পররাষ্ট্রনীতি ব্যাপারটা হুবহু প্রেমের নীতি। এর রসায়ন প্রেমের মতোই কাজ করে। ভারতকে এক্ষেত্রে অত্যন্ত পসেসিভ প্রেমিকের মতো মনে হয়। সে প্রেমিকাকে শুধুই নিজের করে পেতে চায়। পাড়ার অন্য ছেলেদের সঙ্গে মিশবে সে; এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না যেন।
এটা প্রেমের ক্ষেত্রে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ। কারণ প্রেমিকার সঙ্গে অতিরিক্ত পসেসিভ হলে তার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধের মতো অবস্থা হয়। এতে করে ধীরে ধীরে প্রেম তার কাছে গলার ফাঁস মনে হয়।
অতীতে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি খুব শক্তিশালী ছিলো; বিশেষ করে জওহরলাল নেহেরুর সময়। নেহেরু ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ প্রেমিক। তিনি প্রেমের ক্ষেত্রে প্রেমিকা কার সঙ্গে মিশছে কী মিশছে না ওদিকে এতো দেখতে যেতেন না। নিজের প্রেমটা ঠিক ঠাক করতেন। এ কারণে ভারতের শিক্ষিত লোকদের ইউরোপ-এমেরিকার নানা দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে সক্ষম হন। খোদ দক্ষিণ এশিয়াতেই শত্রু হয়ে ওঠা পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ‘ভারত প্রেম’ অক্ষুণ্ণ ছিলো সে সময়। কারণ নেহেরু শিল্প-সংস্কৃতি-চলচ্চিত্র-বিজ্ঞান-ক্রীড়া এই এলাকাগুলোতে মনোযোগ দিয়ে ভারতকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় প্রেমিক করে তোলেন।
এর তুলনায় পাকিস্তানের জিন্নাহ ছিলেন নীরস-নিজেকে প্রকাশে অক্ষম এক প্রেমিক। প্রেমিকার সামনে নিজের মনের ভাব প্রকাশে অক্ষম এই প্রেমিক, “হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল; শুধাইলো না কেহ” গানের ট্র্যাজেডিতে জীবন কাটিয়েছেন। ফলে প্রেমিকা রাষ্ট্রগুলো ক্রমশঃ দূরে সরে যায়। দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের সময় বৃটিশদের সঙ্গে প্রেমে ব্যর্থ হওয়ায় পাকিস্তান অত্যন্ত কম জমিজমা পায়। নেহেরুর প্রেমে দিওয়ানা বৃটিশ ভারতকে অনেক জমিজমা দিয়ে চলে যায়।
এরপর বঙ্গবন্ধু ছিলেন রাজনীতির জগতের সবচেয়ে বড় প্রেমিক। তার ঔদার্য; পার্থিব চাওয়া-পাওয়ার প্রতি তার বৈরাগ্য তাকে প্রেমিক হিসেবে শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়; পশ্চিমে-লাতিন এমেরিকা এমনকী আরব বিশ্বে জনপ্রিয় করে তোলে।
ভারতের ইন্দিরা গান্ধী প্রেমের ক্ষেত্রে অত্যন্ত পসেসিভ হওয়ায়; নেহেরুর তৈরি করা পররাষ্ট্র নীতির সাফল্যের আলোগুলো ক্রমশঃ নিভে যেতে থাকে। অন্যদিকে পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রেমের ক্ষেত্রে পরিমিতিবোধের অভাবে; ধীরে ধীরে গোটা বিশ্বে যতটুকু আকর্ষণ পাকিস্তানের প্রতি ছিলো তা মিইয়ে যায়। এরপর জিয়াউল হক এসে প্রেমের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দেন। এরপর বেনজির ভুট্টো-নওয়াজ শরিফ এসে প্রেমের কফিনের পাশে বসে, “লাইলি তোমার এসেছে ফিরিয়া মজনুগো আঁখি খোলো” গান গেয়ে কিছু সময় কাটান। পারভেজ মুশাররাফ এসে সীমিত আকারে প্রেমের একটি ছোট উদ্ভাস সৃষ্টিতে সমর্থ হন।
সে তুলনায় বাংলাদেশের জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক প্রেমে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। খালেদা জিয়া আঞ্চলিক প্রেমের ক্ষেত্রে কিছুটা অন্যমনষ্ক ছিলেন; আর ইন্দিরা গান্ধীর মতোই নিজেকে প্যারাগন বিউটি ভাবায়; আত্মপ্রেমে নিমগ্ন পররাষ্ট্রনীতি খুঁজে পাওয়া যায় খালেদার মাঝে।
