সন্দ্বীপ টাউনে সভা সমাবেশ (৪)
(ডঃ ফজলুর রহমানের ইসলামে কিছু সংস্কারবাদী তত্ত্ব ও মওলানা শামসুদ্দিন কাছেমী)
[এ লিখাটি বা পর্বটি ওরাল হিস্ট্রি বা স্মৃতিকথন, ইতিহাস নয়। তবে ইতিহাসবিদরা এই লিখা বা পর্বগুলো থেকে তথ্য-উপাত্তগুলো গবেষণার জন্য সূত্র বা রেফারেন্স উল্লেখপূর্বক এবং সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন নিউজ পোর্টালে শেয়ার করতে হলে পূর্ব অনুমতি নিয়ে উদ্ধৃতি বা লেখকের টাইম লাইন থেকে শেয়ার করতে পারবেন। গবেষক ছাড়া অন্যরা পর্যালোচনা এবং প্রবন্ধ লেখার ক্ষেত্রে উদ্ধৃত করতে হলে লিখিত অনুমতি ব্যতিরেকে, আংশিক বা সম্পূর্ণ কোন ধরণের অনুলিপি করা যাবে না। বাংলাদেশ ও আর্ন্তজাতিক কপিরাইট আইন দ্বারা লেখক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। লিখিত অনুমতির জন্য ইমেইল: sandwip21st@gmail.com]
১৯৮৩ সাল আমেরিকা থেকে খান এম হোসাইন আসলেন।কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যানিং ইনস্টিটিউটের মালিক। থাকেন আমেরিকারড্যালাসে। ড্যালাস উত্তর আমেরিকার রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য–দক্ষিণভাগে অবস্থিত টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের উত্তর অংশে ড্যালাসকাউন্টিতে অবস্থিত একটি বড় শহর। জনসংখ্যার বিচারে এটিটেক্সাসের ৩য় বৃহত্তম (হিউস্টন ও স্যান অ্যান্টোনিও শহরের পরে) এবং সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৯ম বৃহত্তম নগরী। পার্শ্ববর্তী ফোর্টওয়ার্থএবং আর্লিংটন শহরের সাথে একত্রে মিলে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের৪র্থ বৃহত্তম মহানগর। এই শহরে প্রায় ৭৫ লক্ষ লোক বাস করে।শহরটির কাছে ড্যালাস–ফোর্ট ওয়ার্থ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরঅবস্থিত। ড্যালাস শহরের অর্থনীতির মূল খাতগুলি হলো প্রতিরক্ষা, আর্থিক সেবা, তথ্য প্রযুক্তি, টেলিযোগাযোগ ও পরিবহন। এখানেঅনেকগুলি ফরচুন শীর্ষ ৫০০ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সদর দফতরঅবস্থিত আছে। ড্যালাস মহানগর এলাকাতে ৪০টিরও বেশি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় আছে।
খান এম হোসাইন ঢাকার বুয়েট থেকে সিভিল ইঞ্জিনারিং এ পাশকরার পর আমেরিকা চলে যান। আমেরিকা চলে যাবার আগে বুয়েটেলেকচারার ছিলেন। প্রতিভা ও প্রজ্ঞার সমাহার এই ব্যক্তি দীর্ঘ দিন পরদেশের আসেন। তখন তাইবুর ভাই আমাদের যেতে বললেন উনারবড় ভাইয়ের সাথে দেখা করতে। তাইবুর ভাই হলেন আমার সেজু ভাই(দিদারুল আলম তালুকদার খুররম) এর ইয়ার মেট। চিটাগংভার্সিটিতে পড়তেন। তাইবুর ভাই ছিলেন বাণিজ্য অনুষদের ছাত্র ওআমার সেজু ভাই ছিলেন ইসলামিক হিস্ট্রির। থাকতেন একই হলের।১২৫ নং কক্ষে। স্যার এফ রহমান হলে। স্যার এফ রহমান ছিলেনঢাকা ইনিভার্সিটির প্রথম বাঙালি ভাইস চেন্সেলার। তার নামে ২টিহল রয়েছে। একটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও অপরটি চট্টগ্রামবিশ্ববিদ্যালয়ে।
