শুনশান সকাল,ঘুম ভাংলো কথা কাটাকাটির আওয়াজে। আমি তা শুনেই বুঝতে পেরেছি,পুলিশের সঙ্গে আমার মায়ের কথা কাটাকাটি হচ্ছে। পুলিশ যে ভাবেই হোক জেনেছে আমি বাসায় আছি এবং যথারীতি মা তা স্বীকার করছেন না। আমার কানে এলো মা বলছেন,কে বলেছে আমার মেয়ে আছে। পাল্টা কথা কানে এলো,আমরা জেনেই এসেছি। মা আজ একটু বেশি সকালেই রান্নাঘরে ঢুকেছিলেন-আমাকে বিদায় দেবেন বলে। হুলিয়া মাথায় নিয়ে আমি কাল রাতেই এসেছি,আমার দু’মাস বয়সী মেয়েকে দেখবো বলে। কথা ছিলো ভোর হতেই আমি চলে যাবো। কিন্তু যাওয়া হয়নি। মেয়ের সঙ্গে আমার সময়টা কাটছিলো আনন্দেই। কিন্তু এর মধ্যেই পুলিশের বুটের আওয়াজ আমার সব হিসাবের গোলমাল করে দিলো। মা এবং পুলিশের বাক বিতণ্ডার ভিতরেই আমি দরজা খুলে পুলিশের সামনে এসে দাঁড়াই। এ ছাড়া সে সময় আমার আর কোন উপায় ছিলো না। তখন কোথায় লুকাবো আমি! আমি নিজে না বেরোলে ওরাই তো ঘরে ঢুকবে। শেষে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমিই বেরিয়ে এলাম। পুলিশের সামনে গিয়ে বললাম,আপনারা মনে হয় আমার জন্যই এসেছেন। হঠাৎ ঝড়ের মুখে পড়লে সব কিছু যেমন এলোমেলো হয়ে যায়,আমার মায়ের অবস্থা তখন তাই হোলো। এদিকে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ঝিনেদা মহকুমা পুলিশ অফিসার জনাব আমানুল্লাহ্ সাহেব। পোশাকে লাগানো তার নামের ফলকই সে পরিচয় জানান দিচ্ছিলো। তিনিই দলবল সহ আমাকে ধরতে এসেছেন। আনি জনাব আমানুল্লাহ্ সাহেবের কাছে কিছুটা সময় চেয়ে নিয়ে বললাম,কাপড় টা একটু বদলানো দরকার। সেই সুযোগে মায়ের হাত ধরে ঘরে ঢুকে,মায়ের সঙ্গে জরুরী কয়েকটা কথা সেরে নিলাম। আমি মাকে একটু ধাতস্ত করবার চেষ্টা ক’রে বললাম,এখন ভেঙ্গে পড়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকলে সময় নষ্ট হবে মা। বরং যা বললাম,সে কাজগুলো একটু করবার চেষ্টা করো। আমরা কথা বলছিলাম খুবই আস্তে। তারপরও লক্ষনীয় ছিলো,আমাদের কথা শুনবার বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখালেন না পুলিশ অফিসার। মনে হোলো তিনি কিছুটা সময় আমাকে দিতেই চাইলেন। আমি পরনের কাপড় পাল্টে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। আমার প্রথম সন্তান জোবাইরা জাহানারা দীপু,যার আকর্ষণ আমার গোপন রাজনৈতিক জীবনের সকল বিপদ উপেক্ষা করতে বাধ্য করেছিলো। আমার সেই সন্তান,তার কাছ থেকে আমাকে বিচ্ছিন্ন করতে আজ যমদূতের মতো পুলিশ আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। শেষ পর্যন্ত মেয়েকে আমার ছাড়তেই হোলো।
