প্রিয় শিবির ও শিবসেনা বন্ধুরা, কক্সবাজারের ঘাতক ওসিকে ঘিরে আপনাদের প্রতিক্রিয়া থেকে আপনাদের মনোজগতের যে ছবি তুলেছি; তা আপনাদের জ্ঞাতার্থে পেশ করছি।
বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয়ের শাসনামলে প্রদীপ যথাক্রমে বিএনপির প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও আওয়ামী লীগের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উভয়ের কাছ থেকেই পুলিশ অফিসার হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন।
উভয় আমলে প্রদীপ পুরস্কৃত হওয়ায়, এটা প্রতীয়মান হয় যে, বিএনপির বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড “অপারেশান ক্লিন হার্ট” ও আওয়ামী বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড “অপারেশান ক্লিন হেড’-এ ঘাতক হিসেবে সাহসিকতার জন্য পুলিশ সদর দপ্তর প্রদীপকে জাতীয় পুরস্কারের জন্য মনোনীত করে; স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রদীপের মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছে।
সুতরাং শিবিরের যে সদস্যরা “প্রদীপ হিন্দু বলে” ধারণা করে নিলেন; সে ভারতের “গুপ্তচর”; তাদেরকে এটা স্বীকার করে নিতে হবে; এটা তাদের “অষ্টাদশ শতক থেকে চলে আসা “যন্ত্র ঐ একটাই ‘ষড়যন্ত্র” চিন্তার ভুল। আপনি যখনই ‘ষড়যন্ত্র’ শব্দটি উচ্চারণ করেন; আপনি ভুত-প্রেত-এ বিশ্বাস করতে শুরু করেন। এই ইন্টারনেটের যুগ; যখন গুগলে খুঁজলে পৃথিবীর সমুদয় তথ্য পাওয়া যায়; তখন পায়ে হেঁটে গুলি করে বেড়ানো গোয়েন্দার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। আজকের যুগে গোয়েন্দা-কাজও চলে ইন্টারনেটে; ফেসবুকে আপনি প্রদীপকে ভারতের গুপ্তচর বলায় সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা নিজেদের গুপ্তচর তালিকায় প্রদীপের নাম খুঁজে অনেক সময় নষ্ট করেছে। কারণ এই নামে কোন গুপ্তচর নেই তাদের। প্রদীপ সিং, প্রদীপ মিশ্র, প্রদীপ মালহোত্রা; এসব নাম আছে; তারা ভারতের নাগরিক। সুতরাং এভাবে বাংলাদেশে জাতীয় ঐকমত্যের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য পুরস্কার পাওয়া ঘাতক পুলিশকে আপনি ভারতের গুপ্তচর ভেবে নিজেও বোকা হয়েছেন; ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার বেশ কিছুটা সময়ও নষ্ট করেছেন। তাই “হিন্দু” হলেই সে ভারতের গোয়েন্দা খ্রিস্টান হলে সে বৃটিশ গোয়েন্দা; এসব অষ্টাদশ শতকের চিন্তা বাদ দেয়াই আপনাকে সামনের দিকে সঠিকভাবে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। সম্ভব হলে আপাততঃ গোয়েন্দা কাহিনী পড়া ও “এক্সট্র্যাকশান” টাইপের গোয়েন্দা ফিল্ম দেখা আপাতত বন্ধ রাখুন। এমনিতেই ছোট বেলা থেকে সবকিছুতে ষড়যন্ত্র খুঁজে নিজের জীবনের যন্ত্রটিকে ঠিকঠাক করতে পারেননি আপনি। আর দেশটাকে বাপের তালুক ভাবা বন্ধ করতে হবে; দেশটা সবার।
আবার “প্রদীপ” হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক শুনেই যে শিবসেনার দাদা ও দিদিরা ফেসবুকে মাইনরিটি কার্ড ফেলে ” হিন্দু বলেই প্রদীপ ষড়যন্ত্রের শিকার” বলে কাঁদলেন; কেউ কেউ রেগে গিয়ে বললেন, যে লিয়াকত গুলি করলো; তার কথা না বইলা খালি প্রদীপ প্রদীপ করতেছেন কেন! তারা এতোক্ষণে বুঝতে পারার কথা; ওসি একটি কমান্ডিং পজিশন; থানার হুকুমের মালিক লোকটাই ওসি; আর ওসির অধীনে কাজ করা লিয়াকত গ্যাং হচ্ছে হুকুম তামিল করা খুনী। শুধু খুন করার হুকুম নয়; সমুদ্র সৈকতে হেলান চেয়ারে বসে অধীনের লিয়াকতদের প্রদীপ পা টিপে দেবারও আদেশ দিতে পারে। তার মানে ওসি প্রদীপ যদি দিনশেষে লিয়াকতকে তার অংকশায়িনী হতেও বলে; লিয়াকতকে তা হাসি হাসি মুখে মেনে নিতে হবে। এমনই রংধনু জীবন প্রদীপের; যাকে বলে “কাভি খুশি, কাভি গাম।”
