রাষ্ট্র বা সরকার চায়নি কিন্তু সে কাজ সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে,এটা একেবারেই অসম্ভব। তা ভালো হোক আর মন্দই হক। সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পার হয়ে যে লালমুখো শয়তানগুলো এদেশে এসেছিলো,১৯০ বছর তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভারতবর্ষ একটা দিনও চলতে পারেনি। রক্তের বন্যায় ভেসেছে ভারত। কিন্তু কিছুতেই ভারতীয়দের ইচ্ছা প্রতিষ্ঠা পায়নি,যতদিন না ইংরেজদের তাড়ানো সম্ভব হয়েছে। ইংরেজ আমাদের মসলিন শিল্পকে ধ্বংস ক’রে দিয়ে গেছে। কৃষকদের ক্রীতদাসের মতো খাটিয়ে এদেশে নীল চাষ করেছে ব্রিটিশ বেনিয়ারা। তারপর অনেক রক্তের পথ বেয়ে এলো আমাদের আলাদা জামানা-পাকিস্তান। সে এক অদ্ভুত দেশ পাকিস্তান! ভাষা আলাদা,সংস্কৃতি আলাদা। দুই প্রান্তে দুই ভূখণ্ড মাঝে ইণ্ডিয়া। তারপরও এক দেশ! সেই অদ্ভুত দেশ পাকিস্তানের ইচ্ছার দাসত্ব করবো না বলে কী রক্তক্ষয়ী লড়াইটাই না আমাদের লড়তে হয়েছে!
আমাদের স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের স্বার্থ বিবেচনা ক’রে একটা দিনও আমাদের দেশকে চালানো হয়নি। আমাদের যুদ্ধকন্যাদের স্বাধীন দেশ থেকে যে বের ক’রে দেওয়া হোলো,সে ঐ কর্তারই ইচ্ছায়। কোনো মা বাবা বা পরিবার নিজের আদরের সন্তানকে ধরে রাখতে পারলো না। মায়ের নাড়ি ছেড়া ধন হারিয়ে গেলো কোন্ অজানা দেশে। তারা কোনোদিন আর ফিরে এলো না। ১৯৭৩ সালের ৯ই মার্চ ঝিনেদার মধ্য শহরে সকাল ১০ টায় জোড়া খুন হয়ে গেলো দু’জন ছাত্রনেতা। জারা ছিলেন প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা। সে হত্যার বিচার তো দূরের কথা,মামলা পর্যন্ত হয়নি। কর্তা না চাইলে কীভাবে বিচার বা তার সুরাহা হবে? সামরিক শাসন এলো এরপর। আহা তখন রাজাকারের সে কি আনন্দের দিন! রাজাকারের বিচার এর আগে আমরা পাইনি এটা ঠিক। কিন্তু এখন যেন রাজাকার বাহিনী পেখম তুলে নাচতে শুরু করলো। অবিশ্বাস্যভাবে স্বাধীনতার মাত্র ৯ বছরের মাথায়,তখনো আমাদের মাটি থেকে রক্তের দাগ শুকায়নি, শাহ্ আজিজের মতো কুখ্যাত লোক এমনি একটি সময়ে লম্ফ দিয়ে আমাদের মদ্যিখানে এসে হাজির হয়ে গেলো। এবং রাতারাতি যেন আমাদের ভাগ্যবিধাতা হয়ে গেলো স্বাধীনতা বিরোধী লোকটা। সবুর খানের মতো কুখ্যাত দেশদ্রোহীর কবর সংসদ ভবন চত্তরে জগদ্দল পাথরের মত স্থায়ী আসন ক’রে নিয়েছে। যেন আমাদের বুকের উপর পা তুলে দাঁড়িয়ে আছে দেশদ্রোহী সবুর খান। এবং তা আমাদের দেশের তৎকালীন কর্তাব্যক্তিরা চেয়েছিলেন বলেই এমন অসম্ভব সম্ভব হয়েছে। আমরাও কেমন যেন রাতারাতি পাল্টে গেলাম! অনুগত মানুষের মতো মেনে নিলাম সবুর খানের এই নির্মম উপহাস এবং অপমান। কারণ তখন ঘুড়ির লাটাই ছিলো সামরিক জান্তার হাতে। এরপর থেকে তো দেশদ্রোহী রাজাকার বাহিনীর কপাল খুলে গেলো। রমরমা বাজার পেয়ে গেলো রাজাকারের বানিজ্য।
