বৃক্ষ সমুদ্র আর আত্মীয় পাখির গান
করোনাকালে জীবন অনিশ্চিত; প্রতিমুহূর্তের ফেসবুক হোমপেজে মৃত্যুর মিছিল। সুজাতাই আজ বুঝি সবচেয়ে সুখে আছে; শুনেছি তো লাখখানি রোগী তার; হীরে আর করোনাতে সারাদেশ মোড়া তার; বাড়ি জিডিপি গাড়ি দামী তার। করোনা ভাইরাস অলির মতো বার বার ফিরে আসে, বার বার ফিরে যায়। এভাবেই চলবে আগামি দুই-তিন বছর। স্প্যানিশ ফ্লুতে ঠিক যেভাবে ১৯১৮ থেকে ২১ ধরিত্রীকে ভালোবেসে আলিঙ্গন করেছিলো। ঠিক যেভাবে জীবনের শুল্ক নিয়েছিলো; সেই মারী; সেই একই ট্র্যাজেডির দেজাভুঁ আজকের বিভ্রান্ত বিষণ্ণ করোনাকাল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রেস কনফারেন্সগুলো ধীরে ধীরে বাংলাদেশ সরকারের প্রেস কনফারেন্সের মতো আশার ছলনে ভুলিয়ে রাখতে চায়; মৃত্যুযাত্রী বিশ্ববাসীকে। করোনার কোন ম্যাজিক সলিউশান তো নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত এর ভ্যাকসিন ও ওষুধ উদ্ভাবিত না হচ্ছে; ততক্ষণ পর্যন্ত; একসময়ের যক্ষার মতো রাজ রোগ সে কিংবা আরো বড় আততায়ী। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রেস কনফারেন্সের এই বিজ্ঞান বিবৃতি চর্চা থেকে বোঝা যায়; গবেষণাগারে আশানুরূপ সাফল্য আসেনি। অতীতেও বিভিন্ন মড়কের ওষুধ আবিষ্কারে দীর্ঘ সময় লেগেছে। রিমোর্ট কন্ট্রোলে টিভি কিংবা গাড়ি চালিয়ে; ঘরের দরজা খুলে কিংবা ড্রোন চালিয়ে বিজ্ঞানের গর্বে আলুথালু হলেই তো আর বিজ্ঞান শ্রেষ্ঠ হয়না। বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব লিপসার্ভিস নয়; নিজেকে একটু ইন শোনাতে নিজেকে বিজ্ঞানমনষ্ক দাবির প্রগতিশীল আলখাল্লা নয়।
এই যে মহাবিশ্ব; তার যে অপার বিস্ময়; যে নব নব সৃষ্টির অর্কেস্ট্রা; তার ঠিক কতটুকুই বা বিজ্ঞান জানতে পেরেছে। বিজ্ঞানের প্রতি এখন পর্যন্ত আমাদের যে অনুরাগ; তা আমাদের ধর্মের প্রতি অনুরাগের মতোই আবেগের বাড়ই। তোরা, বাইবেল, কোরান, ত্রিপিটক পড়ে আমরা যেমন চুমু খেয়ে রেখে দিই; বিজ্ঞানের বইও আমরা পড়ে চুমু খেয়ে রেখে দিই।
ধর্মগ্রন্থ পৃথিবীর সব জ্ঞান এক জায়গায় করে রাখলেও; তা পড়ে এর অর্থ অনুধাবনের স্থৈর্য ও ধী সব মানুষের নেই। বিজ্ঞান গ্রন্থের ব্যাপারটাও একই হয়ে রয়ে গেলো। আইনস্টাইনের পোস্টার টাঙ্গিয়ে জিনস- টি-শার্ট পরে কফি খেতে খেতে করোনাকালে চুল বেড়ে গেলে আইনস্টাইনের মতো হেয়ারডু করে সেলফি তোলা; দুটি বিজ্ঞান গ্রন্থের প্রচ্ছদ আপলোড করা; এইভাবে বিজ্ঞানের মন্দিরে নেহাত পূজা-অর্চনা করে; করোনাভাইরাস মোকাবেলা তো সম্ভব নয়।