ভারতের রাজীব গান্ধী কতকটা তার নানা নেহেরুর মতো সহজাত প্রেমিক ছিলেন। ফলে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিকে তিনি একটি ভালো অবস্থানে নিয়ে যেতে সক্ষম ছিলেন। এরপর থেকে ভারত প্রেমহীন ভালো ছাত্রের মতো বুকিশ সময় কাটায় বাজপেয়ী ও ড মনমোহন সিং-এর সময়। এতো ভালো ছেলে-সচ্চরিত্র ছেলে; যে তারা পররাষ্ট্রনীতির প্রেমের খেলাটা ঠিক খেলতে পারেননি।
বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সেই তুলনায় অনেক বেশি প্রাণবন্ত পররাষ্ট্রনীতির প্রেম উপহার দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর মতোই আকর্ষণীয় প্রাণবন্ত প্রেমের উদ্ভাস তার মধ্যে থাকায়; গোটা বিশ্বেই যে কোন ফোরামে উজ্জ্বল তিনি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আয়তনের ক্ষুদ্রতাকে তিনি অতিক্রম করতে পেরেছেন ঔদার্যে; সহজাত রসবোধে, আন্তরিকতায়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে শেখ হাসিনা এই মুহূর্তে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী।
ভারতের নরেন্দ্র মোদি; প্রেমহীন মানুষ; ফলে প্রেমের সমাধি রচনা করে চলেছেন একে একে। যেহেতু তার জীবনে প্রেমের কোন স্থান নেই; এখন নতুন করে পররাষ্ট্রনীতির প্রেম করতে গেলে মনে হয়; যেন বলিউডের গুলশান গ্রোভার প্রেমের দৃশ্যে সালমান খান হবার চেষ্টা করছে।
ইমরান খান বিশ্বপ্রেমিক মানুষ। ফলে তার সময়ে পাকিস্তান দীর্ঘদিনের প্রেমের খরা কাটিয়েছে; বিশ্বে পাকিস্তান আবারো তার দুর্নাম কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এ কারণেই একটি দেশের শীর্ষ নির্বাহী পদে একজন বিশ্বপ্রেমিকের প্রয়োজন হয়।
পররাষ্ট্রনীতি এমন এক প্রেম; যেখানে বিবাহ নামের প্রতিষ্ঠানের ঝামেলাটা নেই। সকাল-বিকাল-সাঁঝ একই মুখ ঝামটা খেয়ে শুধু সমাজের মুখের দিকে তাকিয়ে সয়ে যাওয়ার ট্র্যাজেডি নেই।
নরেন্দ্র মোদি যেহেতু প্রেম বিষয়টি সম্পর্কে জানেন না; ফলে তিনি ভুল করে পররাষ্ট্রনীতিকে বিবাহ ভেবে বসছেন। আর ব্যক্তিগত জীবনে বড় কোন সমস্যা ছাড়াই কী এক অভিমানে যশোদার সঙ্গে দূরত্বে কাটিয়েছেন তিনি। ফলে পররাষ্ট্রনীতিতে “যশোদা সিনড্রোম” দৃশ্যমান। সব রাষ্ট্রই কেমন যেন দূরে সরে যাচ্ছে।
আরেকজন মানুষ বা রাষ্ট্রের পুরোটাই থাকবে আমার প্রেমের অধিকারে; সে আমার কথায় উঠবে বসবে; অন্যদের সঙ্গে মিশবে- কী মিশবে না; তা ঠিক করে দেবো আমি; এ হচ্ছে প্রেম নয়; প্রেমহননের রেসিপি। সেই রেসিপি নিয়ে বসে মোদি ক্রমশঃ নিসঙ্গ হয়ে উঠছেন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড মোমেন ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে বলেছিলেন, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক; এখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলছেন, বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক রক্তের আখরে “রাখি-বন্ধন”-এর সম্পর্ক। একই সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রী থেকে ভাই-বোন সম্পর্কে রূপান্তরিত। এটা হয়। অনেকে বলেন, দীর্ঘদিন সংসার করলে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কটা ভাই-বোন সম্পর্কের মতো হয়ে যায়। এ কারণে আর যাই হোক; পররাষ্ট্রনীতিতে ‘বিবাহ’ ধারণাটা অত্যন্ত ক্ষতিকর।
পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে কোর্টশিপ পিরিওডের মতো; কিন্তু কোর্টশিপ হবে না। পররাষ্ট্রনীতিতে, ম্যারেজ ইজ দ্য এন্ড অফ লাভ। ভারতকে এখন এই বাস্তবতাটি উপলব্ধি করতে হবে। প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে তারা কংগ্রেস নেতা বিশ্বপ্রেমিক শাশী থারুরের সাহায্য নিচ্ছে না কেন তা বোধগম্য নয়। বিশ্বপ্রেমে ইমরান খানের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেন কেবল শাশী থারুর।
– মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক
Editor-in-chief, E-SouthAsia