সন্দ্বীপ টাউনে সভা সমাবেশ (৮)
[এ লিখাটি বা পর্বটি ওরাল হিস্ট্রি বা স্মৃতিকথন, ইতিহাস নয়। তবে ইতিহাসবিদরা এই লিখা বা পর্বগুলো থেকে তথ্য-উপাত্তগুলো গবেষণার জন্য সূত্র বা রেফারেন্স উল্লেখপূর্বক এবং সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন নিউজ পোর্টালে শেয়ার করতে হলে পূর্ব অনুমতি নিয়ে উদ্ধৃতি বা লেখকের টাইম লাইন থেকে শেয়ার করতে পারবেন। গবেষক ছাড়া অন্যরা পর্যালোচনা এবং প্রবন্ধ লেখার ক্ষেত্রে উদ্ধৃত করতে হলে লিখিত অনুমতি ব্যতিরেকে, আংশিক বা সম্পূর্ণ কোন ধরণের অনুলিপি করা যাবে না। বাংলাদেশ ও আর্ন্তজাতিক কপিরাইট আইন দ্বারা লেখক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। লিখিত অনুমতির জন্য ইমেইল: sandwip21st@gmail.com]
সন্দ্বীপে মিছিল মিটিং হতো হাজ্বী সাহেবদের নিয়ে। হজ্ব ব্রত পালনের জন্য মক্কা শরীফের উদ্দেশ্যে সফরকে কেন্দ্র করে। হাজ্বীদের নিয়ে সন্দ্বীপ টাউনের উপর দিয়ে মিছিল যেতো স্টীমার ঘাট পর্যন্ত। কোনো কোনো মঞ্জিলে সংক্ষিপ্ত মিটিং হতো। ৬ মাস আগে থেকে হজ্বের উদ্দেশ্যে সফর শুরু হতো। অপেক্ষাকৃত সামর্থবান বয়োবৃদ্ধরা হজ্ব ব্রত পালনে মক্কা ও মদিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতেন। ওই সফর এখনকার তুলনায় অনেক অনেক কষ্ট সাধ্য ও বন্ধুর ছিল। পথে ঝড়ঝঞ্ঝার দুর্ভোগ তো ছিলই।
হযরত আদম (আঃ সাঃ) ও হযরত ইব্রাহিম (আঃ সাঃ) থেকে রাসুল (সা.) এর স্মৃতি খুঁজে ফিরবেন হাজ্বীগণ মক্কা-মদিনার অলিতে গলিতে। যে পথে হেঁটেছেন তাঁরা; আগত হাজ্বীরাও হাঁটবেন। কি সুন্দর অনুভূতি। কাবা শরীফের কালো গিলাফ আর হাজরে আসওয়াদের স্পর্শে নিজেদেরকে পবিত্র করবেন। এ এক আজন্ম বাসনা। নবী (সাঃ) এর রওজা মোবারক জেয়ারত করবেন নিজের প্রেম প্রীতি ও ভালোবাসার অর্ঘ্য দিয়ে। এই প্রেম প্রীতি ও ভালোবাসা কবে কার মধ্যে জন্মেছে; তার দিনক্ষণ কেউ বলতে পারে না। হাটে বাজারে কেউ কেউ হয়তো শুনেছেন –
`দিনের নবী মোস্তফা,
রাস্তা দিয়ে হেটে যান;
একটা হরিণ বান্ধা ছিল গাছের তলায়।`……
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন-
‘মদিনায় যাবি কে কে আয় আয়,
উড়িল নিশান,
দ্বীনের বিষাণ বাজিল যাহার দরওয়াজায়।‘……
