ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ডঃ এমাজউদ্দীন আহমদ চলে গেলেন। চলে যাবার সময় হয়েছিলো উনার। একটা অত্যন্ত সক্রিয় জীবন যাপন করেছেন উনি। আমাদের কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন; ফলে নিয়মিত দেখা হয়েছে; কথা হয়েছে; শিক্ষক-ছাত্রের যে নৈকট্য গড়ে ওঠে সেটা হয়েছে উনার সঙ্গে। প্রিয় মানুষদের বিদায় জানানোর বিষণ্ণ সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে “ও মা আমি নয়ন জলে ভাসি”।
কারণ বাংলাদেশের সোনালী যুগের নায়কেরা; আইকনেরা ফিরে যাচ্ছেন গ্রিণরুমে; মঞ্চ দখল করে আছে এসেন্সহীন খলনায়কেরা; ভাঁড়েরা যারা হাসতে হাসতে মঞ্চ থেকে নেমে এসে দর্শকের পেটে ছুরি চালিয়ে দেয়। দর্শক গুম হবার এই ভয়াল কালে সেইসব মানুষেরা চলে যাচ্ছেন যাদের মাঝে প্রেম ছিলো; প্রীতি ছিলো; হৃদয়ের আলোড়ন ছিলো।
সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে মেধার ভিত্তিতে আসন বন্টন হওয়ায়; আমি প্রথমেই পেয়েছিলাম সিঙ্গেল রুম; পুকুর ধারে সবুজ জানালাওয়ালা একটি রুম। ছাত্রলীগের এক ক্যাডার সেটা দখল করে রেখেছিলো; আমার দিকে ক্রুর হাসি হেসে বলেছিলো, কোন জগতে থাকো ছোট ভাই! বিছানার ওপর বাংলা ছবির ভিলেনের মতো একটা আগ্নেয়াস্ত্র নেড়ে চেড়ে বলেছিলো, কোন রুমে গিয়া ডাবলিং করতে পারো কীনা দ্যাহো।
এরকম প্রত্যাখ্যানের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিই। দিল্লিতে গিয়ে সেন্ট স্টিফেনস কলেজে ইংরেজিতে ভর্তির বন্দোবস্ত করি। কিন্তু আম্মা আমাকে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠেলে পাঠান; বিনা যুদ্ধে নাহি দেবো সূচাগ্র মেদিনীর মহাকাব্যে।
এ কারণে উপাচার্যের অফিসে আমি নিয়মিত যেতাম, আমার জন্য বরাদ্দ কক্ষের ‘দখল’ নেবার ব্যাপারে একটা বিহিত করতে। ভিসি স্যারের সঙ্গে দেখা করা পৃথিবীর সহজতম কাজ। কোনদিন এক সেকেন্ড অপেক্ষা করতে হয়নি। মনিরুজ্জামান মিয়া আর এমাজউদ্দীন আহমদ; এই দু’জন ভিসির কক্ষে নিয়মিত যাবার অভিজ্ঞতা ছিলো এমন সহজ। কিন্তু মাস্তানের হাতে দখল হয়ে থাকা কক্ষের ব্যাপারে কিছুই করতে পারেননি তারা। হলগুলো নিয়ন্ত্রণ করে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার ফুটসোলজাররা। রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতা দখলের জন্য যে পথসেনা লাগে তাদের সেনা ছাউনি হয়ে আছে দেশের সেরা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার মাথার ওপর ছাদ নেই। ঈশ্বরদীর বাড়ির ছাদ ঢাকায় কোন কাজে দেয়না। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার মাথার ওপর ছাদ ছিলো না; সেটা দখল করে রেখেছিলো জহুরুল হক হলের পলিটিক্যাল ক্যাডাররা। ঢাকায় মামার বাসায় থাকতে চাইনি; কারণ আঠারো বছর বয়সের পর অভিভাবকের সঙ্গে থাকলে মানুষের বিকাশ অসম্পূর্ণ থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে স্কলারশিপ দিতো; আব্বা-আম্মাও দিতেন; ফলে খোলামকুচির মতো টাকা ওড়ানোর সামর্থ্য ছিলো। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার প্রাধিকার; জহুরুল হক হলের পুকুর পাশের নারকোল গাছ ঘেঁষা সেই কক্ষটির জায়গা আমাকে ছাড়েনি পলিটিক্যাল ক্যাডারেরা।
ফলে আমার জীবনে এমাজউদ্দীন সেই অক্ষম দ্বিতীয় পিতা শিক্ষক; যিনি শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার ফুটসোলজারের চেয়ে কম শক্তি রাখতেন। ফলে আমার সঙ্গে দেখা হলে উনি বিব্রত হতেন।