সুতরাং বাংলাদেশে হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টানদের প্রতি শিবির-মানসের লোকেরা দুর্ব্যবহার করে বলেই; আপনি শিবসেনায় যোগ দিয়ে কারণে-অকারণে ফেসবুকের তাসের খেলায় সংখ্যালঘুর টেক্কা কার্ড ফেলে হাপুস নয়নে কাঁদবেন; তা কী হয়; এতে মিথ্যাবাদী রাখালের মতো তাসের খেলার নষ্ট জোকার হবেন আপনি। এর চেয়ে দেশের কোথাও হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান-আদিবাসী কট্টর কোন মুসলমানের হামলার শিকার হলে; সঙ্গে সঙ্গে সঠিক তথ্য সহ ফেসবুকে লিখুন। এইখানে আপনি কল্পনাবশত মুসলমান মানেই পাকিস্তানের গোয়েন্দা এইরকম কথা লেখার দরকার নাই। এতে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা তাদের তালিকায় বাংলাদেশে হিন্দুর ওপর হামলা করা জনৈক শুক্কুর আলীর নাম খুঁজে সময় নষ্ট করবে। তাদের তালিকায় শাকের খান, শাক্কার ভাট; শেকার পালেজো আছে; কিন্তু শুক্কুর আলী নাই; কারণ সে খাঁটি বাংলাদেশী।
শিবির ভাইদের প্রতি আহবান হিন্দু নাম দেখলেই তাকে ভারতের দালাল বা চাড্ডি বলবেন না। এতে বাঙ্গি গৌরব ক্ষুণ্ণ হয়। আর শিবসেনা ভাইদের প্রতি আহবান মুসলমান নাম দেখলে তাকে পাকিস্তানের দালাল বা পাকি বলবেন না। বাঙ্গি কোন অংশেই কোনদিন পাকির চেয়ে কম নয়; এটা একদম ভুলে যাবেন না। দেশের গৌরব দেশে রাখুন। কারণ অধিকাংশ অপরাধীই একসময় জাতীয় পুরস্কার লাভ করে।
আর একটি মুসলমান শ্রেণী আছে যারা শিবির না হলেও হিন্দু ফোবিয়ায় ভোগে। এরা মূলত আশরাফ শ্রেণী; অতীতে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে তাদের সম্মানের প্রতিযোগিতা ছিলো; এখনো আছে। প্রতিযোগিতায় লিপ্ত আশরাফ মুসলমান ও ব্রাহ্মণ হিন্দু কাল-পরিক্রমায় ঘৃণার আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া মানুষ।
একটি মুসলিম শ্রেণী আছে যারা ইসলামোফোবিয়া সমর্থনকে প্রগতিশীলতা ভাবে। যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ এই দুটি দেশের প্রগতিশীলতা মুখ থুবড়ে পড়ার কারণ হচ্ছে; যুক্তরাষ্ট্রে কট্টর ইহুদিদের জীবনাচারকে প্রগতিশীলতা মনে করা হয়েছে; যা একেবারেই আউটডেটেড। মনের মধ্যে সারাক্ষণ ঘৃণা নিয়ে আর যাই হোক উদারপন্থা বিনির্মাণ করা যায় না। বাংলাদেশে কট্টর হিন্দুদের জীবনাচারকে প্রগতিশীলতা মনে করা হয়েছে; যা অচলায়তন ছাড়া আর কিছুই নয়। মনের মধ্যে বিদ্বেষের কুঁচকুঁচানি নিয়ে আর যাই হোক উদার জীবন যাপন করা যায় না। যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের কথিত প্রগতিশীলরা আসলে “আমরা বনাম ওরা” তৈরি করে নিজেদের অভিজাত শ্রেণী হিসেবে জাহির করার নিম্নমানসিকতার চর্চা করে আজকের সমাজে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। অপেক্ষাকৃত ভালো উদারপন্থা কেবল আছে ইউরোপের কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোতে।
ইসলাম ধর্মের “মদিনা সনদ” আর হিন্দু ধর্মের ” ঋগ্বেদ” ইন্টারনেটে খুঁজে একটু কষ্ট করে পড়ে ফেললে; এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে; কত আগে দুটি ধর্মেই; মানুষকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ না করে; মানুষ হিসেবে সম্মান করার বিধান প্রচলিত হয়েছে। এইসব প্রামাণিক বিষয় না পড়ে ইসলাম ও হিন্দুধর্মের স্বঘোষিত ম্যানেজারদের ঘৃণা বিক্রির দোকানের নিয়মিত ক্রেতা হয়ে; আজ নিজের জীবনকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করেছে অনেক মানুষ। অনেকে নরভোজি হয়ে উঠেছে।
জীবন আসলে নানা রকম ফুলের বাগানের মতো; মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান, নানামত-নানাপথের ফুল ফুটে আছে সেখানে। আপনি যদিই শুধুই মুসলিম ফুল বা হিন্দু ফুলের বাগান চান; সেটা জীবনেও পূরণ হবার নয়; আর আজকের যুগে তো নয়ই। নিজের ইচ্ছার স্বাধীনতার মূল্য মানুষ তখনই পায়; যখন সে অন্যের ইচ্ছার স্বাধীনতাকে মূল্য দেয়।
– মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক
Editor-in-chief, E-SouthAsia