রাজা যায়; রাজা আসে; কিন্তু প্রদীপের নীচে নটোরিয়াস গভর্নমেন্ট অর্গানাইজেশানের জলসা ঘরটি কিছুতেই বন্ধ হয় না। বাজারের মধ্যে প্রদীপ হাতে বাবর আগে যেভাবে বলতো, পুরোনো প্রদীপ দাও; নতুন প্রদীপ নাও; ঠিক সেইভাবে আকবর এখন বলে, পুরোনো প্রদীপ দাও; নতুন প্রদীপ নাও।
বাবর আগে ঠিক যেভাবে হাওয়া ভবনে প্রদীপ ঘষে প্রজার হৃদযন্ত্র খুলে কাটা-ছেঁড়া করতো; ঠিক সেইভাবে আকবর পাওয়া ভবনে প্রজার মাথার খুলি খোলে। অপারেশান ক্লিনহার্ট থেকে অপারেশান ক্লিন হেড; প্রদীপের নীচে নটোরিয়াস গভর্নমেন্ট অর্গানাইজেশানের জলসা ঘরটি কিছুতেই বন্ধ হয় না।
প্রজারা সংঘবদ্ধভাবে প্রতিবাদ জানায়; বাবর থেকে আকবর সবাই কেন প্রজার জীবন নিয়ে এমন নাগ-নাগিণীর খেলা খেলবে!
মানসিংহ প্রেস কনফারেন্সে এসে বলেন, নাগনাগিণীর খেলা বলে কিছু নেই; এসবই এনজিও-র সৃষ্টি।
সহমত সিংহ শিবিরে অস্বীকারের মাভৈঃ, বিচ্ছিন্ন ঘটনা। প্রজার হাজার হাজার ছিন্ন মস্তক হাতে নিয়ে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে নরমুন্ডু দিয়ে ড্রিবলিং করে তারা; এক একজন কোকেন-আচ্ছন্ন ম্যারাডোনা; ঈশ্বরের হাত দিয়ে তারা ক্ষমতার গোল দেয়।
প্রদীপ আর এনজিও ছিলো-আছে-থাকবে; শুধু পুরোনো প্রদীপ ফেলে নতুন প্রদীপ হাতে নেবে নটোরিয়াস গভর্নমেন্ট অর্গানাইজেশান। এই বিষণ্ণতায় প্রজারা নির্ঘুম রাত কাটায়। সন্তানকে স্কুলে পাঠালে ভয় হয়; নম্বর-প্লেটহীন ভুতের গাড়ি এসে তাকে তুলে নিয়ে যাবে; প্রদীপের আলোয় তাকে মস্তিষ্ক প্রক্ষালণ করবে; তার স্বপ্ন হত্যা করবে। তারপর ছেড়ে দিয়ে যাবে সহমত বেড়ালে রূপান্তরিত করে।
রাজার ব্যাঘ্রাসনের হাতলে বাঘের মুখ; আস্তিনে বাঘের চামড়া; কিন্তু প্রজা চাই সহমত বেড়ালের; সেই একটা জেদে বাবর থেকে আকবর; মানসিংহ আর তার সহমত সিংহেরা প্রদীপ হাতে ঘোরে; পথে বাঘের দেখা পেলেই তাকে হাওয়া ভবনের মতো পাওয়া ভবনের জলসাঘরে নিয়ে গিয়ে বেড়াল করে ছেড়ে দেয়ার নেশা রক্তের নেশার গভীর রাত আনে; কিশোরীর ‘আব্বু তুমি কান্না করতেছো’-র বিষাদ সাগরে; নরমুণ্ডু ভাসতে থাকে।
সাতে পাঁচে থাকিনা দাদুরা এসে বলে, রঙ্গভবনের বাগান সুন্দর রাখতে; আগাছা পরিষ্কার করতে হয় দাদু; এই কে আছো; আমায় একটি রাজপদক দাও; মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক আমি রঙ্গভবনের লোক।