তাহলে আমি কী করে বেঁচে আছি; আমি বেঁচে আছি করোনার সঙ্গে গভীর গোপন আত্মীয়তায়। মানুষকে কখনো আত্মীয় ভাবতে ইচ্ছা করেনা। মানুষ বড্ড একঘেয়ে। মানুষের অনেক প্রত্যাশার চাপ। এই মানুষের চাপে অর্থহীন কতগুলো সার্টিফিকেট জোগাড় করতে হয়েছে; সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে; যেখানে প্রাণখুলে কথা বলতে পারিনা; শুধু কথা বলার জন্য ভাবতে পারেন, শুধু ফেসবুকে কথা বলার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মামলা করে ছাত্রের বিরুদ্ধে; বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়; তার চাকরি খেয়ে ফেলা হয়। সেইরকম অচলায়তনের সার্টিফিকেটগুলো আরব সাগরে ভাসিয়ে দিলেও আর কিছু যায় আসে না।
এই মানুষ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের করোনাকালের মুখোশ পরা প্রতিবিম্ব দেখেও বুঝতে পারেনা; কেন করোনা তাকে মুখোশ পরিয়ে দিলো। করোনা দেখেছে, মানুষ ভালো মানুষের মুখোশ পরে; ধার্মিকের মুখোশ পরে, দেশপ্রেমিকের মুখোশ পরে, বিজ্ঞান প্রেমের মুখোশ পরে; কিন্তু একদিন ভুল করেও মানবপ্রেমের মুখোশ পরেনি; পরেনি নিসর্গ প্রেমের মুখোশ। করোনা তাই মানুষকে মানব আর নিসর্গ প্রেমের মুখোশ পরিয়ে দিয়েছে। এতেই যা সামান্য বাঁচার আশা মানুষের, বৃক্ষের, বালুকাবেলার কচ্ছপের, কৃষ্ণচূড়ার ডালে সুপ্রভাত বলে কিচির মিচির করে ওঠা দুই শালিকের।
মানুষের চেয়ে বেশি করে আমি পথে ঘাটে তাই দুই শালিকের দেখা পেতে চেষ্টা করেছি দেশে দেশে সকালে-দুপুরে বিকেলে। যেটাকে কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেয়, টিশার্ট পরা বিজ্ঞান ভাই। অথচ শালিক কখনো মিথ্যা বলেনা। যখন দুই শালিক সুখে থাকে; তখন আমারও সুখ; যখন এক শালিক নিঃসঙ্গ হয়, তিন শালিক ঝগড়া করে, আমার ভীষণ অসুখ।
একটা বেড়াল শুধু তিনদিন আমার বাসার প্রাচীরের ওপর বসে তাকিয়ে ছিলো অসহায় চোখে। তাকে একটু খাবারও দিয়েছিলাম; কিন্তু তাতে তার অশ্রু ফুরিয়ে যায়নি। আমি নিশ্চিত ভাবেই জানতাম এ বেড়াল আগে কখনো আসেনি; ঐ তিনদিন এসে তার পর আর কখনো আসেনি। ঐ তিন দিনের মাথায় আমার বাবা আমাকে ছেড়ে চলে যান। আমি সেই বেড়ালের অপেক্ষায় গাছ গাছালির দিকে তাকিয়ে কাঁদতে থাকি লুকিয়ে লুকিয়ে। মানুষ আমার কান্না দেখে ফেললে বিপদ। কান্না কেবল বৃক্ষের সামনেই নিরাপদ।
মানুষ তখনো করোনাকে অবজ্ঞা করে ত্রাণ সামগ্রী চুরি করছে, স্বাস্থ্য-সামগ্রীর ব্যবসা বসন্তে লালে লাল হচ্ছে; ভি আই পি দের জন্য কেয়ার মাউন্ট-এলিজাবেথ হাসপাতাল (সিএম এইচ) ব্যবহৃত হচ্ছে; আর নরোত্তম যারা; সেই জনমানুষ হাসপাতালের সামনের মাঠে মৃত্যু মুখে পতিত হচ্ছে। নরোত্তমের অবহেলায় মৃত্যু বা এইভাবে নাগরিকের সিসটেমেটিক ক্লেনজিং করা নীতি নির্ধারকের কারো মৃত্যু হলে, সেই গণহত্যার খলনায়কের প্রতি ফেসবুকে ঘৃণা জানালে; পুলিশ এসে মানুষকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
কী বিচিত্র এই রাষ্ট্র নামের বাইজি বাড়ি; কী বিচিত্র এই জিডিপিমাণ্ডি! এইখানে মানুষের জীবনের দাম নেই; এইখানে ভি আই পির মানসম্মানের বড় দাম। ভি আইপির শেষ কৃত্যে ভটভটি বাই গান গায়, এমন সোনার মানুষ হায়; মানুষের সেবায় জীবন দিয়েও; ঘৃণাগালি পায়!
