ক্রসফায়ারের মাঝ দিয়ে গণদেবতার আইন বহির্ভূত ও বেআইনি হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় একজন সাবেক সেনা কর্মকতার নাম যুক্ত হলো। যে সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তারা খালেদার “অপারেশান ক্লিন হার্ট” থেকে হাসিনার “অপারেশান অপোজিশান” ক্রসফায়ার ও এনকাউন্টার হননযজ্ঞে অংশ নিচ্ছেন; তাদের জন্য অশনি সংকেত এই সেনা কর্মকর্তার হত্যাকাণ্ড। এলিট ফোর্সে পোস্টিং থাকা অবস্থায় যে সেনা কর্মকর্তা তার স্কুল-কলেজে নাটকের অভিজ্ঞতায় স্কুল-কলেজ লেভেলের ক্রসফায়ার নাটকের দুর্বল চিত্রনাট্য লিখেছিলেন; তিনি আজ সহকর্মীর মৃতদেহ দেখে কী ভাবছেন কে জানে! যে এলিট ফোর্সের কর্মকর্তা ইংরেজি সাহিত্য পড়ার কল্যাণে গ্রিক “হারকিউলিস” চরিত্রটি তৈরি করেছেন “ন্যায়বিচার দাদা” হিসেবে; তার কোন অনুতাপ আজ আছে কীনা জানা যায় না।
তবে একটা বেআইনি হত্যার অপ-সংস্কৃতিকে নিজের সামান্য পদ-পদবী-প্রোমোশানের লোভে মোটাতাজা করার সময়; সেই অপসংস্কৃতি আজ ফ্রাংকেস্টাইন হয়ে দেখুন একজন সাবেক কর্মকর্তাকে হত্যা করে ফেললো।
এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে যৌথ তদন্ত হবে; এতো বাংলাদেশের ক্ষুদ্র প্রজা হত্যা নয় যে, এলিটফোর্সের বা পুলিশের এনকাউন্টারের রূপকথার গল্প শুনে সবাই চুপ করে যাবে। এটা হতভাগ্য শূদ্রের মৃত্যু নয় যে, ঠিক হইছে বলে জনৈকা ফাতেমা বেগম ফেসবুকে এলিট ফোর্সের কর্মকর্তার ফেসবুকের ছবিতে লাইক দিয়ে “থ্যাংক ইউ স্যার” লিখে আসবে। এটা ক্ষত্রিয়ের হাতে ক্ষত্রিয়ের মৃত্যু; সেমসাইড; যেরকম সেমসাইড মেক্সিকোর মতো রাউডি ও রোগ স্টেটগুলোতে ঘটে থাকে।
যেসব লোক খুন করে; তাদের শাস্তি জীবদ্দশাতেই হয়। নিউটনের তৃতীয়সূত্র অনুযায়ী প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে। পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র কাস্ট সিস্টেম বোঝে না। আপনার হাতে হত্যার রক্ত থাকলে; এই রক্ত আপনার জীবনেও ঝরবে।
পৃথিবীতে হত্যাকাণ্ড একটি চেইন রিএকশান। যেসব দেশে আইনের শাসন থাকে; তারা সেই চেইন রিএকশান বন্ধ করে ন্যায়বিচার দিয়ে। আর যেখানে আইন-কানুনের বালাই নেই সেটা হত্যাবুভুক্ষু দক্ষিণ এশিয়া অথবা মেক্সিকো-উগান্ডা হয়ে ওঠে।
ম্যাকিয়াভেলির প্রিন্স গ্রন্থে উনি উল্লেখ করেছেন, শাসক নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে ডার্টি ম্যান নিয়ে আসে কিলিং-এর মতো ডার্টি কাজ করতে। কিছুকাল পরে এই ডার্টিম্যানকে জবাই করে শাসক জনতুষ্টিকর ত্রাতা হিসেবে বেরিয়ে আসেন। তখন যতদোষ ডার্টি ঘোষ হয়।
সেনা-পুলিশের যারা ক্রসফায়ারের সঙ্গে জড়িত, খুনী ও খুন জাস্টিফাইয়ের চিত্রনাট্যকার; তারা দেশে থাকলে শাসকই একসময় তাদের জবাই করে; বিদেশে চলে গেলে নিয়তি এসে খবর দেয়, তার সন্তান নিরাপদ সড়কেই সড়ক দুর্ঘটনায় কিংবা আত্মহত্যায় মরেছে। খুনীদের ছেলের গাড়ির টায়ারের নীচে সামান্য কুকুর এসে পড়ে একাধিক মৃত্যুর খবর আমাদের জানা। গাড়িটিও দুর্নীতির টাকায় কেনা; সেও চায়; যে কোন সুযোগে আত্মহত্যা করতে।
