আমরা সৃজনশীল কাজ বলতে বুঝি কবিতা-গল্প লেখা, ছবি আঁকা, ফিল্ম বানানো, গান গাওয়া। কিন্তু উদ্যোক্তা হওয়া যে পৃথিবীর অন্যতম সৃজনশীল আনন্দের কাজ সেটা আমরা সেভাবে ভেবে দেখিনা।
বাংলাদেশের বিশিষ্ট উদ্যোক্তা লতিফুর রহমানের চলে যাওয়ার ক্ষণটিতে মনে হলো; এই ক্রিয়েটিভ আইকনকে নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। নইলে আমাদের নতুন প্রজন্ম সাফল্যের বাঁধা ছকে নাচতে গিয়ে জীবন হারিয়ে ফেলবে।
লতিফুর রহমানের প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে উনার শিষ্টাচার। আমাদের দেশে দুটি টাকা পয়সা হলে খোকন সোনারা সুইমিংপুলে কাইত হয়ে কাতলা মাছের মতো ভেটকি দিয়ে ছবি তোলে; কীসব ভাব একেকজনের; ধড়াম কইরা প্রাডো হাঁকাইয়া মুখ ব্যাকাইয়া মার্লবরো লাইটস ফুঁকার সময়। বডি ল্যাঙ্গুয়েজই চেঞ্জ হয়ে যায় একটু টেকাটুকা হলে।
অথচ লতিফুর রহমানের সঙ্গে যার একবার দেখা হয়েছে; তিনি জানেন কেউ বলে না দিলে বোঝার উপায় নেই; উনি বাংলাদেশের সফল সৃজনশীল উদ্যোক্তাদের একজন। শিক্ষিত-পরিশীলিত-সংস্কৃতি প্রিয় একজন মানুষ; কাজের ধ্যানে নিমগ্ন। কিন্তু সিঁড়িতে বা লিফটে কারো সঙ্গে দেখা হলে একটু মিষ্টি হেসে একটা মন্দ্র যোগাযোগ তিনি তৈরি করতেন।
এই লোকের জীবনের উদ্দেশ্য টাকা কামানো ছিলোনা; এ ছিলো বিভিন্ন রকম উদ্যোগ নিয়ে সেটাকে টিমওয়ার্কের মাঝ দিয়ে একটা সফল গন্তব্যে নিয়ে যাবার আনন্দ।
বাংলাদেশে এমন ব্যবসা-উদোক্তারাই কিন্তু ঐতিহ্যসঞ্জাত। পোশাকে-জীবন যাপনে সাদাসিধে; অথচ মাকড়সার জাল বোনার নৈপুণ্যে নানারকম ব্যবসা উদ্যোগ ছড়ানোর আনন্দে মাতোয়ারা। একটা সুর সৃষ্টি করে সুরকার যে আনন্দ পান; লতিফুর রহমানের মতো উদ্যোক্তার উদ্যোগও তো সেরকম সুরেরই সাধনা। ব্যবসায়ী ছান্দসিক হলে; তার প্রতিষ্ঠানে ছন্দ থাকে। লতিফুর রহমান ছান্দসিক বলেই উনার ট্রান্সকম গ্রুপের ইলেকট্রনিকস কারখানাতেই যান; কিংবা মিডিয়া কারখানাতেই যান; দেখবেন অত্যন্ত সুশৃংখল এক ছন্দে চলছে সবকিছু।
আমাদের সমাজে শৃংখলা মানেই থানার দারোগার মতো চিল্লায়ে পাড়া মাথায় তোলা। কিন্তু লতিফুর রহমানের শৃংখলা হচ্ছে সংগীতের স্বরলিপির শৃংখলা। উনার গড়া প্রতিষ্ঠানগুলো এ কারণে টিকে যাওয়ার সব বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। কবিতা টেকা, ফিল্ম টেকা, গান টেকা, উপন্যাস টেকা, চিত্রকর্ম টেকার মতোই ধ্রুপদী হতে পারে ব্যবসা-উদোগ টেকার ব্যাপারটা।
সাংবাদিকতা পেশাটায় টাকা-পয়সা কম; কিন্তু সমাজের সব হাঁটাপথের মানুষের সঙ্গে দেখা হওয়া-কথা হওয়ার সুযোগ এতো অবারিত যে; এই আনন্দের তুলনা মেলা ভার। আর সাংবাদিক সামাজিক হলে; তার জন্য পৃথিবীর যে কোন মানুষের চা-কফির দাওয়াত পাওয়া সাহজিক একটা ব্যাপার হয়ে যায়।
সাংবাদিকের নিজের হীরা-জহরত কিছুই থাকে না; কিন্তু জীবনে চলার পথে যেসব হীরার মতো খাঁটি মানুষের দেখা পায় সে; তা দিয়ে হীরের নাকছাবি বানানোর মতো সামর্থ্য গড়ে ওঠে তার।
লতিফুর রহমানের স্মৃতিচারণ তাই; একটি হীরের নাকছাবি বানাতে স্মৃতির ধোয়ায় ঘোলা চশমা পরে স্বর্ণকারের আনন্দময় সকালের মতো।
প্রথম আলো ভবনে এককালে সপ্তাহে একবার অন্ততঃ যেতেই হতো একটা তির্যক রচনা জমা দিতে। আমার বন্ধু মুনির রানা