সন্দ্বীপে কখন ও কিভাবে মসুলমানরা হজ্ব ব্রত পালনের জন্য হেজাজের উদ্দেশ্যে সফর শুরু করেছিলেন। তার কোনো কথ্য ইতিহাস আছে কিনা। তা আমি জানি না। তবে সপ্তম শতাব্দি থেকে তিন হাজার বছরের প্রাচীন দ্বীপ সন্দ্বীপের সাথে আরব বণিকগণের ব্যবসায়ীক সম্পর্ক ছিল। বলা হচ্ছে যে, তখন থেকেই আরব বণিকগণ সন্দ্বীপের উপনিবেশ স্থাপন ও স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। নবম শতাব্দির শেষভাগে সুলতান বায়েজিদ বোস্তামি নামক বিখ্যাত সাধক স্বীয় ওস্তাদ আবু আলীর আদেশক্রমে সিন্ধু দেশ থেকে ইসলাম প্রচারের জন্যে সন্দ্বীপে আসেন। তাছাড়াও ১০৪৭ সালে মীর সৈয়দ সুলতান মাহমুদ মাহী সওয়ার বলকী নামক একজন মহাজ্ঞানী দরবেশ সন্দ্বীপে আসেন এবং ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন।
কথিত আছে যে, ১৩০০ শতাব্দিতে সুবিখ্যাত বারো আউলিয়া সন্দ্বীপে পদার্পণ করেছিলেন। তিনি যোহরের নামাজ আদায় করেন। উনাদের মধ্যে থেকে প্রসিদ্ধ সাধক বখতিয়ার মৈশূর সন্দ্বীপে বসতি স্থাপন করেন। নদী সিকস্তিতে লুপ্ত রুহিনীতে তাঁর মাজার ছিল। ১৭৬৭ সালে বেনিয়া ইংরেজ ক্যাপ্টেন লনি কিংসের বিরুদ্ধে সন্দ্বীপের স্বাধীনতা রক্ষা করতে গিয়ে আবু তোরাব চৌধুরী লড়াকু ছিলেন। সেই আবু তোরাব চৌধুরী ছিলেন বখতিয়ার মৈশূর বংশধর। ১৩৪৫ সালে পর্যটক ইবনে বতুতা চীন যাওয়ার পথে সন্দ্বীপ সফর করেন। তিনি চট্টগ্রাম, সন্দ্বীপে বহু আরবকে বসবাস করতে দেখেছিলেন।
১৪১২ সালে হযরত শাহ আলী বোগদাদী সন্দ্বীপ আগমন করে দাওয়াতী কাজ করেন। ১৫০০ শতাব্দীতে সন্দ্বীপের সমৃদ্ধি বঙ্গ বিজেতা মুসলমানের দৃষ্টি আকর্ষন করে। এ সময় অনেক মুসলিম ও সম্ভ্রান্ত পরিবার সন্দ্বীপ এসে স্থায়ীভাবে বসবাস আরম্ভ করেন। ১৫৬৫ সালে সিজার ফ্রেডরিক সন্দ্বীপবাসীকে ‘মুর’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।
এখানে বলে রাখা ভালো যে, মুর ছিল মধ্যযুগের মাগরেব, আইবেরিয়ান উপদ্বীপ, সিসিলি এবং মাল্টার মুসলমান বাসিন্দা। মুর প্রথমদিকে ছিল আদিবাসী মাগরেবাইন ডাকাত। এই নামটি পরে আরবদের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হয়েছিল। এই শব্দটি ইউরোপে বিস্তৃত, মুসলমানদের জন্য কিছুটা অবমাননাকর অর্থেও ব্যবহৃত হতো। যা হোক।
সন্দ্বীপে আরব থেকে যারা এসেছিলেন, তাদের মধ্যে হাজ্বী ছিলেন কিনা; তা জানা যায় না। তবে ইবনে বতুতা হাজ্বী ছিলেন। ১ বার নয়, ৩ – তিন বার। তিনি ওমান ও হরমুজ প্রণালি হয়ে ৩য় বার হজ্ব ব্রত পালনের উদ্দেশ্যে মক্কার দিকে রওনা দিয়েছিলেন। মক্কায় আরো এক বছর কাটিয়ে তিনি ভারতবর্ষের পথে বেরিয়ে পড়েন। গোটা মুসলিম বিশ্ব ছাড়াও তিনি ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চীনদেশ ভ্রমণ করে ১৩৪৯ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফিরেন। সন্দ্বীপ আসেন ১৩৪৫ সালে।
