১। মির্জা আব্বাসের কল্যাণে নুরুল ইসলাম বাবুল ভূমিদস্যু পরিচয় পেয়েছেন সত্য, তবে বসুন্ধরার মালিক আহমেদ আকবর সোবাহান সহ বড় বড় ভূমিদস্যু বাংলাদেশে রাজার হালতেই আছে। শীর্ষ বেসরকারি ভুমিদস্যু বসুন্ধরা, ইস্টার্ণ, স্বদেশ, মধুমতি, যমুনা, আমিন মোহাম্মদ, এস আলম, বেস্টোয়ের মিজান, হলমার্ক, ডেস্টিনি ইত্যাদির মত খোদ বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাহিনী, বাংলাদেশ পুলিশও এদেশের মানুষের জমি হাতানো এবং নদী অববাহিকার নির্বিচার ভরাটের সাথে যুক্ত! একই অভিযোগ রাজউকের বিরুদ্ধেও। অভিযোগ আছে বুয়েটকে দিয়ে বলানো হয়েছে যে, “বালু নদী” নদী নয় তাই তার অববাহিকা নাই, বালু খালের নিকটস্থ অঞ্চল ভরাট করা যাবে। বালু নদীর অববাহিকায় ‘ডিফেন্স অফিসার্স্ হাউজিং সোসাইটি’ বা সংক্ষেপে ‘ডিওএইচএস‘ এর মত করে গড়ে উঠছে ‘পুলিশ অফিসার্স্ হাউজিং সোসাইটি’ বা সংক্ষেপে ‘পিওএইচএস’। তুরাগ তীরেও এমনটাই হয়েছে।
ফলে নদী ও জলাভূমি রক্ষা এবং ড্যাপ বাস্তবায়নে বাঁধা নুরুল ইসলাম বাবুল একা নন, এখানে আসছে শীর্ষ ভূমিদস্যু বসুন্ধরার সোবাহান সহ বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাহিনী, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এবং রাজউকও। বাবুল এই লাইনের একজন মাঝারি বা বড় খেলোয়াড় শুধু। আসলে মূল সমস্যা বাংলাদেশের আরবানাইজেশান মডেল। এখানে প্লট জমি বিক্রি করে কালো টাকা তৈরির উৎসাহ যেমন আছে, তেমনি লটারিতে প্লট বরাদ্দ করে ‘বাড়ীওয়ালা’ নামক উচ্চবিত্ত তৈরি আর ভুমীহীন তৈরির বৈষম্যপূর্ণ সিস্টেমও জারি আছে। পাশাপাশি ভূমিকে আবাসন, শিল্প, কৃষি ও সংরক্ষিত জলাশয় হিসবে রেজিস্টার্ড করার কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে শহরের, নগরায়নের কোন সীমা নেই, নেই সংকুচিত হতে থাকা কৃষি ভূমি ও জলাশয় রক্ষার স্থায়ী পরিকল্পনা।
নিউ সিটি ডেভেলপমেন্ট এর টেকসই অলটারনেটিভ হিসেবে প্লট-জমি কিংবা লটারি-প্লটের পরিবর্তে সমবায় ভিত্তিক ভার্টিক্যাল ইনফাস্ট্রাকচার (সিঙ্গাপুর কিংবা চাইনিজ মডেলও আছে বিকল্প হিসেবে) এবং পরিবেশ বান্ধব আধুনিক নির্মাণ শৈলীর বাস্তবায়ন নিয়ে আমরা আগেও লিখেছি। রাজউক সিটি ডেভেলপমেন্টের নামে নিজেই ধনী ও কালো টাকার মালিক তৈরির শুরু করেছে বলেই বেসরকারি ভুমিদস্যরাও উৎসাহ পেয়েছে।
যেখানে নগরে ৫-৭% এর বেশি খালি নাই, আবাসন সমস্যা অতি প্রকট, মধ্যবিত্ত বাসা বাড়ির ভাড়ার চাপে পিষ্ট, সেখানে রাজউক স্কুল বাজার হাস্পাতাল সহ সকল নাগরিক সুবিধা সম্পন্ন অতি উচ্চ বহুতল কাঠামোর দিকে নজর না দিয়ে ‘উত্তরা’ সহ একের পর এক জলাভূমি ভরাট প্রকল্পেই উৎসাহ দিয়ে গেছে। এই প্রক্রিয়া ফলো করেছে বেসরকারি ভূমিদস্যুরা। এতেই ভরাট হয়েছে ঢাকা ও