করোনাকালে নিয়ত আত্মসমালোচনা করি। এমন অখণ্ড অবসর আমরা আমাদের জীবদ্দশায় পাইনি; ফলে জীবনের ভুল-ঠিকের প্রতিফলন আমাদের চিন্তায় নিয়ত ঘটছে।
২০০২ সাল থেকে মাঝে বছর দেড়েকের জন্য দেশে বসবাস বাদ দিলে; জীবনের একটি বড় অংশ অনাবাসে কাটলো। চন্দ্র অভিযানে গিয়ে নভোচারীরা সেখান থেকে যেমন নয়নাভিরাম পৃথিবীকে দেখেছিলো; অনাবাসীদের কাছে মাতৃভূমি ঠিক সেই তেমনি অনুপম।
অনাবাসে বাংলাদেশীদের পরিশ্রম, সততা ও আন্তরিকতার সুনাম মুখে মুখে। সুনামের ব্যাপারে খুব নিজে নিঃস্পৃহ হলেও; নানাদেশের মানুষের মুখে বাংলাদেশের মানুষের সুনাম শুনেছি। আর বাংলাদেশ নদীর দেশ-কবিতার দেশ-গানের দেশ হওয়ায়; প্রত্যেক বাংলাদেশীর কন্ঠেই সুর আছে; এ কথা গোটা পৃথিবীর মানুষ বলে।
কিন্তু এই করোনাকালে অনাবাসীদের কারো কারো সিদ্ধান্ত ও আচরণ আমাকে আহত করেছে। অনাবাসী যে দেশে থাকেন; সে দেশের সুখের সময় দিব্যি সুখে থেকে; সে দেশের থেকে অসুখের সময় কেটে পড়ার মাঝে “চাচা আপন প্রাণ বাঁচা” জাতীয় আত্মকেন্দ্রিকতা; পরোপকারী কোমল অথচ সাহসী বাঙ্গালির উদার মনের পরিচয়ে মালিন্য এনেছে।
অন্যান্য দেশের যে নাগরিকেরা বিদেশ থেকে স্বদেশে ফিরেছেন; তারা সেসব দেশের সরকারের নির্দেশ অনুসরণ করেছেন। ক্যানাডা বা নিউজিল্যান্ডের অনাবাসীদের দেশে ফেরার কথা বলছি না। আমি বলছি ভারত-পাকিস্তানের অনাবাসীদের কথা; যারা করোনাকালে দেশে ফিরে সরকারের নির্ধারিত জায়গায় কোয়ারন্টিনে চৌদ্দ দিন কাটিয়েছে। ঢাকার হাজি ক্যাম্পের চেয়ে প্রতিকূল পরিবেশে বসে তাদের গান গাওয়ার ভিডিও দেখেছি। দুঃসময়ে মন চাঙ্গা রাখতে তারা জাহান্নামের আগুনে বসে পুষ্পের হাসি হেসেছে। অথচ এই এডজাস্ট করে নেয়া বা অভিযোজনের ক্ষমতা এককালে বাংলাদেশের মানুষের অনেক বেশি ছিলো।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রত্যন্ত গ্রামে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানোর সময় খড়ের প্রায় ভেঙ্গে পড়া ঘরে; কিংবা বন্যা প্লাবিত এলাকায় কাদার রাস্তা পাড়ি দিয়ে কোনমতে জীবন বাঁচিয়েছেন আমাদের অভিভাবকেরা। শরণার্থী শিবিরের কষ্টের জীবনকে হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন সবাই।
অথচ সেই বাংলাদেশের মানুষ হাজি ক্যাম্পের থাকার পরিবেশ দেখে নাক সিটকে “ফাক ইউ কান্ট্রি সিস্টেম” বলেছেন। আমরা তো জানিই আমাদের সিস্টেম ফাকড আপ। কিন্তু সেটাকে বিদেশ থেকে করোনাভাইরাস এনে আরো ভয়াবহ কলাপসের দিকে নিয়ে যাওয়া কী খুব সুবিবেচনা প্রসূত হয়েছে।
হাজি ক্যাম্পে থাকার পরিবেশ নেই বলে যারা নিজ দায়িত্বে বাংলাদেশের বাড়িতে ফিরে গেলেন ; দায়িত্ব জ্ঞান হীন ভাবে সমাজে মেলামেশা করে করোনাভাইরাসকে ঝাল-মুড়ি-মশলার মতো মাখালেন সেই অনাবাসিরা। এখন আবার চার্টার্ড বিমানে তারা ফিরে যাচ্ছেন; দেশের দফার রফা ফিশরোল করে দিয়ে।
