সোজা কথা ডেস্ক রিপোর্ট: অব্যাহত আলোচনা সমালোচনার মুখে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের একলাসপুরে গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে ধর্ষণ চেষ্টা ও নির্যাতনের ঘটনায় গ্রেফতার মূল হোতা দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ারকে অবশেষে আসামি হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হলো। শনিবার রাতে টেলিফোনে বিষয়টি নিশ্চিত করে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন বেগমগঞ্জ থানার ওসি হারুন অর রশিদ। এর ফলে এ মামলায় দেলোয়ারের আসামি না হওয়া নিয়ে যে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে তার অবসান ঘটলো।
স্থানীয় সূত্র জানায়, এ নিয়ে প্রথম থেকেই প্রশ্ন ছিল- যার নেতৃত্বে হামলা ধর্ষণ চেষ্টা ও ভয়ঙ্কর নির্যাতন সর্বোপরি ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে, সেই দেলোয়াকে কাদের স্বার্থে কাদের নির্দেশে আসামি করা হয়নি মামলায়। যে কারণে দেলোয়ার তখন আসামি হয়নি এ প্রশ্নের কোন উত্তর মিলছিল না। যদিও এক বছর আগে ওই গৃহবধূকে ধর্ষণের ঘটনায় মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে দায়ের হওয়া ধর্ষণ মামলায় দেলোয়ারকে আসামি করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, ওই ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে হোতা দেলোয়ার ও তার সহযোগীদের রক্ষায় এখনও তৎপর একটি বিশেষ মহল। ওই কারণে সে সময় দেলোয়ারকে আসামি করা হয়নি।
এ বিষয়ে গতকাল রাতে বেগমগঞ্জ থানার ওসি হারুন অর রশিদ সংবাদকে জানান, গৃহবধূকে ধর্ষণ চেষ্টা ও নির্যাতনের ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলায় দেলোয়ারকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া পর্ণগ্রাফি আইনে যে মামলা হয়েছে সেখানেও দেলোয়ারকে আসামি করা হয়েছে। মামলার শুরুতে ভিকটিম দেলোয়ারের নাম বলেনি। কিন্তু পুলিশি তদন্তে দেলোয়ারের সম্পৃক্ততা থাকায় মামালায় দেলোয়ারকে আসামি করা হয়েছে। এ মামলায় অধিকাংশ আসামি পুলিশ গ্রেফতার করেছে। মামলাটি বর্তমানে তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআইকে দেয়া হয়েছে।
এদিকে গৃহবধূকে ধর্ষণ চেষ্টা, নির্যাতন ও ভিডিও ভাইরাল করার ঘটনায় পৃথক আইনে দায়ের হওয়া দুই মামলায় গ্রেফতার আসামিদের মধ্যে তিন আসামিকে নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তকারী দল। শনিবার বেলা ১১টার দিকে আসামি বাদল, কালাম ও সাজুকে একলাসপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের নির্যাতনের শিকার ওই নারীর বাড়িতে নিয়ে যায় পিবিআই। এ সময় আসামিদের সঙ্গে ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেন পিবিআই কর্মকর্তারা।
স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, ঘটনার দিন মূল নেতৃত্বে ছিল দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার নিজেই। মূলত ওই গৃহবধূর স্বামী দুই সন্তানসহ গৃহবধূকে ফেলে রেখে অন্যত্র চলে যায় এবং দ্বিতীয় বিয়ে করে। এরপর থেকে ওই গৃহবধূ মেয়ে ও ছেলেসহ দুই সন্তানকে নিয়ে বেগমগঞ্জের একলাসপুরের খালপাড় এলাকায় নিজের বাপের বাড়িতে আশ্রিত হিসেবে থাকে।
স্বামী পরিত্যক্তা হিসেবে ওই গৃহবধূর ওপর নজর পড়ে দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ারের। বছর খানেক আগে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে দেলোয়ার ও তার সহযোগী কালাম ওই গৃহবধূকে তুলে নিয়ে একাধিকবার ধর্ষণ করে। ওই ঘটনা কাউকে জানালে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে যায়। এরপর থেকে বিভিন্ন সময়ে ওই নারীকে ধর্ষণ করতে থাকে দেলোয়ার ও তার বাহিনীর সদস্যরা। প্রাণভয়ে ওই নারী এসব কথা কাউকে বলতে পারেননি। কারণ দেলোয়ার ছিল খুবই দুর্ধর্ষ কিলার। কিন্তু