ঢাকার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের খাল, বিল, নালা ও ফসলী জমি। ভূমি হারিয়েছেন বহু কৃষক, জেলে, সাবেক পাটকল শ্রমিক। বাবুল গত হয়েছেন। সোবাহানরা বেঁচে আছেন, আছেন আমাদের ‘সর্ব কাজে পারদর্শী’ বাহিনী গুলো এবং প্রশাসন। কিন্তু রাজউকের আর্বানাইজেশান মডেল, প্রশাসন ও অর্থনীতি বিকেন্দ্রীকরণ না হলে, কৃষি ভুমি ও জলাশায় শনাক্ত ও সংরক্ষণ না হলে- ভূমিদস্যুতার চক্র চলতেই থাকবে, বাবুলের বদলে অন্যদের হাত ধরে।
২। ভূমিদস্যু, বদমেজাজি বাবুল বহু কারনে বিতর্কিত হলেও তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা, ৪৬ বছরে ৪১ প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন। লক্ষ লক্ষ আন স্কিল্ড, সেমি স্কিল্ড ও স্কিল্ড শ্রমিকের কর্মসংস্থান তৈরি করেছেন। শুনা যাচ্ছে, আবদুল মোনেম, লতিফুর রহমানের মত উনিও ঋণ খেলাপি নন।
৯০ এর পরে মুক্তবাজার অর্থনীতির সুবিধা নিতে রাজউকের দেখানো ‘সিটি ডেভেলপমেন্টের’ পথে নেমে আন্ডারওয়ার্ড সন্ত্রাসী নেটোয়ার্ক গড়ে তুলে বাবুল’রা পূঁজি সংগ্রহের জন্য ভূমিদস্যুতায় জড়িয়েছে। অথচ একটা স্বচ্ছ ও বিকাশমান অর্থনীতির দেশে পূঁজি সংগ্রহে ভূমিদস্যুতার প্রয়োজন ছিল না যদি সরকার তার আবাসন, ভূমি ব্যবস্থাপনা, শিল্প ও কর্মসংস্থান পরিকল্পনা সমন্বিত ভাবে এগিয়ে নিত।
৩। আব্দুল মোনেম, লতিফুর রহমান এবং নুরুল ইসলামের মৃত্যুর পরে দেশের অপরাপর শিল্পপতিদের মধ্যে একটা অজানা মৃত্যুভীতির আশঙ্কা তৈরি হবে বলে মনে করছি। এতে শিল্প গ্রুপ গুলোর কাজে ব্যাঘাত ঘটতে পারে, ইতিমধ্যেই করোনার কারনে শিল্প ও কর্মসংস্থান ভুগছে। এমতাবস্থায় সরকারকে শিল্প ও কর্মসংস্থান রক্ষায়, নমনীয় কর ও শুল্ক নীতির দিক থেকে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার দিক থেকে আন্তরিকতার পরিচয় দিতে হবে। (রাতের ভোটে নির্বাচিত অবৈধ, জবাবদিহিতাহীন ও সর্বেসর্বা লুটেরা সরকার এটা কিভাবে করবে এটাই বড় প্রশ্ন)। নতুবা ঝুঁকিপূর্ণ টালমাটাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সময়ে শিল্প গ্রুপ গুলো কর্মী ছাটাই করে পাচার ও বৈধ সম্পত্তি হস্তান্তরে লিপ্ত হতে পারে।
এর আগে প্রাণ ও আকিজ গ্রুপের মূল মালিকের স্বাভাবিক মৃত্যুতে গ্রুপ গুলোর ব্যবসা সম্প্রসারণে সমস্যা হয়নি। মৃত্যু গুলো স্বাভাবিক ছিল বলে ডিসিশান, স্কিল, এসেট এন্ড স্ট্রাটেজি মাইগ্রেশান ফেইজ ছিল সেখানে, যেটা বর্তমানে নাই। সেরা ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা শীর্ষ শিল্পপতিদের হঠাত মৃত্যুতে নলেজ, স্ট্রাটেজি, পিপল ম্যানেজমেন্ট ও এসেট ট্রান্সফারের দিক থেকে কৌশলগত ক্ষতির বড় বড় কিছু বিষয় থাকে। একটা বিষয় অতি গুরুত্বপূর্ণ যে, শিল্পপতিদের বাঁচিয়ে রাখা না গেলেও তাদের তৈরি করা কর্মসংস্থান বাঁচাতে