প্রথম আলোতে ‘ছুটির দিনে’ নামে একটি সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন প্রকাশ করতো। এই যাওয়া আসার পথে মাঝে মধ্যে সিঁড়িতে দেখা হয়েছে লতিফুর রহমানের সঙ্গে। উনার দেহভঙ্গি দেখে মনে হতো; উনিও হয়তো কোন লেখকই হবেন। আমি উনাকে অনেকদিন পর্যন্ত চিনতাম না। লতিফুর রহমানও নিভৃতচারী উদ্যোক্তা। আর আমরা সেসময় এতোসব আড্ডা-হুজ্জোতিতে ব্যস্ত থাকতাম যে; সম্পাদক মতিউর রহমান ফিচার বিভাগে ঢুকে দ্রুত বেরিয়ে যেতেন হৈ চৈ থেকে বাঁচতে। আমি এবং আমার মতো অপরিচিত চেহারার লেখকেরা এমন একটা ভাব নিয়ে বসে সেখানে; যেন প্রথম আলোর মালিকপক্ষ। অথচ কোন কিছুর মালিক মনে না হওয়া লতিফুর রহমানকে উনি বোর্ড রুমে বসিয়ে রেখে হৈ চৈ থামাতে এসেছেন।
এক পরিচিতের বাসায় দেখা হলে লতিফুর রহমান ঠিকই সেই প্রথম আলোর সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ দেখা হওয়ার কথা মনে করতে পারেন। জীবনে যে কোন উদ্যোগে সফল হতে গেলে এমন স্মৃতিতীর্থ হতে হয়। ভুইলা যাওয়ার ব্যারাম মানেই মিডিওক্রেসি। আর বিরাট হয়ে পড়ার আত্মম্ভরিতা মানে পতন আসন্ন।
লতিফুর রহমান শোনেন বেশি; বলেন কম। আমিও বিতর্কের ডায়াসে কিংবা লেখার খাতা ছাড়া যাপিত জীবনে কথা কম বলি অপরিচিত মানুষের সামনে। আর সিনিয়ারদের অভিজ্ঞতা বেশি; সেগুলো শুনতে কম কথা বলা বাঞ্চনীয়। নীরবতা ঘুঁচাতে উনিই গল্প করলেন। শিল্প-সাহিত্য-সংগীত-ভ্রমণ-যাপিত জীবনের গল্প। এই গল্পে আমিত্ব বর্জিত আনন্দ উপস্থিত। বিনয়ে বিলীন আমরার সৌন্দর্য্য ছাড়া লতিফুর রহমান হয় না।
আমাকে কেবল একটা কথাই জিজ্ঞেস করেছিলেন, প্রথম আলোতে
লেখা দেখি; মেরিল-প্রথম আলো আসরে দেখিনা যে। সম্পাদক মতিউর রহমানও একবার এই অনুষ্ঠানের কার্ড বিতরণে গিয়ে খান আতা-নীলুফার ইয়াসমীনের বাসা বলে আমার বাসায় ঢুকে পড়ে বলেন, আরে তুমি এখানে; অনুষ্ঠানের কার্ড পাইছো; তোমার বন্ধু মুনির কেমন বন্ধু যে তোমাকে কার্ড দেয়নি; বলেই দুটি কার্ড দিয়ে বললেন, বউ-বান্ধবী যাকে খুশী নিয়ে এসো।
সোনালি যুগের মানুষ লতিফুর রহমান-মতিউর রহমানের মাঝে এই সব ছোট খাট ডিটেইলের দিকে নজর রাখার ক্ষমতাটাই উনাদের সফল করেছে। আমাদের প্রজন্মের সমস্যা এই ডিটেলিং-এ; সন্তান প্রতিম কিংবা অনুজ প্রতিমদের ছোট ছোট আনন্দের দিকে খেয়াল রাখাটা উনাদের দেখে রপ্ত করতে হবে আমাদের।
আমাদের সমাজ যেখানে “চোখের বদলে চোখ” প্রতিশোধ স্পৃহায় অন্ধ; একই বাবা বা স্বামীর কান্দন যেইখানে যুগের পর যুগ ভাঙ্গা রেকর্ডের মতো বাজে; সেইখানে লতিফুর রহমান নিজের সন্তান হারিয়ে বিচার বিভাগের রায় আর ন্যায়বিচারের জন্য ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করেছেন। প্রজ্ঞার মানুষেরা অপরাধী নয়; অপরাধের বিচার চান; যাতে সমাজে অপরাধ প্রবণতা না থাকে। আর অপ্রজ্ঞার মানুষেরা সস্তা ছবির মতো পিটিয়ে পিটিয়ে খলনায়ক হত্যা করে বুভুক্ষু দর্শকের হাততালি নেয়।
লতিফুর রহমান, সরকারি বা কর্পোরেট জগতের ন’টা পাঁচটা চাকরি, গ্রিণ কার্ড নিয়ে আম্রিকা চলে যাওয়া এই সব সাফল্যের শর্টকাটে না গিয়ে; উদ্যোক্তার চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। ঝুঁকি নিয়েছেন। তাই আজ আমরা তাঁকে স্মরণ করছি সৃজনশীল উদ্যোগের আইকন হিসেবে।
লতিফুর রহমান এই পুরো দক্ষিণ এশিয়ার বিরল বিনিয়োগকারীর একজন; যিনি মিডিয়া ব্যবসায় এসে; সম্পাদকদের কাজে নাক গলাননি। সম্পাদকীয় নীতির প্রতি অবিচল শ্রদ্ধার নিখুঁত মানুষ তিনি। লতিফুর রহমানের মতো উদার আধুনিক পরিশীলিত উদ্যোক্তা পেলে মিডিয়া জগতে এরকম বাতাবি লেবুর ব্যাপারীর বাম্পার ফলন হতোনা। সব ব্যবসাই ব্যবসা; কিন্তু মিডিয়া ব্যবসা করার জন্য লতিফুর রহমানের মতো মেজাজ চাই; যে মেজাজ সতত শান্ত-স্নিগ্ধ-সৌম্য-স্থিতধী।
– মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক
Editor-in-chief, E-SouthAsia