উট পাখির মত সাধারণ মানুষ বাঁচতে চাইলে মানা যায়, নানা সীমাবদ্ধতায় যুগ যুগ ধরে সাধারণ মানুষকে সে ভাবেই কম বেশি জীবনযাপন করতে হয়েছে। সাধারণত: চিন্তাশীল, শিক্ষিত, সচেতন, বুদ্ধিবৃত্তিক নানা শ্রেনী পেশার মানুষ সাধারণ মানুষের পক্ষে কখনো শুধু নিজের জন্য চিন্তা করতে গিয়ে তাবৎ সমাজের ভাবনা একা ভেবেছে। অনেকগুলো মানুষ সমকালে এক ভাবনা ভেবেছে। শুধু ভেবেই শেষ হয় নি। কালে এ সব বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী, গবেষক, জ্ঞানী ব্যক্তিদের হাত ধরেই সভ্যতা এগিয়েছে। তার জন্য অনেককে জীবনও দিতে হয়েছে। নানা নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছে। ভলতেয়ার, রুশো, কোপারনিকাস।সক্রেটিসকে বিষ পানে মরতে হয়েছে। যখনই সংস্কারের কথা বলা হয়েছে, যখনই পরিবর্তনের কথা, অন্ধকার সমসাময়িকতা থেকে উত্তরণের কথা বলা হয়েছে তখনই সমাজ রাস্ট্রের মাতাব্বররা বরাবরই তাদের বিরোধীতা করেছে। এ কালে যেমন সে সব কালেও তেমন তুমি কি রাজার থেকে বেশি বুঝো? রাজানুগত রাজ কবি বা রাজ গবেষক কি তোমার থেকে কম বোঝে? মুক্তির কথা উত্তরণের কথা বলা হলেই যুগে ষড়যন্ত্রী, ‘বিরাজমান শান্তি রাজ্যে’ (খুব কমই তেমন শান্তি থাকলেও) শৃংঙ্খলা বিপন্নের অপচেস্টাকারী, রাস্ট্রদ্রোহী ধর্মদ্রোহী নানা ট্যাগ দিয়ে শায়েস্তা করার চেস্টা চলেছে। আমাদের দেশে এমনকী সামরিক শাসনামলেও সাধারণ মানুষের পাশাপাশি এমন কিছু মানুষ ছিলেন যারা অকুতোভয়ে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কথা বলেছেন। আবার উল্টো কিছু মানুষ ক্ষমতার ছিটেফোটায় ধন্য ধন্য করে কুখ্যাত জেনারেলকে কবি বানিয়েছে।
কিন্তু দেশের তাবৎ প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়তে দেখেও আজ বুদ্ধিজীবী সমাজ যেন প্রতিজ্ঞা করে চুপ থাকার শপথ নিয়ে বসে আসে আছে। সিলেকটিভ প্রতিবাদীর ভূমিকা নিয়েছেন কেউ কেউ। এমন দু:সময়ে কবি সুফিয়া কামালের শূন্যতা বড় বেশি করে অনুভূত হচ্ছে।
কেন অনুভূত হচ্ছে? নারী শিক্ষা বিস্তার, নারী সমাজের আত্নউন্নয়ন উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা, তাঁর কবিতা, কাব্য, বীরাঙ্গনাদের পূণর্বাসনের জন্য তাঁর ভূমিকা, উদার গণতান্ত্রিক সাম্যভিত্তির সমাজ বিনির্মানে নিরন্তর প্রচেস্টা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও একে সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে তাঁর আপসহীন ভূমিকা, সব কিছু ছাপিয়ে সমাজ সংসারের তাবৎ অন্যায় অবিচার রাস্ট্রের নানা রকম নিপীড়নের বিরুদ্ধে আজীবন প্রতিবাদী ছিলেন তিনি।
গত দশকে মানুষের কথা বলার অধিকার যখন সংকোচন করা হয়েছে, প্রধান বিচারপতিকে জোর করে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে, নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করে জনসেবার মনোপলি কারবার কুক্ষিগত করে বিতর্কিত ব্যবসায়ী আমলা রাজনীতিবিদদের ক্ষমতায়িত করার যে অশুভ পথে দেশকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, বেশি পাস করানোর যে শিক্ষা ব্যবস্থা বলবৎ করা হয়েছে, ব্যাংক ঋণ খেলাপী এবং লুটেরা ব্যবসায়ীদের যেভাবে পাবলিক মানি লুট করার সুযোগ দেয়া হয়েছে, গণমাধ্যম ও ব্যক্তির বাক স্বাধীনতাকে যেভাবে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে, সেখানে বুদ্ধিজীবীদের সেভাবে প্রতিবাদ সে রকম শোনা যায়নি। এক্ষেত্রে কবি সুফিয়া কামালের শূন্যতা বড় বেশি করে অনুভূত হচ্ছে। এখন টিএসসিতে নারী লান্ছিত হলে, কথায় কথায় গরীব মানুষের জীবন জীবিকার উপর রাস্ট্র নিপীড়ক হয়ে হস্তক্ষেপ করলে, এই করোনাকালে দরিদ্র পোশাক শ্রমিকদের দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে তাদের গণহারে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হলে, রাস্ট্রীয় বাহিনীর গুম খুন বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রায় প্রতিবাদশূন্য বুদ্ধিজীবীতার কালে তিনি হতে পারতেন প্রতিবাদের দীপ্ত মশাল। জাতির বিবেক হিসেবে অন্তত: এই একজনের কাছ থেকে জাতি আশা করতে পারতো নির্মোহ প্রতিবাদ। তিনি নেই। তাই প্রতিবাদও যেন নেই। অনুগ্রহপ্রার্থী বুদ্ধিজীবীতার কালে গণমানুষের পক্ষে কথা বলার জন্য, সোচ্চার প্রতিবাদ করার জন্য একজন সুফিয়া কামালের শূন্যতা কি আর কখনো পূরণ হবে? সম্ভবত: তা এত সহজে আর হচ্ছে না।এখানেই কবি সুফিয়া কামালের ব্যক্তিত্বের সার্থকতা, এখানেই যুগ যুগ ধরে অনুভূত হবে তাঁর প্রাসংগিকতা।
– শাহ আলম ফারুক
মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী
সম্পাদক, সোজা কথা ডটকম
faruk69@gmail.com