রাস্তায় সহমত ভিক্ষুকেরা প্রজাদের প্রতিবাদী মানববন্ধনের পাশে এসে গান গায়, ও মানুষ তুমার দুইডো চোখ দেখপা, দুইডো কান শোনবা; একটা মুখ তো; ইট্টু কথা কম কবা। ওরে কে আছিস আমায় একটু রঙ্গভবনের বিরিয়ানি দে।
আকবর ঠিক করে, অনেক বেশি প্রতিবাদী হলে; তাদের কাছে রাজার রেড স্প্যারো পাঠাবে। রেড স্প্যারোর লাস্যে রক্ত-সাগরকেও শরাব সাগর মনে হবে। শরাব আর শাবাবে কাবু হয়না এমন কোন রক্তমাংসের প্রজা নাই।
পাপিয়া কমফোর্ট সার্ভিস প্রতিবাদীদের দ্রোহ প্রশমনে নেমে পড়ে। বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পর প্রদীপের মনভঞ্জনের জন্য গড়ে ওঠে ললিতলোভনকান্তি বাগান বাড়ি। সেখানে বাহুলগ্না অপ্সরী নিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে এনজিও।
রাজ-শকটে করে ভ্রমণের সময় কোন প্রতিশ্রুতিশীল হলুদিয়া পাখির দেখা পেলে, মনে মনে ভাবে, হলুদিয়া পাখি সোনারই বরণ পাখিটি ছাড়িলো কে! শকট থেকে নেমে প্রদীপ প্রেম নিবেদন করে, প্রিয়া এমনো রাত যেন যায়না বৃথাই। এতো বড় শকট দেখে কৃষক প্রজার স্ত্রী প্রদীপের প্রেমে পড়ে যায়। বাজারে ধানের দাম নাই; তাই প্রদীপ ধান কাটতে লেগে পড়ে। সহমত সিংহেরা প্রদীপের শৌর্যবীর্যের গুনগানে আলু থালু হয়।
কৃষককে তার ধান বুঝিয়ে দিয়ে প্রদীপ বলে, তুমি এমনভাবে বিড়ি খাও; তোমারে মাদক-সম্রাট মনে হয়। তোমার ছোট তরীতে এতো ধান; সেইখানে তুমি ছাড়া আর কারো জায়গা নাই।
প্রহরীরা মাদক মামলায় কৃষককে ধরে বলে, ধানগুলি দে নাইলে ফাটকে চালান কইরা দিমু।
প্রদীপ বাবুর জুড়িগাড়িতে চড়ে সাঁঝের দিকে বাগান বাড়িতে পৌঁছালে; প্রদীপ সে হলুদিয়া পাখিকে বলে, তুমি এই বাগানের রজনীগন্ধ্যা ফুল। আজ দেখবা কীভাবে আগাছা কাটি।
লিয়াকত সিং বারান্দায় তেল নিয়ে বসে ছিলো। প্রদীপ রাজ-পোশাক খুলে ব্যাঘ্রাসনে বসে। লিয়াকত সিং প্রদীপের দেহবল্লরীর সাত পাকে আঙ্গুল বুলিয়ে দেয় । হলুদিয়া পাখির ঈর্ষা হয়, আমি থাকতে ও ক্যানে তোমারে স্পর্শ করবে। প্রদীপ হাসে।
–প্রদীপ হইলো বিশাল বীণার মতো। তাকে বাজাতে উভতারের ঝালার প্রয়োজন হয়। কাভি খুশি কাভি গাম; তুমি যাও; আগাছা পরিষ্কারের নৃত্যের জন্য ব্যাঘ্র ছাল পরে এসো; সালংকরা হও; হীরে-জহরত সব আছে; যা খুশি নাও।
দরিদ্র হলুদিয়া পাখি হীরা-জহরতে মগ্ন হয়। প্রদীপ প্রহরীকে নির্দেশ দেয়, গত দুই বছরের আগাছা পরিষ্কারের মাথার খুলির মালা তার গলায় পরিয়ে দিতে।