খান এম হোসাইনের কম্প্রিহেন্সিভ প্ল্যানিং ইনস্টিটিউটে ২৭ জনআমেরিকান কাজ করতেন। আমেরিকা সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেরটাউন প্ল্যানিং এর ডিজাইন করতেন। আর্কিটেক্ট করতেন। মিডলইষ্টের বিভিন্ন টাউনের প্ল্যানিং করেছেন। প্রথম দেখাতে খুঁটিনাটিজেনেছি টাউন প্ল্যানিং কি। আধুনিক শহরের জন্য কি কি থাকা চাই ওকি কি নাগরিক সুবিধে দিতে হবে। পাবলিক ইউটিলিটি। যা হোক।
তাইবুর ভাই এতদিন যে লোকের গল্প করতেন; সেই কি ইনি! এই চিন্তাআমার মাথা থেকে যাচ্ছে না। উনি ইসলামের কথা বলছেন।আমেরিকার মত দেশে ছিলেন। যুক্তি ও বাচন ভঙ্গি আলাদা।আমেরিকানদের মত শির উঁচু করে কথা বলেন। কাঁধ হাঁকিয়েঅভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। আমি নীরবে দেখছি ও শুনছি। আমার সাথেবড়ভাই শাইলো ভাই ছিলেন। উনি প্রশ্ন করছেন। উনি উত্তর দিচ্ছেন।এক পর্যায়ে উনি `ইসলাম` নামের একটি বই দিলেন। বললেন কিছুকিছু বাক্য বাদ দিয়ে পড়ার জন্য। বললেন আমেরিকাতে ডঃ এফরহমানের `ইসলাম` পড়ে ইসলাম সম্বন্ধে একটা পসিটিভ ধারণা হচ্ছেআমেরিকানদের। বললেন ড্যালাসে উনি রাস্তার ফুট পাতে নামাজপড়েন। আমার আগ্রহ বেড়ে গেলো `ইসলাম‘ এর বাংলা তর্জমা করারজন্য।
অল্প কয়েক দিনের মধ্যে রমজান মাস এসে গেলো। আমরা বাড়িগেলাম। ইস্টিমার যুগে। সম্ভবত আলাউদ্দিনে চেপে। আমার অন্যান্যভাইবোনেরা ঈদে বাড়ী এলেন। আমরা সন্দ্বীপে বাড়িতে আসলে গল্পগজব করতাম। দেশে বিদেশের অভিজ্ঞতা পড়া শুনা ইত্যাদি নিয়েআলোচনা করতাম। আমাদের পারিবারিক নিয়ম ছিল গতিবিধিরউপরে। মাগরিবের আজানের আগে ঘরে থাকার নিয়ম ছিল।আমাদের টাউনের আড্ডাটা হতো আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত এবংমাগরিব থেকে এশার আগে পর্যন্ত। ফলে সন্ধ্যার আড্ডার আমেজথেকে মাহরুম হতে হয়েছে। সন্ধ্যা বেলার বন্ধুদের সাথে আড্ডাটা মিসকরতাম। এখন আর আড্ডাটা আর মিস করছি না। এখন শুধু মিসকরছি সন্দ্বীপ টাউনকে। এখন আড্ডাও নাই টাউনও নাই।
`ইসলাম` বইয়ের লেখক ডঃ ফজলুর রহমান যুক্তি দিয়েছিলেন যে, ইসলামিক পুনর্জাগরণের ভিত্তি হলো বৌদ্ধিক গতিবেগের প্রত্যাবর্তনকরা। তার দর্শন ছিল, আধুনিক জাতি–রাষ্ট্র গঠনে উম্মার ওনৈতিকতার কীভাবে বুঝতে পেরেছিলেন তা উপলব্ধি করার জন্য তিনিমুসলমানদের আগ্রহী হতে বলেছিলেন। তার ধারণা হলো শরিয়তহলো একধরণের নৈতিকতা এবং আইন উভয়েরই মিশ্রণ। তিনিপবিত্র কুরআন থেকে প্রাপ্ত মূল্যবোধের ভিত্তিতে একটি নৈতিকবিশ্বদর্শন তৈরি করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য মুসলিম ইতিহাসিক, ধর্মতত্ত্বও দর্শনগুলির সমালোচনা করেছিলেন: আর্থ–সামাজিক মূল্যবোধেরবিপরীতে ‘নৈতিক মূল্যবোধ‘, যা ‘ইতিহাসের কোনও পর্যায়ে নিঃসৃতহয়নি‘।
