সঙ্গীবাদ বিরোধী অভিযান চিত্রনাট্যের এ পর্যায়ে শীর্ষ সঙ্গীনেতা ওসামা বিন সাহেদকে গ্রেফতারের গর্বে এলিট ফোর্সের মেরিনদের ফটোসেশান হয় (তোরাবোরার ঢালে)। সাহেদ হাকল বেরি ফিনের মতো কাদা মেখে কাঁদো কাঁদো চেহারায় বলেও, তবুও ছবি তুলুন; ছবি না তুললে আমার শইলডা ভালো লাগে গো কালা জ্যাডা। সঙ্গীবাদ বিরোধী অভিযানে এশিয়ার বৃহত্তম সাফল্য আল-করোনা শীর্ষ সঙ্গী নেতা ওসামা বিন সাহেদ গ্রেফতারে ব্ল্যাক হাউজের গর্বিত প্রেস বিফ্রিং শুনে সহমত ভাইয়েরা চুকচুক করে বলে, “আইজ থিকা দ্যাশ পোকিত ও পোচন্ড দূর্ণীতিমুক্ত হইলো।”
ক্ষমতা বৃক্ষের কোটরে সাপ লুকিয়ে রেখে; বাতাবি লেবু মিডিয়ায় কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হবার টান টান উত্তেজনার জনমনোরঞ্জক খবরের মাঝে আসলে যা ধরা পড়ে তা “সাপ খুঁড়তে কেঁচো”!
ক্ষমতা কী জাতিস্মর; নইলে কেন ইয়াহিয়া ভবন থেকে বিপদের বাঁশী ভবন-হাওয়া ভবন-চেতনা ভবনের ঝাঁপিতে একইরকম নাগ-নাগিণীর খেলা! আর ন্যায়বিচারের হাওয়াই মিঠাই আয়োজনে সাপ বলে কেঁচো ধরার ছদ্ম সাফল্যের পুতুল নাচের ইতিকথা ফিরে ফিরে আসে।
এই ক্ষমতার সাপের খেলায় আপনাকে সবসময় দাবা বোর্ডের রাজা বাঁচিয়ে খেলতে হবে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে জমিদার বা মাতবর পুত্রেরা শলা করে সিন্দুক ভেঙ্গে ‘নাগমণিহার’ গায়েব করে দিলে; তখন সেই নাগমণি হার চুরি হওয়ার গল্পকে ঢেকে দিতে; গ্রামের ছোট ছোট চোর বাবর, সাহেদকে কাদা মাখিয়ে গলায় জুতার মালা পরিয়ে ঘুরানো হতো। গ্রাম বাসী ছ্যা ছ্যা করতো ‘কেষ্টা ব্যাটাই চোর’ বলে জিভ কেটে। আর এইভাবে ভেংচি কাটা ভোদড়ের জনপদ প্রবল প্রশান্তিতে ন্যায় বিচারের আমের আচার চাটছে শতকের পর শতক।
“মূল্যবোধের সোনা- আমাদের চেতনা” চুরি যাওয়া নিয়ে চিন্তিত নয় অপুষ্টিতে শুকিয়ে যাওয়া মস্তিষ্কের গ্রামবাসী; ওরা ফকিন্নির ঘরের ফকিন্নির চুরিকে “চোর চোর চোর” বলে; “অক্ষম চেতনা” দোলানোকেই ন্যায় বিচার মনে করে।
জমিদার পুত্রেরা যাদের নিয়োগ করে গ্রাম-ডাকাতিতে তারা গরীব ঘর থেকে আসা; সুতরাং জমিদার পুত্রের আগা-পাছটা বাঁচিয়ে; নামের সঙ্গে শেখ, রহমান, সরকার, চৌধুরী নেই; এমন অবেয়াই-অচাচাত-ফুফাতো-অখালাতো “গোলির ধারের ছেলেটিকে” কালো পোশাকের নৃশংস খুনে প্রহরী দিয়ে ধরিয়ে; টান টান উত্তেজনার ‘ডাকাত-পাকড়াও’ যাত্রা-নাটক করে; গ্রাম জুড়ে ন্যায় বিচারের আমের আচার বিক্রির ক্ষণে; চাকরস্য চাকরেরা এসে প্রশান্তিতে আঙ্গুল চেটে চেটে বলে #ধন্যবাদমাতবর
গরীবের ছেলেকে ফুটসোলজার বানিয়ে কালো পোশাক পরা প্রহরী দিয়ে সাদা পোশাকের প্রহরী ওরফে গরীবের ছেলেদের “চোর-পুলিশ” খেলার অন্ধকার অষ্টাদশ শতাব্দীই হচ্ছে চির বিচারহীন এই বিজন গ্রাম। গ্রাম্য অভিজাততন্ত্রের গেম অফ থ্রোনসে গরীবের ছেলে নিয়ে নরভোজি ভিলেজ পলিটিক্সটাই নাগ-নাগণীর খেলা। বিষাক্ত ছোবলে সবুজ জনপদের সুখ কেড়ে নেবার নিষ্ঠুরতম খলতা।
