সোজা কথা ডেস্ক রিপোর্ট : প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেছেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বিপরীত দিকে যাত্রাটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে এবং এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এখন সাংবিধানিক এবং সমস্ত ব্যবস্থা পরিবর্তন না করে এই মুখ গণতন্ত্রের অভিমুখে ফিরিয়ে নেয়া যাবে সেরকম সম্ভাবনা তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। সোজাকথা ডটকম লাইভ ২৮ তম পর্বের আলোচনায় তিনি এ কথা বলেন।
১৬ আগস্ট রোববার বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা লন্ডন সময় বিকাল ৪টায় ‘হাইব্রিড রেজিমে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা ও মেজর (অব:) সিনহা হত্যা’ শীর্ষক এই লাইভ অনুষ্ঠিত হয়।
এই অনুষ্ঠানে আলোচক ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন সোজা কথা ডটকম- এর সম্পাদক (অবৈতনিক), মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী এডভোকেট শাহ আলম ফারুক।
ড. আলী রীয়াজ বলেন- ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ যখন গণতন্ত্রে প্রবেশ করলো তখন প্রেসিডেন্টের সমস্ত ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেয়া হলো। এমনিতেই পার্লামেন্টারী সিস্টেমে প্রধানমন্ত্রীর হাতে অসম্ভব ক্ষমতা থাকে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে এক ভয়াবহ জিনিস সেটা হচ্ছে সংবিধানের আর্টিকেল ৭০ । সংবিধানের আর্টিকেল ৭০ বলছে কেউ ফ্লোর ক্রস করলে তার সদস্যপদ চলে যাবে। তদুপরি এর সাথে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের দুই প্রধান দলসহ কম বেশি সবারই ক্ষমতার এককেন্দ্রিককরণ ব্যক্তির কাছে। এটাই সেমি অথারেটিয়ান তৈরি করার পথ। ১৯৯১ এর পর এক দশক গণতন্ত্রের যে রূপ আমরা দেখতে পেয়েছি তা হলো ভঙ্গুর গণতন্ত্র। এ গুলো গণতন্ত্র কিন্তু গণতন্ত্রের অনেক মৌলিক উপাদান তাতে অনুপস্থিত।
তিনি বলেন- ২০০৯ সালে আঙয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসলো তখন মুখটা ইতিমধ্যেই কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার দিকে চলে গেছে। সেই কারণে ট্রানজিশন পিরিয়ডটা ২০০৯-১০ এর দিকে দেখতে পাই এবং আমার কাছে মনে হয় বাংলাদেশে যে কম্পারেটিভলি, বাংলাদেশে যে ইলেক্টোরাল অথরিটিয়ান ছিল তার মধ্যে একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। কোন দল ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর আবার নির্বাচিত হবে সে অবস্থা ছিল না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বাদ দিয়ে এটাকে বদলে দেয়া হলো।
২০১৪ সালের নির্বাচনকে বাংলাদেশের সবচে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হিসেবে উল্লেখ করে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন- এই নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বিপরীত দিকে যাত্রাটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে এবং এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এখন সাংবিধানিক এবং সমস্ত ব্যবস্থা পরিবর্তন না করে এই মুখ গণতন্ত্রের অভিমুখে ফিরিয়ে নেয়া যাবে সেরকম সম্ভাবনা তিনি দেখতে পাচ্ছেন না।
ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট’ বা অন্যান্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা হাইব্রিড রেজিমের যে বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করেছেন তার মধ্যে দুটি বিষয় আছে যে আইনের দুর্বল শাসন এবং দুর্নীতির সর্বগ্রাসী বিস্তার। এই দুটো বিয়য়কে বিবেচনায় রেখে মেজর (অব:) সিনহা হত্যার ঘটনাকে কিভাবে দেখছেন? সঞ্চালকের এ প্রশ্নে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন যদিও এ রকম যে কোন মৃত্যুই বেদনাদায়ক, এটা দু:খজনক দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু একটা মৃত্যু বা একটা ঘটনা দিয়ে বিষয়টি বিবেচনা করলে হবে না। যে প্রশ্নটি তুলেছেন এটা আসলে বিরাজমান শাসনব্যবস্থার সাথে যুক্ত। এটাই আপনাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
তিনি যোগ করেন -এই যে হাইব্রিড রেজিমের কথা বলছি এটা হচ্ছে এক ধরণের দোঁআশলা ব্যবস্থা, যেখানে স্বৈরতান্ত্রিক চর্চা ক্রমাগত প্রাধান্য লাভ করছে, এটা একচ্ছত্র কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার দিকে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ই উপস্থিত হয়েছে বলে ধরে নিতে পারেন। এ রকম পরিস্থিতিতে কি হয়? আপনি বলছেন ভারসাম্য, ভারসাম্যটা থাকবে না। এটাই হচ্ছে এই ধরণের শাসন ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় লক্ষণ।