কৃষক তার জমির সব ধান প্রহরীদের তরীতে তুলে দিয়ে প্রদীপের নীচের অন্ধকার বাগান বাড়িতে আসে তার হলুদিয়া পাখির খোঁজে। আবাল্যের প্রেম; সে ভাবে কোনভাবে তার কাছে পৌঁছালেই তাকে উদ্ধার করা যাবে।
জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে ব্যাঘ্র ছাল পরা সালংকরা হলুদিয়া পাখি। কৃষক ডাক দেয়, পাখি।
তার দিকে তাকিয়ে সে বলে, তুমি এইখানে কেন, গত দশবছরে তুমি কী দিছো আমারে; একদিনেই দেখো কত হীরা-জহরত দিছে পুরুষটা। কেমন পুরুষ গো তুমি; বউরে খালি গান শুনাইয়া দশটা বছর নষ্ট করলা আমার।
পেছন থেকে প্রহরীরা ধরে ফেলে কৃষককে। তাকে বাগানে বেঁধে রাখা হয় রাজতন্ত্রের ভেড়া করে।
আকন্ঠ মদিরা পান করে; মাথার খুলির মালা পরে বাগান বাড়ির সামনে দাঁড়ায় প্রদীপ। তার বুকে তাম্র শলাকা দিয়ে লাগানো হাওয়া ও পাওয়া ভবনের দুটি পদক। লিয়াকত সিং কোকেন পুরে কলকি এগিয়ে দিলে টান দেয়। মর্জিনা সিং কয়েকটা ইয়াবা নেলপলিশ মাখা আঙ্গুলের ফোঁকরে রেখে নাচের মুদ্রায় এগিয়ে দেয় প্রদীপের পৌরুষ বাড়াতে। আজ রাতে তার অসূরের শক্তি প্রয়োজন।
মর্জিনা সিং নতুন বাঘিনীকে ক’টি নাচের মুদ্রা শিখিয়ে নিয়ে আসে। সে গান করে, আমি যে তোমার; তুমি যে আমার; শ্বাসমে তেরে সারগাম হ্যায়; আব রাত-দিন; জিন্দেগি মেরি তো কুছনা; আব তেরি বিন।
মর্জিনা চাকুর আঁচড়ে কৃষকের পিঠে লিখে দেয়, হীরকের রাজা ভগবান।
প্রদীপের বাহুলগ্না বাঘিনী আহলাদে রজনীগন্ধার সৌরভ নিয়ে আসে।
প্রদীপকে নিয়ে ত্রিভুজ প্রেমের দ্বন্দ্বে লিয়াকত সিং তখন ঈর্ষার আগুনে পুড়ে কৃষকের বুকে ছুরি চালায়। প্রদীপ নির্দেশ দেয়, গলাটা আমার জন্যি রাখিস। শরীরের সাত পাকের পেশী ফুলিয়ে প্রদীপ হুংকার দেয়, গায়েবি আওয়াজ পাইতেছি হাওয়া আর পাওয়া ভবন হইতে; আমি তরে আজ খাইছি।
প্রহরীরা সমস্বরে আর্তনাদ করে, বাহুবলী বাহুবলী।
বাঘিনী নাচতে থাকে রাজ্যের উন্নয়নের স্মারক শ্বেত পাথরের রক্ত-ফোয়ারার পাশে। মর্জিনাকে মদিরা পান করতে দেখে প্রদীপ হুংকার দেয়, কেন শরাব পান করসরে মর্জিনা; রক্ত পান কর।
মর্জিনা তার চল্লিশ ডাকাতকে নিয়ে উন্নয়নের ফোয়ারা থেকে পেয়ালা ভরে রক্ত নেয়। প্রদীপ এক কোপে কৃষকের ধড় থেকে মুন্ডু নামিয়ে দেয়।
বাঘিনী’র চোখের কোণায় অভ্যাসের অশ্রুবিন্দু দেখে; প্রদীপ তাকে পাঁজাকোলে করে তুলে নিয়ে যায় ললিতলোভনকান্তি রিরংসার ঘুম ঘরে। শতবর্ষের উন্নয়নের গুমঘরে।
– মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক
এডিটর-ইন-চীফ, ই সাউথ এশিয়া