এরশাদ আমল থেকেই আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় লাম্পট্যের জয়যাত্রা শুরু। সেরকমই শক্তিশালী গুঞ্জন ছড়িয়ে আছে আমাদের দেশের আনাচে কানাচে। সেই লাম্পট্য নিয়ে আড়ালে আবডালে অনেক হাসি তামাসা হয়েছে। কিন্তু বড় ধরণের কোনো সমালোচনা বা প্রতিবাদ হয়েছে বলে মনে পড়ে না। আমাদের দেশে এরশাদের হাত ধরে সেই যে লাম্পট্যের চাষাবাদ শুরু হোলো,কালক্রমের তা একেবারে স্থায়ী রূপ নিয়ে নিলো। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম বলে কথা। লাম্পট্যের সেই ধারা ডালপালা বিস্তার ক’রে আজ ধর্ষণের মতো ভয়াবহ ব্যাধির জন্ম দিয়েছে। এরশাদ আজ ক্ষমতার বাইরে তো বটেই,ধরাধাম থেকেই ভদ্রলোক বিদায় নিয়েছে। কিন্তু সাপের দংশনের মতো ঢেলে দিয়ে গেছে ভয়াবহ এক বিষ। যে বিষের সংক্রমণে আমরা জর্জরিত। তবে এরশাদের কাছ থেকে যতটুকু নিংড়ে নেওয়া যায় আমাদের বর্তমান কর্তা ব্যক্তিরা তা নিতে অবশ্য কসুর করেননি। এ যেন রিলে রেস। এরশাদের সময়ের লাম্পট্যের ধারা আজ ধর্ষণে রূপ নিয়েছে। এবং সবই ঘটছে কর্তার ইচ্ছায়। এখানে কর্তা মানে কোনো বিশেষ ব্যক্তি নিশ্চয় নয়।
এখন আসি মূল কথায়। একটা দেশ বা রাষ্ট্র চায়নি,সে রকম কোনো আইন বা ঘটনার চর্চা সেই দেশের জনগন করেছে তা কোনোদিনই ঘটেনি বা তা সম্ভবও নয়। কর্তার ইচ্ছার প্রতিফলনই জনগনকে ভোগ করতে হয়। তা ভালো লাগুক আর না লাগুক। আজ আমাদের দেশে ২২ দিনের রক্তের পিণ্ড থেকে শুরু ক’রে ৭০ বছরের ক্লান্ত নারীও ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না,সে অন্যায়ের বীজ বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং সরকারের মধ্যেই মিশে আছে। এবং সরকারের হাত ধরে তা জনগনের মধ্যে সংক্রমিত হচ্ছে। রাষ্ট্র বা সরকার চায় না,কিন্তু তারপরেও ধর্ষণ চলবে,তা কোনোদিন হতে পারেনা। বা তা একেবারেই অসম্ভব। বর্তমানে আমাদের উপর ধর্ষণ সহ যত ধরণের অন্যায় হচ্ছে,তা বর্তমান সরকার ব্যবস্থা চাচ্ছে বলেই হচ্ছে। এখন কথা হোলো আমরা কতখানি রুখে দাঁড়াতে পারবো।
কথা শেষ করবো ইতিহাসে জায়গা ক’রে নেওয়া জ্যোতি বসুর একটা বিখ্যাত বাক্য দিয়ে। ইন্দিরা গান্ধীর দুঃখজনক মৃত্যুর পর গোটা ভারতে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে পশ্চিমবঙ্গ সেই দাঙ্গার কবলে পড়েনি। জ্যোতি বসু তখন পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। সাংবাদিক সমাজ জ্যোতি বসুর কাছে জানতে চাইলো,পশ্চিমবঙ্গে দাঙ্গা না হওয়ার পিছনে কারণ কী? উত্তরে জ্যোতি বসু বলেছিলেন,# আমরা বা আমার সরকার দাঙ্গা চাইনি তাই এখানে দাঙ্গা হয়নি। আর দাঙ্গা হলেও শক্ত হাতে তা দমন করা হোতো এবং এটাই সত্য কথা যখন যে সরকার যা চায়,সেই দেশে তাই ঘটে। এবং তা ধর্ষণের মতো ভয়াবহ কাণ্ড হলেও।
– তাহেরা বেগম জলি, সাবেক শিক্ষিকা, রাজনৈতিক কর্মী