দীর্ঘদিন খোঁজখবর না নিলেও গত ২ অক্টোবর ওই নারীর স্বামী আকস্মিক তাদের বাড়িতে এসে হাজির হন। এতদিন খোঁজখবর না রাখা এবং দ্বিতীয় বিয়ে করে অন্য জায়গায় থাকা নিজের ভুল শিকার করে তার কাছে মাফও চান। এতদিন পর হলেও স্বামীকে ফিরে পেয়ে ওই নারীও নানা কারণে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। এরমধ্যে ওই নারীর স্বামী আসার খবর পৌঁছে যায় দেলোয়ারের কাছে। দেলোয়ার এ খবরে অনেকটা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। ওই নারীর স্বামীর উপস্থিতি দেলোয়ার কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিল না। ঘটনার দিন দেলোয়ারের নেতৃত্বে বাদল, মুছা, কালামসহ ১০ থেকে ১২ জনের গ্রুপ এসে ওই নারীর স্বামীকে বেঁধে ফেলে উঠানে। ঘরের মধ্যেই নারীকে বিবস্ত্র করে ধর্ষণ চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে চরমভাবে যৌন নির্যাতনও করা হয়। পা ধরে মাফ চাওয়া, চিৎকার চেচামিটির কারণে নারীকে মারপিটও করা হয়। নিয়ে যাওয়া হয় রাস্তায়। নারীকে ধর্ষণ চেষ্টা এবং যৌন নির্যাতনের সময় দেলোয়ারের দুই সহযোগী আহত হয়। এ কারণে তাদের রাস্তায় নিয়ে গিয়ে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে দেলোয়ার। এরপর চলে যায়। এলাকা ছাড়ার আল্টিমেটাম দেয়া হয়। এরপরই ওই নারী, তার স্বামী, ছেলে মেয়ে ও বাবাসহ পুরো পরিবার আত্মগোপনে চলে যায়। ঘটনা স্থানীয়ভাবে জানানো হলেও কোন প্রতিকার পায়নি তারা। ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবখানেই দেলোয়ারের নেতৃত্ব ও নির্দেশ ছিল। কিন্তু মামলা যখন লেখা হয় তখন দেলোয়ারের নাম ভয়ে আনেননি ওই নারী। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা পুলিশকে বলেছিলেন, কোনভাবেই দেলোয়ারকে এ মামলায় আসামি করা যাবে না। আর এসব কারণেই দেলোয়ার এ দুই মামলায় আসামি হননি।
পিবিআই সূত্র জানায়, গৃহবধূকে ধর্ষণ চেষ্টা, বিবস্ত্র করে নির্যাতন এবং টাকা না দেয়ায় সেই ঘটনার সময় ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগে পৃথক দুই মামলায় গতকাল পর্যন্ত গ্রেফতার ১১ জনের মধ্যে পিবিআইয়ের হেফাজতে ৬ জন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রয়েছেন। ৪ জন অদালতে জবানবন্দি দেয়ায় জেলে আছেন। ঘটনার মূল নেতৃত্বদানকারী বেগমগঞ্জে শীর্ষ সন্ত্রাসী দেলোয়ার অস্ত্র মামলায় আসামি হওয়ার কারণে র্যাব হেফাজতে আছেন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। গৃহবধূকে ধর্ষণ চেষ্টা ও নির্যাতনের এবং সেই দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় পর্ণগ্রাফি আইনে মামলার কোনটিতেই আসামি না হওয়ায় মূল হোতা দেলোয়ারকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারছে না তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই।
পিবিআইয়ের নোয়খালীর পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান মুন্সি টেলিফোনে সংবাদকে জানান, গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে ধর্ষণ চেষ্টা ও নির্যাতনের ঘটনা এবং ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এবং পর্ণগ্রাফি আইনে পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। ওই দুই মামলা শুরু থেকে বেগমগঞ্জ থানা পুলিশ তদন্ত করেছে। মামলার তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর নথিপত্র বুঝে নেয়ার আগেই কয়েকজন আসামি অদাালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। বর্তমানে রিমান্ড হেফাজতে থাকা ৬ আসামি পিবিআই তাদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
পিবিআই এসপি মিজানুর রহমান বলেন, গতকাল মামলার প্রধান আসামি বাদল, আবুল কালাম এবং সাজুকে নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন পিবিআইয়ের তদন্তকারী কর্মকর্তা। ওই ৩ আসামি তদন্তকারীদের ঘুরে দেখিয়েছেন। সেখানে তারা ঘটনার দিন কার কি ভূমিকা ছিল তা বর্ণনা দিয়েছেন। তাদের বর্ণনা অনুযায়ী স্কেচ তৈরি করেছে তদন্তকারী কর্মকর্তা। তবে তদন্তের স্বার্থে এখন সবকিছু পরিষ্কার করে বলা সম্ভব নয়।