দেশে এমনিতেই বণিকের মানদণ্ড আজ রাজদণ্ড; রাজদর্জিরা জিডিপি গ্রোথের দোকানদারি বাঁচাতে শ্রমিকদের কাজে ডেকে করোনা ভাইরাসের হালিম বানালেন; আর বললেন, গরীবের অন্য ধরণের এক শক্তি থাকে; তাই তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়না।
বাংলাদেশের নব্যধনিক এই অনাবাসী আর রাজদর্জিদের করোনাকালের এ আত্মকেন্দ্রিকতা; আত্মঘাতি ক্রিয়াকলাপ আমাদের আশাহত করেছে।
এমনিতেই দেশের মিডিওকার নীতিনির্ধারকেরা ছোট বেলায় পরীক্ষার খাতায় যেমন হাবিজাবি লিখতো; করোনাকালে তেমনি হাবিজাবি বিবৃতি দিয়েছে। এরা ছোট বেলায় ফেল করার মতো পরীক্ষা দিয়ে আশার সওদাগর হয়ে যেমন বলতো, ভালো পরীক্ষা দিছি পাশ কইরা যামুনে; করোনাকালের ব্যবস্থাপনা পরীক্ষাটা ফেইল করার মতো দিয়েও তারা আশার সওদাগর হয়ে বলেছে, করোনা পরীক্ষায় ভালোভাবে পাশ করে যাবে বাংলাদেশ। এখন যে কারণে বিপর্যয়ের সখাত সলিলে বাংলাদেশ।
অনাবাসীদের মধ্যে শিক্ষিত আরেকটি দল আছেন; যারা কারণে-অকারণে গায়ে বাংলাদেশের পতাকা জড়িয়ে দেশপ্রেমের জানান দেন; এমনভাবে দেশে ফিরে দেশের সেবায় অংশগ্রহণের কথা বলেন, যেন তিনি বাহুবলী। এই এটিচ্যুডটি খারাপ। দেশে যথেষ্ট সংখ্যক প্রফেশনাল মজুদ আছে। তাদের নতুন কোন বিষয় সম্পর্কে অবহিত করতে চাইলে; জুম কনফারেন্সে তা অনায়াসে করা সম্ভব । তাই বলে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো নদী সাঁতরে দেশে চলে আসার দরকার আছে বলে মনে হয় না।
আর বাংলাদেশে দলীয় লোকেরা খুব ইনসিকিওরড; ক্ষমতার একটা ছেঁড়া বস্ত্রখণ্ড নিয়েই তার দিনমান ছুঁচোর কেত্তন। সেইখানে গায়ে পতাকা জড়ায়ে প্রবাসী ডাক্তার আসতে দেখলে দলীয় কৃষ্ণের মুখ আরো গভীর কালো হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। তার আছে এই ক্ষমতার ত্যানাটুকু; ওটুকু পেঁচিয়েই দুবেলা দুমুঠো ভাত; একটা পোস্টিং-পদক; রাষ্ট্রীয় পিঠাপুলির আসরে কৃতজ্ঞতার হাত কচলানো।
এই নিয়ত ইনসিকিওরড দলীয় মানুষেরা আতংকিত হয়ে দেশে কাজ করতে আসতে চাওয়া প্রফেশনালকে রাবণের ভাগ্নে পরিচয়ের গোবর ছুঁড়ে মারলেও বিস্মিত হবার কিছু নেই। পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। দরকার কী বেচারা ক্ষমতা- ভিক্ষুকের তেলভাতে উৎপাত করার!
আত্মসমালোচনা করোনাকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এতে কারো ক্ষুব্ধ হওয়া অনুচিত। আমরা কেউই নির্ভুল মানুষ নই। কিন্তু আত্মসমালোচনার মাঝ দিয়ে আমরা একটু কম ভুল করতে শিখতে পারি বৈকি।
– মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক
Editor-in-chief, E-SouthAsia