পাপ যে বাপকেও ছাড়ে না; এই সহজ কথাটা ভুলে যাই আমরা। কিছুকাল আগে সেনা সদর দপ্তরের একটি বিবৃতি পড়ে অবাক হলাম। বিস্ময়কর নিম্ন রুচির এই বিবৃতি। সামরিক বাহিনী সুশৃংখল একটি প্রতিষ্ঠান বলে; গোটা বিশ্বেই সবচেয়ে বেশি শিষ্টাচারের চর্চা থাকে সামরিক বাহিনীতে। যে কোন সামাজিক আড্ডার সবচেয়ে শিষ্টাচার সম্পন্ন মানুষটি থাকেন সামরিক বাহিনীর।
সামরিক বাহিনীতে সহকর্মীর স্ত্রী-সন্তানের মর্যাদা থাকে সবচেয়ে ওপরে। ব্যক্তিগত শত্রুর স্ত্রী-সন্তানকেও রক্ষায় সতত সচেষ্ট থাকেন সামরিক বাহিনীর সদস্যরা।
এই ব্যাপারটা সিভিলিয়ান সমাজেও আছে। একজন মানুষের সঙ্গে আমার শত্রুতা থাকতে পারে। কিন্তু তার পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন সভ্যতার মৌলিক সূত্র।
সম্প্রতি আই এস পি আর-এর বিবৃতি পড়ে মনে হলো; এটা কী সিপি গ্যাং-এর ফেসবুক পোস্ট; যেখানে যুক্তিতে না পেরে ঊনইতিহাসান ভাইয়েরা “দৈনিক বেডরুম” কিংবা সাপ্তাহিক “কইয়া দিমু”-র প্রকাশক হয়ে ওঠেন।
একজন সদ্য সাবেক সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে মতোবিরোধে জড়িয়ে তার স্ত্রীকে রীতিমতো দাপ্তরিক বিবৃতিতে টেনে আনা প্রতিষ্ঠানকে কালিমালিপ্ত করা। এতোদিনে চর্চিত মূল্যবোধের ঝরণাধারা সরিয়ে কলতলা বসানোর আয়োজন।
একজন সদ্য সাবেক কর্মকর্তা কোন ভুল কাজ করলে; তাকে নিয়ে বিবৃতি দেয়া যায়; কিন্তু সেখানে প্রতিটি শব্দ ভেবে লিখতে হবে। ড্রাফট তৈরির সময় “কলতলা” ও “গোয়ালঘর”-এর বেড়ে ওঠা জীনগত তীব্র প্রভাব এসে বলবে “গোবর ছোড়ো”; কিন্তু প্রতিষ্ঠানের সম্মানের দিকে তাকিয়ে নিজের পারিবারিক “ফইন্নির ঘরে ফইন্নি” গালি দেয়া অপসংস্কৃতির নেশা কাটিয়ে; শিষ্টাচার সম্পন্ন যৌক্তিক বিবৃতি লিখতে জানতে হবে। প্রতিটি শব্দ ভেবে লিখতে হবে।
এটা না পারলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে শিয়ালদের সিপি গ্যাং-এ যোগ দিয়ে প্রতিদিনই আপনি থাকতে পারেন, লা গোবরিনা ফেস্টে। অনুদান-এসাইলাম এগুলোর সুযোগ “গোবর ছোড়ার কাজে” যথেষ্ট আছে। যে গোয়ালের গরু ঐখানে গিয়ে হাম্বা হাম্বা করাটা শ্রেয়।
রাষ্ট্রের ঐতিহ্যসঞ্জাত শিষ্টাচারের সংস্কৃতিকে জীনগত অশ্লীলতার গোবর লেপে দেয়াটা নাগরিকেরা কখনোই মেনে নেবে না। যাদেরকে আমরা অসফল পিছিয়ে থাকা মানুষ ভাবি; সেই দারিদ্র্যের অগমে-দুর্গমে গিয়ে দেখুন; তারা জানেন নারী ও শিশুর মর্যাদা সম্পর্কে। চায়ের স্টলের আড্ডায় কখনো পরস্ত্রী নিয়ে কাসুন্দি ঘাঁটার চল নেই। কেউ এরকম অনাহুত কথা বললে অন্যরা তাকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়।
জোসেফ কনরাড তার হার্ট অফ ডার্কনেস গ্রন্থে প্রশ্ন রেখেছেন, সভ্যতার ধারাটি টেমস থেকে কঙ্গো নদীর দিকে যায়; নাকি কঙ্গো থেকে টেমস নদীর দিকে আসে! এ প্রশ্নের উত্তর তিনি নিজেই পেয়েছেন; কঙ্গোর মৌলিকত্বের মধ্যেই বিশুদ্ধতা ও শালীনতা আছে। তাই গানের দেশ-কবিতার দেশের গ্রামীণ সমাজ থেকে সভ্যতার দিক নির্দেশনাটা নিতে হবে। আধা-খ্যাঁচড়া নাগরিক বস্তির কলতলা অপসংস্কৃতির মধ্যে আত্মশ্লাঘা আর নরভোজিতার আশ্লেষ ছাড়া আর কিছুই যে নেই।
– মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক
Editor-in-chief, E-SouthAsia