বাংলাদেশের ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে দু দুটি একদলীয় সংসদ তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন তার মানে কি নির্বাহী বিভাগের উপর যে চাপটা থাকার কথা পার্লামেন্টের, এমনিতেই বাংলাদেশের পার্লামেন্ট সে দায়িত্ব পালন করতে পারে নাই। সবচে বড় সমস্যা যেটা হয়েছে আর্টকেল ৭০ এর সমস্যা। তারপরও বিরোধী দল থেকেছে সেটা আওয়ামী লীগ হোক বিএনপি হোক তারা চাপ দিতে পেরেছে। চাপটা ক্ষমতাসীনরা কখনো অনুভব করেছে, কখনো কখনো অনুভব করা যায়নি। কিন্তু চাপ ছিল তা দৃশ্যমান ছিল। এরকম একচ্ছত্র একদলীয় ব্যবস্থায় কিন্তু, এই যে ভারসাম্যের বিষয়টা বলছেন এই ভারসাম্যের বিষয়টা থাকে না।
তিনি বলেন থাকে না কেন জানেন? আপনি যতই কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার দিকে যাবেন ততই আপনাকে নির্ভর করতে হবে আইনের উপর নয় শক্তির উপর। যখন শক্তির উপর নির্ভর করবেন তখন দুটো কান্ড ঘটবে একটা হচ্ছে নির্বাহী বিভাগের কাছে ক্ষমতা চলে যাবে, নির্বাহী বিভাগ ক্ষমতাটা চালাবে। এবং এর উপর আর কোন নজরদারী নেই। কারণ কি জানেন? কারণ আপনি এমন এক ব্যবস্থা তৈরি করেছেন; আপনার জবাবদিহিতা থাকার সুযোগ কোথায়। এক হচ্ছে নির্বাচন আপনি রাখেননি, প্রতি ৫ বছর অন্তর সুষ্ঠু নির্বাচন মানে এক ধরণের জবাবদিহিতার ব্যবস্থা, আরেকটা হচ্ছে পার্লামেন্ট, পার্লামেন্টের কমিটিগুলো, পার্লামেন্টের চাপ সেটাও আপনি রাখেননি। বাকি আরেকটা থাকে সেটা হচ্ছে সিভিল সোসাইটি। বাংলাদেশে যত বেশি কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা দেখা গেছে ততই সিভিল সোসাইটিকে ধ্বংস করা হয়েছে। অথচ এক সময় কার্যকর একটা সিভিল সোসাইটি কিন্তু বাংলাদেশে ছিল। গত এক দশকে সিভিল সোসাইটিকে নিন্দা মন্দ বাক্য দিয়ে ভিলিফাই করার চেষ্টা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। শুধু ব্যক্তি হিসেবেই নয়, প্রতিষ্ঠানিকভাবেই সিভিল সোসাইটির ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। এই ভিলিফাই করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের এক অংশ এবং তথাকথিত ইনটেলেকচ্যুয়ালদের একটা অংশ ভূমিকা রেখেছে।
ড. আলী রীয়াজ বলেন- আর একটা জবাবদিহিতা থাকে মিডিয়ার কাছে। মিডিয়ার সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু মিডিয়ার যে প্রবণতাটা তৈরি হয়েছে, মিডিয়ার মালিকানাটা যেহেতু সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট লোকজনের। সেহেতু সব মিলিয়ে জবাবদিহিতার জায়গা আর থাকলো কোথায়! জবাবদিহিতা না থাকলে ক্ষমতা শক্তি নির্ভর হয়ে উঠে। যখনই ক্রমাগত শক্তি প্রয়োগের উপর নির্ভর করবে আইনের শাসনতো সেখানে থাকতে পারবে না।
তিনি বলেন- আইনের শাসন কি বলে, আইনের শাসন বলে যে আপনি নির্বাহী বিভাগ যে কাজটা করতে পারেন এবং সেটা কোথাও না কোথাও একাউন্টেবল থাকবেন। এই একাউন্টেবিলিটির একটা ক্ষেত্র হলো আইনের নামে যাই করবেন সেটাই কারো না কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে। স্বচ্ছতা থাকতে হবে। সেটা সেনাবাহিনীর কোন অংশ হতে পারে। কোন ইন্টেলিজেন্সের অংশ হতে পারে। এখনতো সে রকম নেই। এগুলো একাউন্টেবল কার কাছে? বাংলাদেশে প্রচলিত ধারণা এবং এই ধারণার পক্ষে যথেষ্ট কারণ ও রয়েছে ২০১৮ এর নির্বাচন পুলিশ করেছে কিংবা বলা হয় ডিসিরা করেছে। বলা হয় ডিসি এসিরা ছাড়া এটা হোত না। তাহলে আপনি তো তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছেন। তাহলে এই ব্যালেন্স তো থাকবে না। এই যে ভারসাম্যের কথা বলছেন, হাইব্রিড রেজিমের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কথা বলছেন, আসলে এটা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নয়, এটাই স্বাভাবিক ঘটনা। এ ধরণের শাসনে এমনই হবার কথা এমনই হয়।
ড: আলী রীয়াজের সাথে সোজা কথা ডটকম-এর লাইভ প্রচার হয় সোজা কথা ডট কম-এর ফেইসবুক পেজ এবং ইউটিউব চ্যানেল Bangla Talks এ। এ পর্বের অনুষ্ঠানের
ফেইসবুক লিংক এবং
ইউটিউব লিংক সোজা কথা ডট কম-এর পাঠকদের জন্য দেয়া হলো। সোজা কথা ডট কম-এর ফেইসবুক পেজ এবং ইউটিউব চ্যানেল লাইক করে নতুন পাঠকরা নিয়মিত লাইভ ও বিভিন্ন সংবাদের আপডেট পেতে পারেন।