কিন্তু দেখা করলে দু’টি কথা বলতেন, একটু চা-কেক খাইয়ে অনেক আশীর্বাদ দিয়ে ফেরত পাঠাতেন। পরে আমি বুঝে যাই; আমাদের শিক্ষকেরা আসলে পলিটিক্যাল ক্যাডারদের হাতে জিম্মি; আমার চেয়ে অনেক বড় বন্দীদশায় থেকে উনারা দায়িত্ব পালন করেন।
স্যার বিএনপির রাজনীতি সমর্থন করেন। বৃটেনে এমন বুদ্ধিজীবী আছেন; যারা কনজারভেটিভ দলের সমর্থক। আওয়ামী লীগ সমর্থক আ আ ম স আরেফিন স্যার পর্যন্ত বুদ্ধিজীবীর রাজনৈতিক দল সমর্থনের মধ্যে সুষম গড় ছিলো; শিক্ষা আর ছাত্র; এই দুটি জায়গায় নৈর্ব্যক্তিক থেকে তারপর দলীয় ব্যাপার দেখতেন উনারা। ফলে এমাজউদ্দিন কেন বিএনপির সমর্থক; এ প্রশ্ন মনে জাগেনি। যুক্তরাষ্ট্রেও শিক্ষাবিদেরা ডেমোক্রাট ও রিপাবলিকান দল সমর্থন করে। কিন্তু শিক্ষা, ক্লাস রুম, ছাত্রকে স্নেহ করার জায়গাগুলোতে কোন দলান্ধতা কাজ করে না তাদের। এমাজউদ্দীন স্যার আমাকে নির্দলীয় নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার ছাত্র হিসেবে; সবসময় প্রশ্রয় দিয়েছেন। উনি আক্ষেপ করে বলতেন, গণতন্ত্রের ঊষর মরুতে আজ ক্যাকটাস ফুটেছে। তাই তোমার প্রাপ্য কক্ষটুকু তোমাকে বুঝিয়ে দেবার সামর্থ্য আমার নেই।
আমি স্যারকে জানালাম, হল দখল করতে যাচ্ছি স্যার। জহুরুল হক হল জাতীয় টেলিভিশন বিতর্কে চ্যাম্পিয়ান হয়েছে। যারা আমার রুম দখল করেছিলো, তারা রামপুরায় আনন্দে আমাকে আকাশে তুলে দোলা দিয়েছে। প্রভোস্ট স্যার বলেছেন, চ্যাম্পিয়ান দলের বিতার্কিকেরা সিঙ্গেল রুম পাবে। আমার সমস্যা মিটে গেছে স্যার। সূচাগ্র মেদিনী ফিরে পেয়েছি। স্যার আনন্দে আলিঙ্গন করলেন। কারণ যে চ্যাম্পিয়ানস ট্রফি বুয়েট আর ডিএমসিতে চলে গিয়েছিলো; আমরা তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরিয়ে এনেছি।
সেই চ্যাম্পিয়ানস ট্রফি স্কুল বিতর্কের শিশুদের সঙ্গে সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার হাত থেকে নেবার অনুরোধ করেছিলেন বিটিভির কর্মকর্তারা। আমরা বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলাম, আমরা আমাদের ভিসি স্যারের হাত থেকে পুরস্কার নিতে চাই। আমাদের চোখে সবসময়ই প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে শিক্ষক বেশি আকর্ষণীয়।
স্যার একটা দারুণ নক্সী পাঞ্জাবি পরে সে পুরস্কার দিতে বিটিভি অডিটোরিয়ামে এসেছিলেন। তার বক্তৃতার শব্দের মাঝে প্রজ্ঞার প্রতীতী, আগামির দিক-নির্দেশনা; নৈর্ব্যক্তিকতার ইন্দ্রজাল ছিলো। এ ছিলো একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর ভাষণ। উনি জানতেন, দেশের সেরা বক্তাদের পুরস্কার বিতরণী সভা এটি। ফলে উনার জীবনের অন্যতম সেরা বক্তৃতা দিয়ে উনি যেন সিগনেচার রাখলেন এলোকুয়েন্সের; বাগ্মিতার; গ্রিক গিমনেসিয়ামগুলোতে সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টোটল, সেনেকা ঠিক যেরকম শব্দের ইন্দ্রজাল তৈরি করতেন শিষ্যদের সঙ্গে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা, উপাচার্য, প্রোক্টর, প্রোভোস্ট, টিউটরেরা যদি এমাজউদ্দিনকে প্রজ্ঞার মানদণ্ড হিসেবে ধরে নিয়েও স্ব স্ব দায়িত্বে সক্রিয় থাকতে পারেন; আপনাদের ছাত্রছাত্রীরা এমন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে আপনাদের সুকৃতি।