পিবিআইয়ের একটি সূত্র জানায়, গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে ধর্ষণ চেষ্টা এবং নির্যতানের মূলে ছিল দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার। কিন্তু ওই ঘটনায় করা দুই মামলার কোনটিতেই দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ারের নাম নেই। বিষয়টি তদন্ত করছে পিবিআই। অন্য যারা আসামি হয়েছেন ইতোমধ্যে তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে। এসব তথ্য পর্যালোচনা করছে পিবিআই।
স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, থানা পুলিশের কাছে মামলাটি তদন্তাধীন থাকার সময় ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় শীর্ষ নেতারা দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ারসহ আসামিদের রক্ষা করতে নানাভাবে তদবির শুরু করে। স্থানীয় নেতাদের তদবিরের কারণে নির্যাতিত গৃহবধূর দায়ের করা দুই মামলায় ঘটনার মূল হোতা যার নেতৃত্বে ওই গৃহবধূকে ধর্ষণ চেষ্টা করা হয়েছে বিবস্ত্র করে সেই দেলোয়ারকে আসামি করা হয়নি। দেলোয়ার যাতে এ মামলায় কোনভাবেই আসামি না হয় এজন্য শুরু থেকেই স্থানীয় নেতারা ছিলেন তৎপর।
গত ২ সেপ্টেম্বর ওই গৃহবধূর স্বামী তার সঙ্গে দেখা করতে দীর্ঘদিন পর বাবার বাড়িতে আসেন। রাত ৯টার দিকে শয়নকক্ষে স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে ছিলেন। এ সময় দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ারের নেতৃত্বে সহযোগী বাদল, রহিম, আবুল কালাম, ইসরাফিল হোসেন, সাজু, সামছুদ্দিন সুমন, আবদুর রব, আরিফ ও রহমত উল্লাহসহ অজ্ঞাত কয়েকজন দরজা ভেঙে তাদের ঘরে প্রবেশ করে। এরপর তার স্বামীকে মারধর করে পাশের কক্ষে নিয়ে আটকে রাখে। ওই গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে প্রথম ধর্ষণ চেষ্টা করা হয়। ধর্ষণ চেষ্টার সময় অন্যরা এ দৃশ্য ভিডিও করে। এক পর্যায়ে ওই নারী চিৎকার করে বলে তাকে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। সেই দৃশ্য ভিডিও করে রাখার পর টাকা দাবি করা হয়। ১ মাস পর্যন্ত ওইদিনের ঘটনায় ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা চাওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত টাকা না পেয়ে ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হলেও দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় শুরু হয়। এরপর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে র্যাব আসামিদের গ্রেফতারের উদ্যোগ নেয়। এক পর্যায়ে দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার ও বাদলকে গ্রেফতার করে র্যাব। পুলিশ বাকি আসামিদের গ্রেফতার করে। এরমধ্যে ৯ অক্টোবর বেগমগঞ্জ থানায় নির্যাতনের শিকার ওই গৃহবধূ পর্ণগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা দুটি মামলা করেন। মামলা দুটি প্রথমে পুলিশ তদন্ত করলেও পরে পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআইয়ে হস্তান্তর করা হয়। দুই মামলায় এখন পর্যন্ত ১১ জনকে গ্রেফতার করা হলেও ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী দেলোয়ার হোসেন র্যাব-১১ এর হেফাজতে নারায়ণগঞ্জে রিমান্ডে রয়েছেন। আর বাকি ১০ জনের মধ্যে চারজন দোষ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়ায় তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে পিবিআইয়ের কাছে থাকা আসামি বাদল, আবুল কালাম, সাজু, মাইন উদ্দিন, সাহেদ ও রহমত রিমান্ডে রয়েছেন। রিমান্ডশেষে তাদের আদালতে তুলে প্রয়োজনে নতুন করে রিমান্ড চাওয়া হবে বলে তদন্তকারী কর্মকর্তা জানিয়েছেন।