সোজা কথা ডেস্ক রিপোর্ট: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতিআরা নাসরিন বলেছেন, মিডিয়ায় একধরনের ‘সহমত ভাই’ সাংবাদিকতা শুরু হয়েছে। জনগণ ভাবতে পারছে না যে সাংবাদিকরা তাদের পাশে আছে। প্রচলিত কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে এ ধারা থেকে বের হতে না পারলে গণমাধ্যমের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা, বিশ্বা অর্জন এবং আশা তৈরি সম্ভব হবে না।
আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস ২০২০ উদযাপনের অংশ হিসেবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আয়োজিত ‘তথ্য অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক মুক্ত আলোচনা ও দুর্নীতিবিরোধী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে তিনি এ মন্তব্য করেন।
সোমবার সকাল ১১.০০ টায় অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ। এসময় মুখ্য আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক, গবেষক ও গণমাধ্যম বিশ্লেষক অধ্যাপক আফসান চৌধুরী, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতিআরা নাসরিন, বৈশাখী টেলিভিশনের প্ল্যানিং কনস্যালটেন্ট জুলফিকার আলি মাণিক এবং টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মন্জুর-ই-আলম।
অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন টিআইবির উপদেষ্টা- নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, এমআরডিআই এর নির্বাহী পরিচালক হাসিবুর রহমান, চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরের নির্বাহী পরিচালক তালাত মামুন, এনটিভির বার্তা প্রধান জহিরুল আলম, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পরিচালক রিজওয়ান-উল-আলম, সিনিয়র সাংবাদিক শরিফুজ্জামান পিন্টু, এমআরডিআই এর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বিষয়ক হেল্প ডেস্কের পরিচালক ও সাবেক সাংবাদিক বদরুদ্দোজা বাবুসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিকবৃন্দ।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করতে পারছে না মন্তব্য করে অধ্যাপক আফসান চৌধুরী বলেন, “গণমাধ্যম এখন নিজেকে সংবাদমাধ্যম হিসেবে না ভেবে উপরাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ভাবছে। তারা অনুসন্ধানী না হয়ে এখন হেডলাইন নির্ভর।
সাংবাদিক জুলফিকার মানিক বলেন, দেশের রাজনীতি যতটুকু নষ্ট হয়েছে সাংবাদিকতাও ততটুকইু নষ্ট হয়েছে। আবার সাংবাদিকতা যতটুকু নষ্ট হয়েছে রাজনীতিও ঠিক ততটা নষ্ট হয়েছে। সাংবাদিকতায় অপশক্তির বিরুদ্ধে শুভশক্তির অনৈক্য প্রকট। তাই শুভশক্তির ঐক্য হলেই সাংবাদিকতার অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত শক্তির মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে এমআইডিআইয়ের নির্বাহী পরিচালক হাসিবুর রহমান বলেন, “সাংবাদিকদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা সংবাদ চাষ করবেন, নাকি শিকার করবেন!” বদরুদ্দোজা বাবু বলেন, “মিডিয়ার মালিকপক্ষ প্রভাবশালীদের পক্ষ নিয়েছে। তাই আত্মসমর্পনের সাংবাদিকতার চর্চা হচ্ছে। অন্যদিকে সাংবাদিকদের মধ্যে যেমন শেখার আগ্রহ কম তেমনি গণমাধ্যমের মালিকপক্ষও শেখানোতে আগ্রহী নয়। তাই অনুসন্ধানী সাংবাদিক তৈরি হচ্ছে না।” সরকার, সম্পাদক তথা মালিকপক্ষ এবং মাঠপর্যায়ের সাংবাদিকদের মধ্যে বিভাজন ও দূরত্বের প্রসঙ্গ তুলে ধরে সাংবাদিক শরিফুজ্জামান পিন্টু তা নিরসনে এবং সাংবাদিকদের পেশাগত সুরক্ষা নিশ্চিত করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।
আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে পুরস্কার ঘোষণা ও সমাপনী বক্তব্যে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নের জন্য সরকারকে সাধুবাদ জানানো গেলেও এই আইনের বাস্তবায়নে সরকারের একাংশের মানসিকতা হলো- ‘তথ্য হচ্ছে সরকারি সম্পত্তি’; এর নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতেই থাকবে এবং সরকার যেভাবে যতটুকু তথ্য প্রকাশ করতে চাইবে ততটুকুই প্রকাশিত হবে। পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতাবানদের একাংশের সমালোচনা সইবার সৎ সাহসের ঘাটতি থাকায় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক উভয় বিবেচনায় তথ্য প্রকাশ একটি ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তাই রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় তথ্য প্রকাশ ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ওপর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ এক ধরণের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যথেচ্ছ ব্যবহার জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। গণমাধ্যমের ওপর এই চাপ গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত; বিশেষ করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা, গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা, শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অপ্রতিরোধ্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। যেটি আত্নঘাতীমূলক এবং বুমেরাং হতে বাধ্য।”