হবে। পুরানো প্রতিষ্ঠিত গ্রুপগুলির মধ্যে অনেকগুলো যদি একসাথে অভিভাবক শূন্য হয়ে পড়ে তবে তাদের ব্যবসায় সংকোচনা আসার সাথে সাথে শ্রমবাজারে হঠাত অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। এটা আশা করা যায়না যে, সব গ্রুপের উত্তরাধিকারীরাই ব্যবসা পরিচালনার পরিপক্কতা অর্জন করে ফেলেছে। বলা দরকার যে, যে শিল্প গ্রুপ যত বেশি ইন্সটিটিউশনাল ভ্যালু ড্রিভেন হবে, সিস্টেম্যাটিক হবে, রেগুলেটরি স্টান্ডার্ডস ও ট্যাক্স কমপ্লায়েন্ট হবে এবং দুর্নীতি সহ আন্ডার গ্রাউন্ড নেগোশিয়েশানের প্রভাব মুক্ত থাকবে- ব্যক্তি মালিকের মৃত্যুতে তার তত কম ক্ষতি হবে। এই সত্যতা বাংলাদেশের অনেক শিল্প গ্রুপ উপ্লভদ্ধি করেনি। বহু গ্রুপ মাফিয়া স্টাইলে কোম্পানি চালায়। দুর্বৃত্ত রাজনীতি থেকে ‘রেন্ট সিকিং’ এর মাধ্যমে অবৈধ আয় করে বহু কোম্পানি জাতীয় রাজনীতির দুর্বৃত্ত একনায়কতান্ত্রিক মডেলেই কোম্পানি চালায়, সাক্ষাৎ উদাহরণ সিকদার গ্রুপ। এমতাবস্থায় সরকার ও প্রশাসন (ঘুষ ও লুটে লিপ্ত না হয়ে) কিভাবে এই শিল্প গুলোকে সুপথে এনে এদের তৈরি করা কর্মসংস্থান রক্ষা করতে পারে তার উপায়ও বের করতে হবে।
বাংলাদেশ সরকার শুরু থেকেই এই গুরুত্বটা বুঝেনি। এতগুলো বিজনেস টাইকুনের পর পর (স্বাভাবিক কিংবা অস্বাভাবিক) মারা যাবার সংবাদ এই অর্থও বহন করে যে, অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার চেষ্টা তেমন ছিল না, যতটা ছিল রাজনীতির ভিয়াইপি ও লুটেরাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও পালাতে দিবার চেষ্টা। শুরু থেকেই ছিল না করোনা প্রতিরোধের সমন্বিত টাক্সফোর্স। ফলে নেতা, সচিব, মন্ত্রী, শিল্পপতি সবাই এখন গণহারে মারা যাচ্ছেন।
যথাযথ তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে সন্ত্রাসী ব্যবসায়ী ও অসত উদ্যোক্তাদের আমরা নিয়মিত যৌক্তিক সমালোচনা করি। (চোরের দল কিভাবে চুরি করে এই আলোচনা অবশ্যই চলবে)। কিন্তু সব সমালচনার পরেও বলি মূল কর্মসংস্থান তৈরির কারিগরদেরও স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিতে হবে যথাসময়ে। ভুলে গেলে চলবে না, সরকার শ্রমবাজারের মাত্র ৩%কে নিয়োগ দেয় যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিন্ম। বাকি ৯৭% এর যারা চাকরি পান তাঁদের নিয়োগ আসে বেসরকারি খাত কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত থেকে। তাই আজকে একটা বড় প্রশ্নের উত্তর তৈরি করতে হবে সরকারকে, করোনার উদ্ভূত ভয়াবহ বেকারত্বের সমস্যা সে কিভাবে সমাধান করবে? আগের বেকারের সাথে কাজ হারানো নতুন বেকারের মিছিল থামাবে কে?
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক লেখক, গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