ইবনে বতুতা তার সফরের ধারাবিবরণী নির্দেশিত ‘Tuḥfat an-Nuẓẓār fī Gharāʾib al-Amṣār wa ʿAjāʾib al-Asfār’ (যারা শহরগুলির আশ্চর্য এবং ভ্রমণের বিস্ময়কর বিষয়গুলি নিয়ে চিন্তা করেন তাদের জন্য একটি উপহার) বই তে বলেছেন-
‘২ রজব ৭২৫ হিজরি বৃহস্পতিবার (১৪ জুন ১৩২৫ খ্রি.) ২১ বছর বয়সে মক্কার কাবা শরিফে হজ্ব ব্রত পালন ও মদিনায় রাসুল (সা.)-এর রওজা মোবারক জিয়ারতের উদ্দেশ্যে আমি জন্মভূমি তানজানিয়া ত্যাগ করি। পথের সঙ্গী হিসেবে কোনো বন্ধু বা ভ্রমণকারী না পেয়ে আমাকে একাকীই রওনা হতে হয়। পবিত্র স্থানগুলো দর্শনের অদম্য আবেগ ও বাসনা নিয়ে আমি প্রিয় বন্ধুবান্ধব ও গৃহের মায়া কাটানোর সংকল্প করি।’
তখন পায়ে হেঁটে, পুশুর উপর সওয়ার হয়ে ও নৌকা করে হজ্ব ব্রত পালন করা হতো। ইবনে বতুতা বলেন, মাগরিব থেকে হজযাত্রীদের সাধারণ পথ ছিল উত্তর মিসরের মধ্য দিয়ে। অতঃপর তিনি দামেস্কের হজ্ব যাত্রীদের সঙ্গে যোগ দেন। রমজান মাস দামেস্কে কাটিয়ে তিনি মদিনাগামী একটি হজ্ব যাত্রী দলের সঙ্গে যোগ দেন। হজ্ব যাত্রী দলে বড়ো কাফেলা ছিল। প্রত্যেকেরই তার বহনকারী পশু, রসদ এবং অন্যান্য খরচের জন্য অর্থের যোগান ছিল। দামেস্ক থেকে মদিনার দূরত্ব প্রায় ৮২০ মাইল এবং এই পথ দিয়ে যেতে ৪৫ থেকে ৬০ দিন সময় লাগে। পথ অতিক্রমও খুব সহজ ছিল না। পথে অনেকে মহামারী রোগে পড়ত ও মারা যেত। এছাড়া স্থানীয় যাযাবররাও আক্রমণ করত। তা সত্ত্বেও হজ্ব যাত্রীরা ভ্রমণ থেকে বিচ্যুত হতেন না। যে কারণে যাচ্ছে তা পূর্ণ না হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা সামনের দিকে চলতে থাকত।
সন্দ্বীপে ৩ ধরণের হাজী সাহেব ছিলেন। বোম্বাই হাজী, করাচি হাজ্বী ও আলহাজ্ব। সন্দ্বীপ থেকে যারা যেতেন, তাদের অর্থবিত্ত ছিল, শরীরের পড়ন্ত বিকেল/শক্তি ও ঈমানই কেবল তাদের পৌছিয়ে দিতো সেই আরাধ্য মঞ্জিলে। সমাজের ভাগ্যবান ব্যাক্তিরাই হজ্বে যেতে পারতেন। অনেক সময় বংশের আশরাফ আতরাফ নির্ধারিত হতো হজ্ব করা না করার মধ্যে। হাজ্বী সাহেবের নাতনির বিয়ের ব্যাপারটা অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে বিবেচনা করা হতো। সন্দ্বীপ সমাজে হাজ্বী সাহেবের বাড়ির মেয়েদের কদর করা হতো। অতি সহজে বিয়ে হয়ে যেত।
হজ্ব পালন করা দূর দেশে ছিল বলে নিজের ছেলে মেয়েদের বিয়ে শাদী দিয়ে দিtতন। স্ত্রীর প্রতি কোনো সময় অবিচার করে থাকলে, তা মাফ চেয়ে নিতেন। পারিবারিক দায় দায়িত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিতেন। অনেক বছর ধরে পরিকল্পনা ও টাকা পয়সা সংগ্রহ করা ছিল উনাদের বিশেষ কাজ। আর এইভাবে হজ্বের প্রস্তুতি চলতো বছরের পর বছর। সব ধরনের বৈষয়িক, পারিবারিক