আবুজা বিমানবন্দরে বাংলাদেশ থেকে এক রাজকুমারী এসে নামে। নাইজেরিয়ার তরুণ আবেগুন্ডের অতিথি হিসেবে এলেন এই তরুণী। রূপসীর রূপের ঝিলিকে আবুজা বিমানবন্দরের সবাই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। ইমিগ্রেশান পুলিশ রাজকুমারীকে দেখতে দেখতে নিজের হাতের ইউনিফর্মের ওপর ইমিগ্রেশান সিল মেরে দেয় ভুল করে। পরে সম্বিত ফিরে পায়। বিড় বিড় করে বলে, হ্যাভ আ নাইস ডে প্রিন্সেস তূর্ণা।
আবেগুন্ডে প্রিন্সেস তূর্ণাকে নিয়ে যায় আডাকু রেস্ট হাউজে। আবুজা শহরের হার্টথ্রব মিস আডাকু ফুল নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। তার মধ্যে একটা টেনশান কাজ করে; এতো রূপসী মেয়ের আগমনে মিস আডাকুর ফ্যানক্লাব ছুটে গিয়ে প্রিন্সেস তূর্ণার সঙ্গে সেলফি তুলছে; এতোকাল ধরে মিস আডাকুর রূপে বিমোহিত আবুজা আজ তূর্ণা তূর্ণা রব তুলেছে যেন।
প্রিন্সেস তূর্ণা একটু ফ্রেশ হতে গেলে; মিস আডাকু আবেগুন্ডের কলার চেপে ধরে, তুই এই রাজকুমারীকে কী করে বাগালিরে হতচ্ছাড়া!
–এই রাজকুমারীকে বাগানো এতো সহজ না। তুমি যা ভাবছো তা নয়। প্রিন্সেস তূর্ণা আমার বস। উনি আমাদের গডমাদার। আমি বাংলাদেশে পড়ে থাকলেও আমার মন পড়ে থাকে শুধু তোমার কাছে মিস আডাকু।
বেনিন সিটির ওবা প্যালেসে প্রিন্সেস তূর্ণার সম্বর্ধনা সভা আয়োজিত হয়। খ্যাতিমান টিভি হোস্ট এডেগেন্ডে ওনকারা মঞ্চে ডাকে প্রিন্সেসকে। পরিচয় করিয়ে দেয়, নারীর ক্ষমতায়নের বাতিঘর, রূপের বঙ্গোপসাগর তূর্ণা- তূর্ণা- তুর্ণা। ওবা প্যালেস করতালিতে মুখরিত হয়।
প্রিন্সেস তূর্ণা তার বক্তৃতাপর্বে বলে, মানি ইজ দ্য ফার্স্ট গড। কী হয় শিক্ষা দিয়ে; ডিগ্রি দিয়ে! ইচ্ছা ছিলো না তবু অভিভাবকের চাপে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। ওখানে দেখেছি ছাত্র-ছাত্রীদের স্বপ্ন “ছা-ছপ-ছমুছা” খাওয়ায় আটকে রয়েছে। কিন্তু আমি খেতে চাই ক্ষমতা। আমি তাই ক্ষমতা খেয়েছি; আমার রূপের আগুণে ক্ষমতা পুড়ে খাক হয়ে গেছে।
নাইজেরিয়ার মেয়েরা মাতম তোলে, প্রিন্সেস তূর্ণা হতে চাই; চলো চলো বাংলাদেশে যাই।
নারীর ক্ষমতায়নের শিখণ্ডিনী হিসেবে বেনিন নারীসভা প্রিন্সেস তূর্ণার গলায় টাকার মালা পরিয়ে দেয়। দর্শকের সারি থেকে প্রশ্ন করা শুরু হলে, তূর্ণা বলে, আমাদের দেশে ন্যান্সি পেলোসির চেয়েও ক্ষমতায়িত রাজ-দর্জি নারী আছেন; যার অঙ্গুলি হেলনে করোনাকালে সেলাই শ্রমিকরা একশো কিলোমিটার হেঁটেছে। তবে তার সীমাবদ্ধতা গতানুগতিক; বাবা কিংবা স্বামীসূত্রে সফল হওয়া নারীদের একজন তিনি। কিন্তু আমি চেয়েছি নিজেই কিছু করবো। পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দেবো, দেখে যাও নারীর অপরিমেয় শক্তি।
নাইজেরিয়ার নারীরা অশ্রুসিক্ত হয়। ছোট ছোট কন্যা শিশুদের তাদের মায়েরা বলে, হতে পারবে এমন তূর্ণা ম্যাডামের মতো। শিশুরা প্রিন্সেস তূর্ণা হবার স্বপ্ন গেঁথে নেয়।
পরদিন প্রিন্সেস তূর্ণাকে নিয়ে যাওয়া হয় ইয়াংকারি জলকেলি ঝরণাধারায়। লাল-সবুজ শাড়িতে অপরূপা তূর্ণাকে দেখে পাখিরা গান গায়,
খেলিছে জলদেবী সুনীল সাগর জলে।
তরঙ্গ – লহর তোলে লীলায়িত কুন্তলে।।
ছল-ছল উর্মি-নূপুর
