নিজস্ব প্রতিবেদক
কভিড-১৯ মহামারীর আতঙ্ক অনেকটা কেটে গেলেও মানুষের মধ্যে ভর করেছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির আতঙ্ক। চাল, ডাল, ভোজ্য তেল, মাছ, মাংস, সবজি সবকিছুর দাম বাড়ছে অবিরাম।
রাজধানীর কচুক্ষেত এলাকার গৃহিণী শামীমা নাসরিন (৪৫) বলেন, সবজির যে দাম, সংসারের হিসাব মেলাতে কষ্ট হয়। অন্য সবজির চেয়ে কদুর (লাউ) দাম কম হওয়ায় কদিন ধরে কদুই বেশি কিনছি। একটা কিনলে পাঁচ সদস্যের পরিবারের দুবেলা সহজে চলে যায়।’
বৃহস্পতিবার (২২ অক্টোবর) সকালে রাজধানীর উত্তর কাফরুল উচ্চবিদ্যালয়ের সামনের ভ্যান থেকে লাউ কিনছিলেন তিনি। ‘সারাক্ষণ’কে তিনি বলেন, ‘কী করব, স্বামীর (ফার্নিচার মিস্ত্রি) একার উপার্জনে পুরো পরিবার চলে। এ জন্য সংসারের খরচ বাঁচাতে কম দামের সবজি খুঁজি।’
একই এলাকার আরেক গৃহিণী স্বর্ণা আক্তার (২৮)। তার স্বামী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তিনি কিনেছেন লালশাক, লাউশাক ও লাউ। স্বর্ণা আক্তার ‘সারাক্ষণ’কে বলেন, ‘আমরা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। হিসাব করে আমাদের চলতে হয়। হঠাৎ কাঁচাবাজারে দাম বাড়ায় আমাদের হিমশিম অবস্থা। সবজির দাম অনেক বেড়ে গেছে। বাড়লেও কী করা, খেয়ে তো বাচঁতে হবে।’
উত্তরা হাউস বিল্ডিং এলাকার গৃহিণী স্বপ্না বেগম (৪২) জানান, ‘কাঁচাবাজারে সবকিছুর দাম বাড়ায় বাজার করা কঠিন হয়ে পড়েছে। আগে যে পরিমাণে কিনতাম, এখন দাম বাড়ায় সবজি কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছি।’
কিশোরগঞ্জের মো. সৈকত (৩০) উত্তর কাফরুল এলাকায় ভ্যানগাড়িতে ১২ বছর ধরে সবজি বিক্রি করেন। তিনি বলেন, ‘গত কয়েক দিনে শাকসবজির দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষ মূল্য যাচাই করে সবজি কেনেন। অন্য সবজির চেয়ে লাউ, পেঁপে ও কুমড়ার চাহিদা বেড়েছে।’ এই বিক্রেতা বলেন, ‘আগের চেয়ে লাউয়ের দাম কমেছে। আগে মাঝারি সাইজের একটা লাউ বিক্রি করতাম ৮০-৯০ টাকায়, এখন বিক্রি করি ৫০-৬০ টাকায়।’
একই মতামত জানালেন সবজি বিক্রেতা মনোরায়া বেগম (৫০)। তিনি বলেন, লাউ সারা বছর থাকে। তবে এখন লাউয়ের মৌসুম না। তারপরও তুলনামূলক দাম কম। তবে আসছে শীতে লাউয়ের দাম বাড়বে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাজারে সবজির দামে এখন নিম্ন ও মাধ্যবিত্ত তো বটেই, অনেক ক্ষেত্রে উচ্চবিত্তরাও চাপে পড়েছে। লাগামহীন দাম বেড়েছে সব ধরনের সবজির। বাজারে শিম, উচ্ছে, টমেটোসহ পাঁচ থেকে সাত ধরনের সবজির দাম শতকের ঘরের ওপরে রয়েছে। মাসখানেক আগেও খুচরা বাজারগুলোতে সবজির দাম গড়ে ৬০ থেকে ৮০ টাকার মধ্যে ছিল। ২০ টাকা বেড়ে এখন তা ৮০ থেকে ১০০ টাকায় উঠেছে। বাজারগুলোতে সাধারণ মানের বেগুনের কেজি ৮০ থেকে ৯০ টাকা হলেও ভালো মানের বেগুন কিনতে লাগছে ১৪০ টাকা পর্যন্ত, হাইব্রিড করলা ৯০ টাকার মধ্যে থাকলেও উচ্ছে কিনতে হচ্ছে ১১০ টাকা কেজি দামে। মাসের ব্যবধানে বাজারে আলুর দামও বেড়েছে কেজিতে ১২ থেকে ১৫ টাকা। ৩৮ থেকে ৪০ টাকার আলু এখন ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা প্রবীণ অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘দ্রবমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সব সময়ই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে ফেলে। এবার তা একটু বেশিই হয়েছে। কেননা একে করোনার কারণে মানুষ দিশাহরা, অন্যদিকে পিঁয়াজ, চাল, ডাল, আলুসহ বিভিন্ন ধরনের নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি। অন্যান্য সবজির বাজারে চরম অস্থিরতা।’
তার মতে, আগে মানুষ সব ধরনের সবজি আর মসলার পেছনে যা ব্যয় করত এখন তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে শুধু পিঁয়াজ আর আলুর পেছনে। আর আয়বৈষম্য তো আমাদের অর্থনীতির একটা পুরনো ইস্যু। কেননা আমাদের সম্পদগুলো অল্প কিছু মানুষের কাছে কেন্দ্রীভূত। ফলে যাদের সম্পদ বেশি তারাই ধনী হচ্ছে। আর যাদের সম্পদ কম বা সম্পদ নেই তারা আগের তুলনায় আরও গরিব হচ্ছে। এর ফলে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের সম্পদ গড়ে তোলা খুব কঠিন।’ প্রায় সব সময়ই তাদের আয়ের চেয়ে ব্যয়ের পরিমাণ বেশি বলে তিনি মনে করেন।