আশয় বিষয় থেকে মুক্ত করতেন প্রথমে। ছেলেমেয়ের মধ্যে সহায়-সম্পত্তির ভাগ বাঁটোয়ারা ও আর্থিক লেনদেনের হিসাব কিতাব চুকিয়ে রওয়ানা হতেন ইসলামের সর্বশেষ অবশ্যিই পালনীয় ফরজ কর্তব্য পালন করতে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে সবাই শেষ বয়সে, বৃদ্ধ বয়সে হজ্বে যেতেন। অনেকেই ভয়ে থাকতেন এই জন্য যে, হয়তো আর ফিরে আসতে পারবেন না। নানাবিধ কারণে যেমন বিপৎসংকুল দীর্ঘ যাত্রা, রোগশোকে ও মহামারীতে অনেকেই পথিমধ্যে মারা যেতেন, কেউ কেউ হারিয়েও যেতেন। ফলে ভাবতেন, যাব যেহেতু একেবারেই যাই। কেউ কেউ মক্কা বা মদিনায় মারা যাওয়ার আশাও পোষণ করতেন। কারও আবার ফিকির ছিল, হজ্ব করে আসার পর দুনিয়াদারি ছেড়ে দিবেন। সংসার বৈষয়িক মায়াজালের মোহ থেকে দূরে থাকতে হলে- শেষ বয়সে হজ্বে গেলেই ভালো।
এক করুণ দৃশ্যের অবতারণা হতো যখন হাজ্বী সাহেবরা নিজ বাড়ি থেকে বিদায় নিতেন। এ এক ধরণের জীবন্ত বিদায় ছিল। অশ্রু ভিজা, কান্না কান্না পরিবেশ, মাতম বিশেষ করে বিবাহ উপযুক্তা কন্যা বা শেষ বয়সের বৌ থাকলে। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী মাদ্রাসা- মক্তবের হুজুর ছাত্র শিক্ষকগণ এগিয়ে দিতেন তাদের স্টীমার ঘাট পর্যন্ত। লাল শালু কাপড়ের পতাকা, চাঁদ তাঁরা খচিত পতাকা, সাদা কাপড়ের পতাকা উড়িয়ে সন্দ্বীপ টাউনের উপর দিয়ে মিছিল সহকারে পদব্রজে কাফেলা এগিয়ে যেতো স্টীমার ঘাটের দিকে। সঙ্গীয় লোকজন বলতো- ‘(অমুক) — হাজ্বী জিন্দাবাদ’। লাব্বাইক লাব্বাইক ইয়া আল্লাহ। ইয়া আল্লাহ লাব্বাইক লাব্বাইক। বাড়ির নাম ও গ্রামের নাম বলে ধ্বনি দিতো। (টাউনের) লোকজন হাজী সাহেবের সাথে মোসাব্যাহ করতেন। বলতেন – নবীজির দরবারে, মদিনায় যেন তার পক্ষ থেকে নবীজির রওজা মোবারকে সালাম পৌঁছে দেন। সাথে মোসাব্যাহ করার সময় কিছু তোহ্ফাহও খেদমত হিসাবে হাজ্বী সাহেবকে দিয়ে দিতেন।
হজ্বে গমনেচ্ছুক সন্দ্বীপের বিভিন্ন এলাকা থেকে একত্রিত হতেন অধুনালুপ্ত টাউনের পশ্চিমে স্টীমার ঘাটে। চট্টগ্রাম থেকে তারপর দল বেঁধে পায়ে হেঁটে, গরু-মহিষের গাড়িতে চেপে বা দাঁড়টানা নৌকায় করে, ট্রেনে চেপে ভারতের বোম্বাই/মুম্বাই এসে একত্রিত হতেন। বোম্বাই পর্যন্ত পেশাদার পথপ্রদর্শক থাকতো। দীর্ঘ পথের ক্লান্তিতে ও বয়সের ভারে বোম্বেতেই কেউ কেউ থেকে যেতেন। কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়তেন, কেউ কেউ আবার জাহাজ মিস করতেন। কাফেলা ছাড়া আবার সন্দ্বীপে ফিরে আসা মহা সংকটের ব্যাপার ছিল। তাই তারা বোম্বাইতে থেকে যেতেন। সামর্থবান হাজ্বীগণ মক্কা শরীফ থেকে ফিরে এলে আলহাজ্বদের সাথে ফিরে আসতেন তারা। যারা নানা কারণে মক্কা শরীফে যেতে পারেননি। তাদেরকে বোম্বাই হাজ্বী বলা হতো।
