৭ বছর আগে ৬ই মার্চ ২০১৩ এর বিকালে ১৭ বছর বয়সী সদ্য তারুণ্যে পা রাখা মেধাবী তরুণ তানভীর মুহাম্মাদ ত্বকী স্থানীয় এক লাইব্রেরিতে যাচ্ছিল বই আনতে। এই তরুণকে ঘাতকরা পথ থেকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর আন্দোলন, হরতাল সহ বহু কর্মসূচির বহু পানি গড়িয়েছে।
আলোচিত তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যা মামলার একজন আসামি সুলতান শওকত ওরফে ভ্রমর গত ১২ নভেম্বর ২০১৩ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। জবানবন্দীতে উঠে আসে ত্বকী হত্যার বিস্তারিত বিবরণ, নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে তার অফিস ‘উইনার ফ্যাশনে’ ত্বকীকে নির্মম ভাবে নির্যাতনে করে খুন করা হয়েছে বলে ভ্রমর জানায়। এ মামলার তদন্তকারী সংস্থা ৱ্যাব তাঁদের অভিযোগ পত্রে বিস্তারিত উল্লেখ করে তা সংবাদ সম্মেলনে জানায়। কিন্তু সে অভিযোগ পত্র আজও আদালত পর্যন্ত পৌঁছায়নি।
ত্বকীর বাবা ছেলের জন্মদিনে এক হৃদয় স্পর্শী স্মৃতিচারণায় লিখেছেন ভীনদেশিদের শাসনামলে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে একটা সময় হয়তো কাঁদতো কিন্তু এখন তা প্রকাশ্যে চিৎকার করে কাঁদলেও প্রতিকার নেই। এ আমাদের স্বাধীন দেশ!
পৃথিবীর খুব কম দেশেই অপরাধীরা আইনের উর্দ্ধে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকতে পারে। সরকারের আনুকূল্য ছাড়া কখনো কোন দেশেই অপরাধীরা আইনের বাইরে থাকতে পারে না। কিন্তু আমাদের এ দেশটাতে পারে। কারণ ঘাতকরা থাকে সরকারের প্রশ্রয়ে। এখানে বিচার যা দু চারটে হয় তা যেমন রাজনৈতিক প্রয়োজনে যা আটকে থাকে তাও রাজনৈতিক প্রয়োজনে।
ত্বকী হত্যার বিচারের মতোই প্রশ্ন চিহ্ন হয়ে আছে আরো দুটি আলোচিত হত্যাকান্ড একটি সাগর-রুনি এবং অপরটি তনু। আরেকটি আলোচিত বিশ্বজিৎ হত্যা মামলাটির দ্রুতবিচার ট্রাইবুন্যালে বিচার হয়। মামালার রায়ে আট জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে হাইকোর্টের রায়ে ৬জনের মধ্যে দু’জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল, ১৫ জনের আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং চার জনকে খালাস দেয়া হয়েছে।
অতি সম্প্রতি আরেকটি আলোচিত হত্যা মামলার রায় এসেছে। বরগুনার চাঞ্চল্যকর রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় স্থানীয় একটি আদালত রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিসহ ছয় জন আসামির মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। যদিও ভিডিওতে দেখা গিয়েছে মিন্নি তার স্বামীকে বাঁচানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে কিন্তু কোর্ট তাকে ‘মাস্টার মাইন্ড’ ডিক্লেয়ার করে ফাঁসির রায় জানায়।
মূল আসামি নয়ন বন্ড যার সঙ্গে এলাকার সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে আওয়ামীলীগ নেতা সুনাম দেবনাথের ঘনিষ্ঠতা এলাকায় সর্বজনবিদিত। নয়ন মাদক কারবারি ছিল,তাই সুনামের সঙ্গে তার যোগসূত্রের কথা খোদ স্থানীয় আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাই বলছেন। তাঁরা বলছেন, রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় না থাকলে এত বড় অঘটন ঘটানো সম্ভব নয়। তা ছাড়া একাধিক মামলার আসামি প্রকাশ্যে আসতেও পারে না। রিফাত শরীফ খুনের পর সুমন দেবনাথ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একাধিক স্ট্যাটাস পোস্ট করেছেন। একটি পোস্টে তিনি রিফাত হত্যায় স্ত্রী মিন্নিকে ‘মূল ভিলেন’ হিসেবেও ইঙ্গিত করেছেন।এই নয়নকে ক্রস ফায়ার দিয়ে হত্যা করে এলাকার প্রভাবশালীদের প্রভাবে যে এ নিম্ন আদালতের রায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
পুলিশ রিম্যান্ডের পর ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি বা লোয়ার কোর্টের রায় প্রাদানের সীমাবদ্ধতা এসব কিছু জানার পরও দেখা যাচ্ছে মূলত মিন্নির ফাঁসির রায়ে বাংলাদেশের মানুষের মাঝে যেন গত একযুগে হারিয়ে যাওয়া বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা ফিরে এসেছে দারুণ ভাবে!! বিচিত্র এ দেশ আরো বিচিত্র এ দেশের মানুষের মন! এ অন্ধকারে ঢাকা বিচার ব্যবস্থা যাঁদের দ্বারা তৈরি মাঝে মাঝে মনে হয় এ দেশ জাতিকে শাসন করতে তাঁরাই শাসক হিসাবে উপযুক্ত !!
সবশেষে ত্বকীর বাবা’র আক্ষেপ “এই কি আমাদের স্বাধীন দেশ”! নিয়ে একটি প্রশ্ন সত্যিই কি আমরা স্বাধীন হয়েছি ? পোস্টকলোনিয়াল ডিসকোর্সের অন্যতম পুরোধা এডওয়ার্ড সাঈদ তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ওরিয়েন্টালিজমে’ বলেছেন কলোনিয়াল দেশগুলোর মানুষের একটা অংশ কলোনিয়াল শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে মূলত তাদের বিতাড়িত করে ওই জায়গাটা দখল করার জন্য। তাই ‘স্বাধীনতা’ বলে যে বস্তুটা নিয়ে আমাদের মহাতৃপ্তি, প্রায় সব ক্ষেত্রে সেটা আসলে বিদেশি শক্তির হাত থেকে দেশি শক্তির হাতে ‘ট্রান্সফার অব পাওয়ার’। তাই ব্রিটিশ, পাকিস্তানি সব শাসনের অবসান হলেও আমাদের সরকার, প্রশাসনের এবং বিচার বিভাগের সেই কলোনিয়াল ঘোর বা কর্তৃত্ববাদী মনোভাব এখনো জ্বলজ্বলে। আমাদের ক্ষেত্রেও এটিই চরম সত্য।
– এন আফরোজ রোজী: লেখক