স্রোত-নীরে বাজে সুমধুর,
চল-চঞ্চল বাজে কাঁকন কেয়ূর
ঝিনুকের মেখলা কটিতে দোলে।।
আনমনে খেলে জল-বালিকা
খুলে পড়ে মুকুতা মালিকা
হরষিত পারাবারে উর্মি জাগে
লাজে চাঁদ লুকালো গগন তলে।।
এই গায়ক পাখিরা কী কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত কী ইয়াংকেরি জলকেলি ঝর্ণাধারা; তূর্ণা যেখানেই যায়; সেখানে গিয়েই এই গান গায়। আর আবেগুন্ডের দায়িত্ব ছবি তোলা; ফেসবুকে আপলোড করা। সেসব ছবি দেখে পাওয়ার প্ল্যান্টের আবাল-বৃদ্ধ-বনভূমি প্রকম্পিত হয়। উদয়ন ট্রেন দিকভ্রান্ত হয়ে স্টেশান মাস্টারের সিগনাল অমান্য করে এসে পড়লে, তূর্ণা নিশীথা এক্সপ্রেস তাকে চাপা দিয়ে দেয়; মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, তুর্ণা নিশীথা ডাজন্ট ওয়েট ফর দ্য থার্ডক্লাস উদয়ন লোকাল ট্রেন।
মিস আডাকু বুঝতে পারে, জীবনে কিছু করতে গেলে প্রিন্সেস তূর্ণার মতো হতে হবে। সে ঝর্ণার ধারে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, তুর্ণা, তুমি কখনো কারো প্রেমে পড়োনি।
তুর্ণা তার রিনি রিনি হাসিতে ঝর্ণাধারায় আকুলতা ছড়িয়ে বলে, আমি আমার প্রেমে মগ্ন গো। আর কার প্রেমে পড়বো গো। পুরুষ মানুষ প্রেমের সময় হাঁটু গেড়ে বসে প্রেম নিবেদন করে; আর বিয়ে করলেই নারীর মনিব হয়ে যায়। ইউনিভার্সিটি ড্রপ আউট হোক,
টেকাটুকা ধার চাওয়া ইতিহাসান হোক, টেনেটুনে পাশ করা সহমত ভাই হোক, আর মেধাবী ছাত্র হোক; প্রেমের কোর্সে সবই ফেলটুশ। সবাই আশা করে, আমি তাদের বিরিয়ানি রান্না করে খাওয়াবো; মাই ফুট।
মিস আডাকু জিজ্ঞেস করে, নাইজেরিয়ার ছেলেদের কেমন লাগে তোমার!
-ভালো লাগে; কারণ এদের মধ্যে অমুক ভাই তমুক ভাই হয়ে বাবুবিলাসের ঘোড়া রোগ নাই। সামন্ত জমিদার মানসিকতা নাই; কিংবা সামন্ত কবি ভাব নাই। আমাকে ‘গড মাদার’ হিসেবে মেনে নিতে তাদের কোন অসুবিধা হয়নি। যখন বুঝেছে আমি টাকা ভালোবাসি-ক্ষমতার প্রেমে অন্ধ; তখন থেকে ওরা আর বিরক্ত করেনি। প্রত্যেকটা অপারেশান শেষে; ওরা আমার জন্য সালসা নাচে। আর আমাদের ফঘফগুলি পেটে একটু খুশিজল পড়লেই মুঘল-ই-আজম হইয়া পড়ে, বলে, নাচো তূর্ণা। মাই ফুট।
নাইজেরিয়া ভ্রমণ শেষ করে ঢাকা বিমানবন্দরে নামতেই, পুলিশ হাত-মাইকে বলে, তূর্ণা, পুলিশ তোমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছে। পালাবার চেষ্টা করোনা। ফেসবুকে প্রেমের প্রলোভন দেখিয়ে বাকরা বানিয়ে ছয় কোটি টাকা লুটেছো তুমি; ভুয়া কাস্টমস কর্মকর্তা সেজে হাতিয়ে নিয়েছো লাখ লাখ টাকা। এবার ধরা দাও তুমি।
তূর্ণা বীরবেশে আত্মসমর্পণ করতে গেলে এক লোলুপ পুলিশ আনন্দের শিহরণে তাকে হাত ধরে মাইক্রোবাসে বসাতে গেলে তূর্ণা এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দিয়ে বলে, ঐ খান সেনা কুনহানকার! মাইয়া দেখলেই জাপটাইয়া ঝরার চুলবুলি হয় নাকি! কই যাইতে হবে চল যাইতেছি। তূর্ণা একটা ধনুকভাঙ্গা পণের নাম। পুরা দেশটাই তো স্বপ্নের জেলখানা; চল দেহি কদ্দিন আমার স্বপ্নরে তোর ‘টুট টুট’ জেলে আটকাইয়া রাখতে পারিস।
– মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক
Editor-in-chief, E-SouthAsia