ডঃ ফজলুর রহমান আরও বিশ্বাস করতেন যে, ইসলামী বিশ্বেরআধুনিক রক্ষণশীল মুসলিম বিশ্বের অনুভূত রাজনৈতিক ওঅর্থনৈতিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরক্ষামূলক এবং অস্থায়ীনিয়ম ও পদ্ধতি রয়েছে। এর সাথে যুক্ত হলো ইসলামিক শিক্ষা যা মধ্যযুগে শুরু হয়েছিল যা কোরআনের শিক্ষার অপর্যাপ্ত হয়ে পড়েছেবোঝার কারণে।
গেলো শতাব্দীর শুরুতে সুদ বা রিবা কী এবং এর মধ্যে ঋণের সাথেসুদ কি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই ইস্যুটি ইসলামে একটি বড় বিষয় হয়েদাঁড়িয়েছে। ইসলামী পুনর্জাগরণের সময়ে সুদ সম্পর্কে আগ্রহ বৃদ্ধিপেয়েছিল, সুদ, ঋণ বা রিবা এবং এই গুলোকে “অভিশাপ” বিবেচনাকরা হয় এবং এটিকে শেষ করার অগ্রাধিকার হিসাবে বিবেচনা করাহয়।
একজন ইসলামী আধুনিক সংস্কারবাদী হিসাবে ডঃ ফজলুর রহমানঅনেক ইস্যুতে তিনি একমত ছিলেন না, তিনি বিশ্বাস করতেন যে, কেবলমাত্র উচ্চ–সুদের ঋণই রিবা ছিল এবং বিশেষত এই যে রিবাকেবলমাত্র মুহাম্মদ (দ🙂 আমলে নির্দিষ্ট ধরণের সুদকে বোঝায়। তিনিইমাম মালিকের মুওয়াত্তাকে এই যুক্তিতে উল্লেখ করেছিলেন যে, সুদ বারিবাকে আক্ষরিক অর্থে ব্যাখ্যা করা উচিত নয় তবে প্রাক–ইসলামিকআরব মহাজনদের নৈতিক রীতিনীতি দিয়ে বুঝতে বুঝতে হবে।
পবিত্র কুরআনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে সুদ বা রিবাকে। একটি বিশেষরীতি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। রিবা আল–নাসিয়াহ বা রিবা আল–জাহালিয়াহ, যেখানে ঋণ গ্রহণের কারণে ঋণ গ্রহীতাকে জিজ্ঞাসাকরার প্রচলন ছিল– আপনি কি পরিশোধ করবেন বা আপনি রিবাকরবেন? `যদি ঋণ গ্রহীতা বেছে নেয় দ্বিতীয়ত প্রশ্ন, তাকে ঋণের জন্যবাড়তি মঞ্জুরি দেওয়া হবে। তবে পারিশ্রমিকের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েযাবে–যা রিবা। যদি ঋণ গ্রহীতা দ্বিগুণ পরিমাণে খেলাপি হয়ে যায়, তবে তার ঋণ দ্বিগুণ হয়ে যায় এবং তাকে আরও একটি সময় বাড়ানোহয়।পরিশোধ করতে না পারলে, তার ঋণ দাতাদের সন্তুষ্ট করার জন্যতার এবং তার সমস্ত সম্পত্তি নিলামে আটকানো যেতে পারে। এমনকিপরিবারের সদস্যও।
তাছাড়া ডক্টর ফজলুর রহমান তিন ওয়াক্ত নামাজের তত্বদিয়েছিলেন। আমাদের ১৪ শত বছরের প্রাকটিস ৫ ওয়াক্ত নামাজআদায় করার ব্যাপারে তার মত চরমভাবে আঘাত করে মুসলিমসমাজে। সে ব্যাপারে তার বক্তব্য `ইসলাম‘ বইতে বিস্তারিতলিখেছিলেন। তাই আমার মনে হয় ইঞ্জিনিয়ার খান এম হোসাইনকিছু কিছু বাক্য বাদ দিয়ে পড়তে বলেছিলেন।