আমার ইমিডিয়েট বড় বোন শাহানা বেগম ডলি আমার পাশেই ছিল। সে ছিলো সদ্য বিবাহিতা। আমার মেয়ের জন্য মাকে সাহায্য করতে সে শশুরের বাড়ি থেকে কিছুদিনের জন্য এসেছে। আমার মেয়ে এতক্ষন আমার কোলেই ছিল। বোন কোনো কথা না বলে শুধু আমার পাশে পাশে থাকছিলো। আমার সঙ্গে কথা হয়ে গেলে মা আবার রান্না ঘরেই ঢুকে গেলো। সম্ভবত মা আমার হাতকড়া পরা চেহারা দেখতে চাইছিলেন না। তবে এতো সবের মধ্যে আমার প্রতি তখন পুলিশের কোনো তাড়া ছিলো না। কারণ, তারা বুঝতেই পারছিলো আমি যাওয়ার জন্যই তৈরি হচ্ছি। বরং তারা নিরবে যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে আমার প্রতি নজর রাখছিলো। আমাকে তৈরি হওয়ার সুযোগ দিচ্ছিলো। এবার আমি যাওয়ার জন্য এগিয়ে গেলাম। সব কিছু ঘটছিলো খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে। আমাকে শেষ পর্যন্ত হাতকড়া পরানো হোলো না। এবার পুলিশ পরিবেষ্টিত হয়ে আমি বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলাম। মা আমার সামনে এলেন না। আমার সঙ্গে পুলিশের গাড়ি পর্যন্ত এলো আমার বোন শাহানা বেগম ডলি। বোনের কোলে মেয়েকে দিয়ে আমি পুলিশের গাড়িতে গিয়ে বসলাম। সেটা ছিলো একটি জীপ গাড়ি। আমাকে বসানো হোলো ভিতরের দিকে। এস ডি পি ও জনাব আমানুল্লাহ্ সাহেব বসলেন,জানালার ধারে। এদিকে ততক্ষনে আমাদের আশেপাশের মানুষজনের ঘুম ভাঙতে শুরু করেছে,যথারীতি আমার চারপাশে উৎসুক মানুষের ভিড়ও বাড়তে শুরু করেছে। তখন পুলিশের দিক থেকে দ্রুত স্থান ত্যাগ করবার তাড়া অনুভব করলাম। এই সময়ের মধ্যে আমার সঙ্গে এবং আমার পরিবারের কারো সঙ্গে পুলিশের দিক থেকে কোনো খারাপ ব্যবহার করা হয়নি। পুলিশের এই ভদ্র আচরণ সম্ভবত জনাব আমানুল্লাহ্ সাহেবের কারণেই সম্ভব হোলো। তিনি বাস্তবে ভদ্রলোকই ছিলেন। আমি এতকিছুর মধ্যেও খেয়াল করেছি,তিনি সব দিকে লক্ষ্য রাখছিলেন। তিনি কিছু আগে যখন আমার মায়ের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করছিলেন,তখনও তার গলার স্বর ছিলো খুবই সংযত। তিনি মাকে বার বার শুধু বলছিলেন,আমি নিশ্চিত হয়েই এসেছি আপনার মেয়ে এখানে আছে। আমি নিজে বেরিয়ে আসবার পরে তিনি আমার মাকে এ কথা বলেন নি,”এতক্ষন কেন অস্বীকার করছিলেন?”সাধারণত পুলিশ যা করে। আমানুল্লাহ্ সাহেব আমাকে তার পাশে বসিয়ে বললেন,আপনার মা বোন এবং সন্তানের সামনে আমি আপনার হাতে হ্যান্ডকাপ দিতে পারলাম না। কিন্তু তাই বলে পালানোর চেষ্টা করবেন না। এবং চাইলেও তা পারবেন না।
আমি পুলিশের গাড়িতে উঠেই লক্ষ্য করলাম,আমার বাসা সহ অনেক বড় এলাকা পুলিশের দখলে। এই কাজটা তারা ক’রে রেখেছে মাঝরাতেই। তার মানে আমি যে অন্ধকার থাকতে থাকতেই চলে যেতে চেয়েছিলাম তা একেবারেই সম্ভব হোতো না। আমি যখন এতো সব ভাবছি। আমানুল্লাহ্ সাহেব তখন বললেন,আমাদের কাছে খবর ছিলো আপনি অন্ধকার থাকতেই চলে যাবেন। আমরাও সেই প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলাম। আপনি সব জেনে পালানোর চেষ্টা করলেও তা পারতেন না। বাড়াবাড়ি কিছু হয়ে গেলে আমাদের হয়তো গুলিই করতে হতে হোতো। কিন্তু আমার অপছন্দের সে রকম একটা কাজ আমাকে করতে হোলো না। আর আপনাকে রাতের অন্ধকারেই আমরা ধরে নিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু আমরা মনে করেছি আপনার জন্য তা ভালো হোতো না। বা একজন মেয়েকে আমরা রাতের অন্ধকারে পুলিশের গাড়িতে তুলতে চাইনি। তাই আমরা সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি।