জিডিপি মান্ডির ঝাড়বাতিতে বেহাগ-বেদনা; ওস্তাদ ধারাপাত খান তবলায় বোল তোলে, পা পা পা পাইক্কা; তেরে কেটে ধিন চেতনা নাইক্কা।
মানুষের এই বুলবুলি আখড়াই-এ ক্লান্ত হয়ে একটু মাঠে হাঁটতে গেলে; হঠাত কোত্থেকে সেই বড়াল নদীর কূল থেকে উড়ে আসা কোকিল গান গায়; এই ইট পাথরের কংক্রিটে।
এই কোকিল সেই শৈশব থেকে আড়ানি গ্রামের সবুজ সকালের হলুদগন্ধী মৌতাত। আমার আব্বা ঘুমিয়ে আছেন, বড়াল নদীর ধারে; যেখানে ফুলের গন্ধ, হলুদের ঘ্রাণ, বাতাসের হুই আর নদীর কলকলে এক নিরাপদ তন্দ্রার দারুণ আয়োজন।
মানুষ এসে খবর দিলো, একটা বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে; সব যাত্রী মারা গেছে; বেঁচে গেছে দু’জন; তার একজন আমার এক বান্ধবির ভাই। বান্ধবিকে জিজ্ঞেস করলাম, কী অবিশ্বাস্য ব্যাপার; এই লোকটা মানুষের জন্য কী এমন করেছেন; যে সম্ভাবনার অংকের ধ্রুব সত্য হলেন তিনি।
সে একটু খবর নিয়ে জানালো, দপ্তরের অল্প বেতনের কর্মীদের বেশী বেতন দিয়ে; নিজেরটা কমিয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলো সে। বিমানের সিন্দুক বিস্ফোরণ হলে কোন ডেভিড কপারফিল্ড তাকে বাঁচালো; এ প্রশ্ন আরো বেশি অনুসন্ধিতসু করে তুললো; মহাবিশ্বের অর্কেষ্ট্রা সম্পর্কে।
মানুষের ফেসবুকে গিয়ে দেখি, চরাঞ্চলের এক ইউপি চেয়ারম্যানকে তার চেয়ে বয়সে বড় এক সিনিয়র সিটিজেন পা ধুইয়ে দিচ্ছে রাস্তায়। ছোট ভি আইপি মাছ থেকে বড় ভি আইপি মাছ; “জিডিপি রাণীর দেশে” সবার আকাংক্ষা জিডিপি খনির শ্রমিকেরা এসে তাদের পা ধুইয়ে দেবে।
এসব খর্বচিন্তার মানুষ ফেলে তাই দীর্ঘাঙ্গিনী বৃক্ষের কাছে ফিরে যাই, তার শাখায়-প্রশাখায় সবুজ; তার কোটরে বাবুই পাখির ঘর; তার ডালে বসে আমার আত্মীয় কোকিল পাখিটি “কু” বলে ডেকে উঠলে; স্থবির জীবন আবার চলতে শুরু করে। হাওয়া চলতে থাকে; সমুদ্রের গর্জন শোনা যায়; মেঘের ডমরু ঘন বাজে ; আমি তখন বৃষ্টির অপেক্ষা করতে থাকি। করোনাজল ঝম ঝম করে পড়ে শার্সিতে।
– মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক
Editor-in-chief, E-SouthAsia