তাছাড়া ডক্টর ফজলুর রহমান তিন ওয়াক্ত নামাজের তত্বদিয়েছিলেন। এতে সারা পাকিস্তান গর্জে উঠেছিল। ডঃ ফজলুররহমানের বিরুদ্ধে বৃহৎ আন্দোলন গড়ে উঠে। সন্দ্বীপের আনাচেকানাচ থেকে সরকারি ও কওমি মাদ্রাসার ছাত্র সহ তৌহিদী জনতাএকটি বিরাট মিছিল বের করে। এ মিছিলটি খালপাড়ের ঈদগাহময়দানে এসে শেষ হয়। এখানে কঠিণ ও জ্বালাময়ী বক্তৃতা করেছিলেনমিছিলের নেত্রত্ দানকারী জামিয়াতে উলামায়ে ইসলামীর তৎকালীনপূর্ব পাকিস্তানের জেনারেল সেক্রেটারি ও সন্দ্বীপেরই কৃতি সন্তানমওলানা শামসুদ্দিন কাছেমী।
হাজার হাজার তৌহিদী আবাল বৃদ্ধ জনতা মিছিল সহকারে সন্দ্বীপটাউনে সমবেত হতে লাগলো। আইয়ুবের বিরুদ্ধে স্লোগানের ধ্বনিআকাশ বাতাস মুখরিত হলো। `আইয়ুব খানের গতিতে; আগুনলাগাও একসাথে`। তাছাড়া ইসলামী স্লোগান ছিল। মওলানাশামসুদ্দিন কাছেমী এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিলেন। তন্ময় হয়ে মিছিলেযোগদানকারী ছাত্র শিক্ষক জনতা মুহুর্মুহ স্লোগান দিতে থাকে। সেইদিন তিনি বলেছিলেন, “আইয়ুব খান যদি আপনি ডক্টর ফজলুররহমানকে ফাঁসিতে না ঝুলান; তাহলে আপনাকে আমরা কান ধরেগদি থেকে নামিয়ে দেব।”
তারপর ঢাকায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা আন্দোলনের সুফলহিসাবে বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে রেহাই পান। ১১দফা আন্দোলনে ঢাকায় আসাদ শহীদ হন। তারই আগে ১৯৬৮সালে ডঃ ফজলুর রহমান আমেরিকা চলে যান। প্রেসিডেন্ট আইয়ুবখান ১৯৬৯ সালে ক্ষমতা হস্তান্তর করে জেনারেল ইয়াহিয়াকে। নুতনসেনা শাসক পাকিস্তানে জাতীয় নিবার্চনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরিস্থিতিনিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করে। আওয়ামী লীগ নিরংকুশ বিজয় অর্জনকরে ১৯৭০ সালে। বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী চেতনার উম্মেষ ঘটে।একটি ভাষা ভিত্তিক রাষ্ট্রের জন্ম হলো ১৯৭১ সালে।
মওলানা কাছেমীর বক্তৃতাতে মানুষ আগুনের স্পুলিঙ্গের মত করেমুহূর্তের মধ্যে জ্বলে উঠলো। অতঃপর মুক্তিযুদ্ধে সত্যিকার অর্থেপাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বারুদের আগুন বেরুল।
স্মৃতিকথনে: শিব্বীর আহমেদ তালুকদার
আইনজীবী, সমাজ সংগঠক ও কথ্য ইতিহাস গবেষক।
sandwip21st@gmail.com
—–
আরো বিস্তারিত জানার জন্য:
………
আশা করি, এই পর্বটি আপনাদের ভালো লেগেছে। লাইক ও কমেন্টের মাধ্যমে মতামত দিবেন, প্লিজ। কোনো রকমের তথ্য বিভ্রাট হলে ইনবক্সে ম্যাসেজ দিবেন বা ইমেইল করবেন। ফলে ভুল শুধরে নিতে পারবো। আর এই পোস্টটি শেয়ার করে নিন আপনার অনলাইনের সোশ্যাল বন্ধুদের মাঝে। যাতে আগামী পর্ব থেকে উনারাও সরাসরি স্মৃতিকথনের সাথে যুক্ত হতে পারেন। সন্দ্বীপকে নিয়ে নস্টালজিয়া ও কেতাদুরস্ত সন্দ্বীপিয়ানা স্মৃতিকথনমূলক পরবর্তী পর্বের উপর ‘চোখ রাখুন’ – ।
আগামী রোববার, ২৩ অগাস্ট ২০২০ ইং আসছে
আমার দেখা সন্দ্বীপ (পর্ব নং ১৭)
শিরোনাম থাকবে: সন্দ্বীপ টাউনে সভা সমাবেশ (৫)