কলংকিনী সাবরিনা ও বিশুদ্ধ টেকাস্তান
সাধারণ সময়ের কথা বাদই দিচ্ছি; এমনকী একাত্তরের যুদ্ধের সময়েও শেখ বাড়ি, রহমান বাড়ি, সরকার বাড়ি, চৌধুরী বাড়ির মেয়েরা কিন্তু নিরাপদে ছিলো। কারণ খানেদের খুনেরাও সবসময়ই জানে ‘হু ইজ হু’। দক্ষিণ এশিয়ার সামন্ত-ব্যবস্থায় ধর্ষকও জানে; জমিদার বাড়ির মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকানো যাবে না।
কিন্তু আমাদের জনপদের হ্যাভস নট; নরসিংদির পাপিয়া কিংবা ঢাকার সাবরিনার তো স্বপ্ন থাকতে নেই। যদি সে প্রাসাদে ঢোকার স্বপ্ন দেখে; শেষপর্যন্ত তাকে সেখানে প্রবেশ করতে হয় নাচনেওয়ালী হয়ে। কখনো জনগণকে ন্যায়বিচারের আমের আচার খাওয়াতে হলে; পালতো প্রহরী লেলিয়ে দেয়া হয় তাদের গ্রেফতার করতে। যারা তাকে “বাবুদের জুড়িগাড়ি’-তে তুলে নিয়ে গিয়ে নাচালো; সেই লালসার লালামাখা খোকন সোনারাও তখন এক একজন ধর্মযাজক হয়ে অভিসম্পাত দেয়, “নষ্ট-ভ্রষ্টা নাচনেওয়ালী” বলে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর এই সমাজ ব্যবস্থায় দেশের সম্পদ লুট করা চৌধুরী ও সরকারের মেয়েরা তখন চার্টার্ড বিমানে প্যারিসের পথে; কিংবা লুটের পয়সায় এমেরিকার আইভী লীগের মতো প্রেস্টিজিয়াস ইউনিভার্সিটির জুম ক্লাস করে। ফেসবুক নাড়াচাড়া করতে গিয়ে হাস্কি ভয়েসে বলে, “বাটপারি বাঈয়ের ওষ্ঠরঞ্জনি”; হাহাহা; হিলারিয়াস; স্ক্যান্ডালাস।
হ্যাভস-নটের গল্প; তার ওপর চলা অকথ্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন আমাদের গড়পড়তা চোখে রগড়ের বিষয়। গরীব কৃষক কিংবা সৎ কেরানির মেয়ে প্রাসাদে প্রবেশের স্বপ্ন দেখলে সে কেবল নাজিম হিকমতের উপন্যাস কিংবা সুকান্তের কবিতার মতো; নৈশভোজের টেবিলের চিকেন কারি হিসেবে পরিবেশিত হতে পারে। সামন্ত সমাজ ও তাদের মিডলম্যানেরা “পাপিয়া বাঈ” কিংবা “বাটপারি বাঈ”-কে নাচায়; পুতুল নাচের মতো করে। তার প্রেম থাকতে নেই; ভালোবাসার অধিকার নেই; আর “ভুল” করলে তার ক্ষমা নেই; ন্যায়বিচারের তরবারিতে বিখণ্ডিত হয় তার মস্তক। সে ছিন্ন-মস্তক দেখে হাততালি দেয়; বোধহীন দর্শক; আজকাল এক-আধটু রক্তের স্বাদ সে-ও পেয়েছে।
যতক্ষণ পর্যন্ত সামন্ত জলসায় পিউ পাপিয়া ধরে নিয়ে যাওয়া মিডলম্যানেরা দর্শকের কারো মেয়ের দিকে হাত না বাড়াচ্ছে; ততক্ষণ তারা বুঝবে না; পাপিয়া, সাবরিনাও আমাদের মেয়ের মতো; যার স্বপ্ন ছিলো; কিন্তু তার স্বপ্ন পূরণের সামর্থ্য না থাকায়; তাকে সাপলুডুর জীবনে টেনে নিয়ে গেছে; ললিতলোভনকান্তি মাংসের সর্দারনীরা; সংরক্ষিত অলংকার হয়ে যারা গরীবের ঘর থেকে অপরাজিতা সংগীতা ধরে এনে দেয়।
তারপর যা হয়; মেয়েটি পরাজিত হয়; সংগীত হারা হয়। আর এলিট হাস্কি ভয়েস রাজদুলারীরা তখন, আসন্ন ‘পাপিয়াজান’ ছবির মানবিক চিত্রনাট্য তৈরি করে; আসছে নারীবাদী উপন্যাসে ফাটিয়ে দেবার প্রস্তুতি নেয়, অপরাজিতা চৌধুরীরা।