বেজেছে; বাজে; বাজবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। কেননা ব্যাপারটা আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকা-না থাকার ওপর নির্ভর করে না। মানুষই বাঁচিয়ে রাখে তাদের মুক্তির প্রতীক।
সেই আমার পক্ষে ঢাকায় এসে, বঙ্গবন্ধুকে ঢেকে রাখা হয়েছে বিস্মৃতির আড়ালে; এই মিথটি প্রথমে শুনেই ধাক্কা লাগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও বঙ্গবন্ধু ছিলেন আছেন থাকবেন মানুষের মুক্তির প্রতীক হয়ে।
বিএনপির রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর সমান্তরালে জিয়াকে দাঁড় করানোর চেষ্টা বিস্মিত করেছিলো। কারণ ভারত পাকিস্তানে জাতির জনকদের সমান্তরালে অন্য কাউকে দাঁড় করানোর চেষ্টা নেই।
জিয়াউর রহমান নিজেও কখনো এরকম অসম্ভব চেষ্টা করেননি। বিএনপির “চাটার দল” ও “চোরের খনি” এইসব ইমেডিয়েট মুনাফার ইতিহাসের ন্যারেটিভের দোকানদারির ব্যবসা করেছেন; এটা খুব স্পষ্ট। বঙ্গবন্ধুর হত্যা দিবসে খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালনের মতো নরভোজি কেক কাটার দৃষ্টান্ত সভ্যতার ইতিহাসে বিরল।
আওয়ামী লীগের “চাটার দল” ও “চোরের খনি”-র অনুরূপ ইমেডিয়েট মুনাফার ইতিহাসের ন্যারেটিভের দোকানদারির চেষ্টা আছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা বিএনপির উপদেষ্টা হলে, তার বানানো টেস্টিং কিট ব্যবহার কতভাবে আটকে রাখে আওয়ামী লীগের কীটেরা; ও দেখে বোঝা যায়; কীসব হতবুদ্ধি ও আত্মঘাতি দোকানদারের পাল্লায় পড়েছে বাংলাদেশ।
ঘটনা ঘটেছে আমাদের চোখের সামনে; আমাদের তা জানতে হবে দলীয় ইতিহাস মামার দোকানে রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে; এর চেয়ে হাস্যকর প্রচেষ্টা আর কী হতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধকে আমি বাংলাদেশে খুঁজেছি; ভারতে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিঘন অঞ্চল আর পরিচিত মানুষের স্মৃতিতে খুঁজেছি; মুক্তিযুদ্ধকে খুঁজেছি পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিঘন অঞ্চল ও আর পরিচিত মানুষের মাঝে। জার্মানির ডয়চেভেলের সঙ্গে কাজ করার সময় কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ইন্টারভিউ নেবার সুযোগ আসে। এরপর পাকিস্তানে গিয়ে সেখানকার মানুষের ইন্টারভিউ নেবার সুযোগ হয়েছে।
ভারত আর পাকিস্তানের মানুষের স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা। যেহেতু সেখানকার মানুষের বাংলাদেশের ইতিহাসের দোকানদারির সঙ্গে সম্পর্ক নেই; ফলে বানিয়ে ছানিয়ে অখাদ্য ন্যারেটিভ গেলানোর চেষ্টা ওখানে নেই।
ধর্ম-রাজনীতির নিয়ত দোকানদারির প্রয়োজনে বাংলাদেশেই ইতিহাস বিকৃতি মিশে আছে নানা রঙের দোকানদারের মাঝে।
করোনাকালে ঢাকায় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও সংগীত পরিচালক আজাদ রহমানের মৃত্যুর পর; বা কলকাতায় কথা সাহিত্যিক দেবেশ রায়ের মৃত্যুর পর ১৯৪৭-এর বিভাজনের ক্ষত মানুষের জীবনে কীরকম ট্র্যাজেডি জন্ম দিয়েছে; কীভাবে নিজ গৃহ থেকে উচ্ছেদ হয়ে শরণার্থী হতে হয়েছিলো মানুষকে; তা নতুন করে স্মরণে এসেছিলো।
পাকিস্তানের সাহিত্যিক আসিফ ফাররুখির মৃত্যুর পর মনে পড়লো; ১৯৭১ মানুষের জীবনে কীরকম ট্র্যাজেডির জন্ম দিয়েছে। রাজনীতি ও যুদ্ধে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়; উলু খাগড়ার প্রাণ যায়। মানুষের দিক থেকে ১৯৪৭ কিংবা ১৯৭১-এর ইতিহাসকে দেখা হয়নি। ইতিহাস রচিত হয়েছে রাজনীতির লাভের গুড় পিঁপড়ার অক্ষরে।
মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়ে কী বিরাট সব ইতিহাসবিদ তৈরি হয়েছে; যে কীনা খুঁজে খুঁজে ১৯৭১-এর রাজাকারের মুখ দেখে এসেছে পাকিস্তানে গিয়ে। একবারো খোঁজ করেনি লাখ লাখ আওয়ামী লীগ পরিবার গাদ্দার পরিচয়ে রাজনীতির নরভোজিদের হিংস্রতার মাঝে কী করে বেঁচে ছিলো! বঙ্গবন্ধু কীরকম জনপ্রিয় ছিলেন পাকিস্তানের রাজনীতিক-শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক আর রাজনৈতিক কর্মীদের মাঝে। এসব ইতিহাসবিদ ১৯৪৭ নিয়েও দ্বিধাহীন কন্ঠে বলেন, হিন্দুরা স্বেচ্ছায় ভারতে চলে গেছে; উচ্ছেদ হয়নি। কারণ এদের মাথায় মানুষ নেই। আছে হীরক রাজা; তার উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য গ্রহ নক্ষত্র কিছু মুছে দিতে হলেও তারা দেবে।
আসলে মানসিক দৈন্য আর ব্যাংক লুটের মানসিকতা নিয়ে ইতিহাস চর্চা কেন; পৃথিবীর কিছুই সুচারুরূপে করা যায় না।
কথা সাহিত্যিক মানিক বন্দোপাধ্যায় সৎ লেখকের জীবনে কষ্ট পেয়ে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য উপদেশ দিয়েছিলেন, দুটি ডালভাতের ব্যবস্থা রেখে তারপর লেখালেখিতে আসতে।
অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই উপদেশ। আর্থিক ও মানসিক দৈন্য; পদ-পদবী-পদক-পিঠাপুলির লোভ দিয়ে এমন কিছু সৃষ্টি করা যায় না যা মানুষের কাজে আসে।
করোনাকালের মৃত্যুর মাঝে বেদনা আছে; কিন্তু সত্য আবিষ্কারের উদ্ভাসও আছে। ভাঁড়-ইতিহাসবিদের লুকিয়ে রাখা তথ্যগুলো জনমানুষের সামনে উন্মোচিত হলে; স্থূল ইতিহাসধারকদের মিথ্যাবাদী রাখালের মুখটি খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মানুষকে প্রতারিত করে রাজপন্ডিত হবার চেয়ে সত্যবাদী বাউলের মাধুকরী ভালো। রেলস্টেশানের ভিক্ষুকের জীবনও মিথাবাদী ইতিহাসবিদের চেয়ে কম গ্লানির।
– মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক
Editor-in-Chief : E-SouthAsia