অতঃপর আমাকে নিয়ে,আমাকে বসানো গাড়ির সামনে পিছনে পুলিশের আরও দুটো গাড়ি দিয়ে, হুইসেল বাজিয়ে তারা বেরিয়ে গেলো-আমার জানা মতে ঝিনেদা থানার উদ্দেশ্যে। আমি একটু কষ্ট ক’রে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম,আমার বোন আমার মেয়েকে কোলে নিয়ে আমাকে নিয়ে যাওয়া দেখছে। আমাকে নিয়ে পুলিশ বাহিনী যখন থানার মধ্যে প্রবেশ করলো,আমি লক্ষ্য করলাম পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সেখানে সাদা পোশাক পরা ধোপ দুরস্ত কিছু মানুষও আছে। আমার ধারণা তারাও পুলিশ। আমাকে থানা বিল্ডিঙয়ের সামনের দিকে একটা ঘরে বসতে দেওয়া হোলো। এবং বেশ বোঝা যাচ্ছিলো থানা বিল্ডিঙের গা ঘেসে এক ধরনের পুলিশের বেষ্টনী দিয়ে রাখা হয়েছে। ঝিনেদার আমার শুভাকাঙ্ক্ষী শুভানুধ্যায়ীরা এর মধ্যে থানায় আসা শুরু করেছে। কারণ ছোট্ট শহরে ঐ ধরনের পুলিশের বহর কোনো সাধারণ আসামী যে থানায় আনেনি,তা না বুঝতে পারার কোনো কারণ ছিলো না। তাছাড়া আমাকে আনতেই অনেকে দেখেছে। কেউ কেউ অন্যদের মুখে মুখে বলেছে। এই ভাবে ততক্ষনে গোটা শহরে তা প্রচার হয়ে গেছে। এই প্রচারের সঙ্গে জাসদ এবং তৎকালীন গণবাহিনীর পরিচয় তো আছেই। আমাকে দেখতে আসা মানুষকে থানার রুমের মধ্যে বসতে দেওয়া একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ছিলো। বা সেখানে ঢুকতে দেওয়া সম্ভবও ছিলো না। আমার নিরাপত্তার ব্যাপার তো ছিলোই। তবে লক্ষ্য করলাম পুলিশ কতৃপক্ষ কারোর সঙ্গে কোনো ধরণের দুর্ব্যবহারের পথে হাঁটছে না। সে কারণে পুলিশকে দেখাতে হচ্ছিলো অতিরিক্ত ধৈর্য। যা সম্ভবত পুলিশের খাতায় লেখা নাই। এর মধ্যে বেলাও বেশ বেড়ে গেছে। ভিড় বাড়তে থাকায় আমাকে বিরতি দিয়ে অন্তত দুইবার বারান্দায় নিতে হয়েছে তাদের। বারান্দা দিয়ে ওসি সাহেবের রুমে যাওয়ার রাস্তা। একবার আমাকে ওসি সাহেবের রুমে নিয়ে বসানো হোলো। ২য় বার ওসি সাহেবের রুম থেকে আমাকে বসানো রুমে আবার আানা হোলো। আমি দুইবার বারান্দা পার হওয়ার সময় বাইরের মানুষ আমাকে দেখলো। এমনও হতে পারে পুলিশ কতৃপক্ষ আমাকে দেখিয়ে বোঝাতে চাইছিলেন,আমি কেমন আছি। বা ভালো আছি।