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার
প্রিন্ট মিডিয়া আঞ্চলিক ক্যাটাগরি
যৌথভাবে যশোরের ‘দৈনিক গ্রামের কাগজ’- এর সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার ফয়সাল ইসলাম এবং চট্টগ্রামের সাপ্তাহিক ‘চাটগাঁর বাণী’ পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ সেলিম। ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ০৯ মার্চ পর্যন্ত ‘দৈনিক গ্রামের কাগজ’ পত্রিকায় ‘যশোরে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমে পদে পদে দুর্নীতি’ শিরোনামে প্রকাশিত ০৩ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের জন্য সাংবাদিক ফয়সাল ইসলাম এ পুরস্কার অর্জন করেন।
সাংবাদিক মোহাম্মদ সেলিম ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের সাপ্তাহিক ‘চাটগাঁর বাণী’তে ‘সীতাকুন্ডে নির্বিচারে ধানিজমি, বসতভিটা, বনাঞ্চল ‘গ্রাস’ করছে বসুন্ধরা গ্রুপ’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনের জন্য পুরস্কার বিজয়ী হন। তাঁর প্রতিবেদনে চট্টগ্রামের বাঁশবাড়িয়ার নোনাবিল এবং বোয়ালিকূল এলাকায় বসুন্ধরা গ্রুপের জোরপূর্বক সরকারি এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি দখলসহ নানা অনিয়ম, দুর্নীতির বিষয়গুলোকে তুলে ধরেন তিনি। উল্লেখ্য, সাংবাদিক ফয়সাল ইসলাম ২০১৯ সালেও যৌথভাবে টিআইবির অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার পেয়েছিলেন।
জাতীয় সংবাদপত্র বিভাগ
‘দৈনিক কালের কন্ঠ’ পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার আরিফুর রহমান।
‘এডিপিতে শর্ষের ভূত’ শিরোনামে ২০১৯ সালের ১৪ থেকে ১৭ অক্টোবর ধারাবাহিকভাবে দৈনিক কালের কন্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত চার পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের জন্য এবছর তিনি এই পুরস্কার অর্জন করেন।
টেলিভিশন (প্রতিবেদন) বিভাগ
এনটিভির সিনিয়র রিপোর্টার সফিক শাহিন।
২০১৯ সালের ০৮-১৩ অক্টোবর ‘একটি মামলাবাজ সিন্ডিকেট সমতল থেকে পাহাড়ে’ শিরোনামে এনটিভিতে প্রচারিত ছয় পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের জন্য এ বছর তিনি পুরস্কার অর্জন করেন। রাজারবাগের কথিত পীর দিল্লুর রহমান সিন্ডিকেটের মামলা দিয়ে কীভাবে সাধারণ মানুষের স¤পদ এবং অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে তার প্রতিবেদনে সেই ভয়ংকর চিত্র তুলে ধরেন তিনি। উল্লেখ্য, সাংবাদিক সফিক শাহিন ২০১৬ সালেও টিআইবির অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার পেয়েছিলেন।
টেলিভিশন (প্রামাণ্য অনুষ্ঠান) বিভাগ
বিজয়ী হয়েছে চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরের প্রামাণ্য অনুষ্ঠান ‘সার্চলাইট’। ২০১৯ সালের ০১ নভেম্বর চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরে প্রামাণ্য অনুষ্ঠান সার্চলাইটে প্রচারিত ‘কম্বল?’ শিরোনামে অনুসন্ধানী অনুষ্ঠানের জন্য ‘সার্চলাইট’ এ বছর পুরস্কার অর্জন করে। প্রামাণ্য অনুষ্ঠানটিতে সরকারি কম্বল ক্রয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি করে এবং সরকারি ক্রয় নীতিমালা ভঙ্গ করে মাপে ছোট ও মানহীন কম¦ল ক্রয় করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের একটি চক্রের বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য সরেজমিনে তুলে ধরা হয়।
উল্লেখ্য, আঞ্চলিক ও জাতীয় সংবাদপত্র বিভাগে বিজয়ীদের প্রত্যেককে সম্মাননাপত্র, ক্রেস্ট ও এক লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকার চেক প্রদান করা হবে। আর বিজয়ী প্রামাণ্য অনুষ্ঠানকে সম্মাননাপত্র, ক্রেস্ট ও এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকার চেক প্রদান করা হবে। বিগত ২২ বছর ধরে টিআইবি ‘দুর্নীতি বিষয়ক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার’ প্রদান করছে।