শিপু ফরাজী, ভোলা থেকে: ফরিদ মাঝির স্ত্রী বেগম বিবি (৬০), প্রয়াত আবদুল মান্নান চৌকিদারের স্ত্রী বিবি জায়েদা (৫০), সাহেব আলী মিয়া (৮০), আলমগীর হোসেন (৩৫) এবং আরও অনেক জন। চরফ্যাসনের তুলাতলী সরকারি আশ্রয়ণে এদের সঙ্গে দেখা। এদের সবার বাড়ি ছিল ঢালচরে। গত দশ বছরে দ্বীপ ঢালচর বহু মানুষকে বিতাড়িত করেছে। মানুষগুলো কোথায় যাচ্ছে? কী করছে? রোজগারের ব্যবস্থা কী হয়েছে? শিশুরা কী নতুন করে স্কুলের নাগাল পেয়েছে? এইসব সন্ধান করতে গিয়ে তুলাতলী আশ্রয়ণে ঢালচরের অনেক জনের সন্ধান পাই। না, এরা ভালো নেই। ঢালচর এদের সব দিয়েছিল। ঢালচরই আবার সব কেড়ে নিয়েছে। মানুষগুলো আবার পথে বসেছে।
চরফ্যাসনের তুলাতলী সরকারি আশ্রয়ণে পাওয়া ঘরের সামনে জাল মেরামত করছিলেন ভদ্র পাড়ার বেলাল হোসেন। বয়স চল্লিশের কোঠায়। নিজের কাজে মনযোগ রেখেই বেলাল বলছিলেন, এক সময় গৃহস্থালির কাজ করলেও এখন তাকে জীবিকার তাগিদে নদীতে নামতে হচ্ছে। বড় ভাই নীরব আর ছোট ভাই জাহাঙ্গীরও একই পেশায়। দুই ভাই এক ট্রলারে মাছ ধরেন; আরেক ভাই বরফের ব্যবসা করেন। অথচ এরা সকলেই এক সময় নিজেদের জমিতেই চাষাবাদ করতেন। জমি ছিল প্রায় ১৫ একর। আর এই চাষাবাদে নেতৃত্ব দিতেন বাবা সালাহউদ্দিন রত্তন। সেসব এখন অতীত স্মৃতি।বেলাল হোসেন বলছিলেন, পুরনো দিনের কথা মনে করে লাভ কী? ভাগ্যে নাই। তাই সব নিয়া গেছে গাঙ। চাইলে গাঙই আবার দিতে পারে। আগে জমিতে চাষাবাদ করতাম; আর এখন হারিয়ে যাওয়া সেই নদীর স্থানে বয়ে যাওয়া নদীতে মাছ ধরি। জমিতে ভালো ফসল পাওয়ার আশায় আল্লাহকে ডাকতাম, এখন নদীতে বেশি মাছের আশায় আল্লাহকে ডাকি।
এবার চরে গিয়ে খুঁজে পাইনি জেবল হককে । ঘর সরিয়েছেন আমির হোসেন পাটোয়ারী। কালাম পন্ডিতের ঘরের আসবাবপত্র খোলা আকাশের নিচে। সেখানে রান্না হচ্ছে। মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ। পাশেই ‘মরহুমা হালিমা খাতুনের’ বাঁধানো কবরস্থান ভাঙন তীরে। আর বুঝি রক্ষা নেই মুজিবকিল্লা, পাশের বিশাল দীঘি, তার পাশে পাকা ভবনে পুরানো প্রাথমিক বিদ্যালয়- কিছুই নেই। অথচ এগুলো দেখে গিয়েছিলাম মাত্র চারমাস আগে। মালেক মাঝির কলোনি থেকে সাথী আর তার স্বামীকে দ্বীপ থেকে চলে যেতে দেখেছিলাম। ওরা ঢালচর ছেড়ে এখন দক্ষিণ আইচার কলোনীতে। ওদের ধারণা ঠিক- এ বর্ষাটাও টিকলো না মালেক মাঝির কলোনী। এবার গিয়ে চোখে পড়লো কলোনীর শেষ ভিটের অংশ। কলোনীর পাশে দুই প্রবীণ নারী রঙমেহের আর মোমেনা বেগমকে দেখেছিলাম- দু’জন সম্পর্কে বেয়াইন। একসঙ্গেই চলাফেরা করতেন। এই সঙটা ভেঙে গেছে। রঙমেহের চলে গেছেন ওপারে তার ছেলের কাছে; মোমেনা ঢালচরে আছেন তার জামাইয়ের কাছে। হায়রে প্রকৃতি উপকূলের হেরে যাওয়া মানুষেরা আর কত পিছু হটবে? জীবনের এই কী বৈচিত্র্য এই কী নির্মমতা।