কথিত আছে যে, সন্দ্বীপ টাউন ও আশে পাশের এলাকা থেকে একবার ৩ জন বন্ধু মিলে হজ্ব ব্রত পালনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলেন। ২ জন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বোম্বাইতে। ফলে স্টীমারে ও কাফেলায় শরিক হতে পারেন নি। ২ জনই বোম্বাই থেকে ফিরে এসেছিলেন সঙ্গী কাফেলার সাথে। উনাদের নাম এখনো হাজ্বী হিসাবে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন ইমারতে। স্টীমারে বা নৌকায় বোম্বাই থেকে করাচিতে। অতঃপর করাচি থেকেও জাহাজে বা নৌকায় উঠতেন আরও হজ্ব যাত্রীগণ। এরপর আরব সাগর পাড়ি দিয়ে আরব উপদ্বীপের এডেন বন্দরে নোঙ্গর করতো জাহাজ। তারপর জেদ্দা। এরপর হজ্ব ব্রত শুরু।
কয়েক মাস পরে জমজমের পানি আর মদিনার খেজুর নিয়ে ফিরে আসতেন আলহাজ্বগণ। কোনো এক দিন সেই স্টীমার ঘাটে আবার লাব্বাইক ধ্বনিতে মুখরিত হতে থাকে। এবার আনন্দের দৃশ্য, হাসি মুখ ও হাজ্বী সাহেবদের নিজ বাড়ি থেকে অভিনন্দন জানানোর আয়োজন। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী মাদ্রাসা-মক্তবের হুজুর ছাত্র শিক্ষকগণ এগিয়ে নিতে আসতেন সন্দ্বীপ স্টীমার ঘাট থেকে। লাল শালু কাপড়ের পতাকা, চাঁদ তাঁরা খচিত পতাকা, সাদা কাপড়ের পতাকা উড়িয়ে সন্দ্বীপ টাউনের উপর দিয়ে মিছিল সহকারে পদব্রজে কাফেলা এগিয়ে যেতেন নিজ বাড়ির প্রাণে। সঙ্গীয় লোকজন বলতো- ‘(অমুক) — হাজ্বী জিন্দাবাদ’। বাড়ির নাম ও গ্রামের নাম বলে ধ্বনি দিতো। লোকজন হাজ্বী সাহেবের সাথে মোসাব্যাহ করতেন। হাজী সাহেবও বলতেন – নবীজির দরবারে, সালাম পৌছিয়ে দিয়েছি। মোসাব্যাহ করার সময় দোয়া করতেন ও মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। হাজ্বী সাহেব জমজম শরীফের পানি, মদিনার খোরমা খাজুর, তসবিহ, মেসওয়াক ও জয়তুনের তেলের জন্য বাড়িতে যেতে বলতেন।
উৎসুক অনেকে হাজ্বী সাহেব থেকে এই দীর্ঘ পথের গল্প শুনতে আসতেন। হাজ্বী সাহেবের বাড়িতে। আর এভাবেই সেকালে গ্রামে–গ্রামে, পাড়ায়- পাড়ায়, মহল্লায়–মহল্লায় মুখে মুখে রচিত হতো হজ্বের মনোরম, অপূর্ব ও ঈমানী ভ্রমাণাখ্যান। আলহাজ্ব সাহেবগণ বাড়িতে ও মসজিদে বসে আল্লাহ বিল্লাহ করতেন। লোকালয়ে কমই আসতেন।
অথচ আজ!
স্মৃতিকথনে: শিব্বীর আহমেদ তালুকদার
আইনজীবী, সমাজ সংগঠক ও কথ্য ইতিহাস গবেষক।
sandwip21st@gmail.com
(মতামত ও বানান রীতি লেখকের নিজস্ব, সোজা কথা ডটকম-এর এতে কোন দায় নেই)