আমার বাসা থেকে ইতিমধ্যে আমার আর এক বোন এবং আরও দুই একজন থানায় এসেছে। আমার কী লাগবে না লাগবে বা সুবিধা অসুবিধা তারা জানতে এসেছে। তারা সঙ্গে ক’রে এনেছে সকালে আমার জন্য মায়ের রান্না করা খাবার। পুলিশ কতৃপক্ষের দিক থেকে জানিয়ে দেওয়া হোলো বাড়ি থেকে কোনো খাবার এখানে দেওয়া যাবে না। বাড়ির খাবার এখানে আনবেন না। এর মধ্যে থানা থেকেই আমার সকালের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। এস ডি পি ও আমানুল্লাহ্ সাহেব একটা ব্যাপারে খুবই তৎপর ছিলেন। আমাকে দেখতে আসা কারোর সঙ্গেই যেন কোনো খারাপ ব্যবহার না করা হয়। যা মানতে পুলিশকে গলদঘর্ম হতে হচ্ছিলো। আমানুল্লাহ্ সাহেব অত্যন্ত ক্লান্ত অবস্থায় ঠাণ্ডা মাথায় এসব কাজ ক’রে যাচ্ছিলেন। সম্ভবত তিনি আমার ব্যাপারটা অন্য কারোর উপরে ছাড়তে চাননি। বা এমনও হতে পারে তিনি এ ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। তিনি আমাকে দেখতে আসা মানুষ এবং থানার পুলিশদের বার বার সতর্ক করছিলেন, আমাকে যেন যথা সম্ভব ফাঁকাতে থাকবার সুযোগ দেওয়া হয়। এই ফাঁকাতে রাখতে চাওয়ার মধ্যে সম্ভবত একটা নিরাপত্তার ব্যাপার ছিলো। দিন যত বাড়তে লাগলো মানুষের ভিড়ও ততো বাড়তে লাগলো। ঝিনেদা থানাটা শহরের মাঝখানে। এবং সামনের বড় রাস্তা থেকে থানা বাউন্ডারির মধ্যের প্রায় সব কিছুই দেখা যায়। থানার ভিতরে ছিলো তখন একটা বেশ বড় পুকুর। সেই পুকুর একেবারেই রাস্তার ধারে। পুকুরের রাস্তার ধারের দিকটা তারকাটা দিয়ে ঘেরা ছিলো। কিছু মানুষ সেই তারকাটা ধরে দাড়িয়ে কিছু একটা দেখবার চেষ্টা করছিলো। আমাকে বসানো ঘর থেকে রাস্তার এ দৃশ্য দেখা যাচ্ছিলো। সেখানে এমন অনেকে হয়তো এসেছেন,যারা আমাকে কখনো দেখেননি। আমি এস এস সি পাশ করেছি যশোরের জঙ্গল বাঁধাল হাইস্কুল থেকে। ঝিনেদা ফিরে আসবার এক বছরের মধ্যেই আমি রাজনৈতিক কারণে আত্মগোপনে চলে যাই। দীর্ঘ গোপন রাজনৈতিক জীবনের কারণে প্রকাশ্যে কোনো কাজ আমি করতে পারিনি। স্বাভাবিক কারণেই ঝিনেদার মানুষের মধ্যে আমাকে নিয়ে ছিলো বাড়তি কৌতূহল। সে জন্যেই হয়তো সেদিন মানুষের এতো ভিড় ছিলো। মানুষের এই ভিড় এবং পুলিশের সাঁজ সাঁজ রবে ভিতরে ভিতরে আমি সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছিলাম। কিন্তু এই ভয় পাওয়ার প্রকৃত কারণ আমার জানা ছিলো না।
দুপুরের দিকে চারপাশটা একটু নিরিবিলি হয়ে গেলো। এই সময় দুপুরের খাবার আনা হোলো। কেন জানিনা মহকুমা অফিসার আমার সঙ্গেই খেতে বসলেন। সেই সুযোগে তিনি বললেন,আমি খুবই দুঃখিত,সকালে আপনার বাসা থেকে আনা খাবার আপনাকে খেতে দিতে পারিনি। ওটা আমাদের এই মুহূর্তের নিয়মের মধ্যে ছিলো না। আমারও তখন কথা বলতে ভালো লাগছিল। বললাম,এই মুহূর্তের নিয়ম আবার কী। তিনি বললেন, অন্যদের কখনো কখনো বাড়ির খাবার আমরা খেতে দিই। কিন্তু আপনার জন্য তা বিশেষভাবে আমরা বন্ধ রেখেছি। এর বাইরে আর প্রশ্ন করলে আমি জবাব দিতে পারবো না। এভাবে টুকিটাকি কথা বলতে বলতে দুপুরের খাওয়া শেষ করলাম। মহকুমা অফিসার বলতে গেলে কিছুই খেলেন না। আমার মনে হোলো আমার সঙ্গে বসাটাই তার উদ্দেশ্য ছিলো। এবং সেই সুযোগে দুঃখপ্রকাশ ক’রে নেওয়া। এখানে বলে রাখি আমাকে বিদায় দেওয়া পর্যন্ত তিনি থানায়ই ছিলেন। তার বসবার অফিস ছিলো বাইরে অন্য জায়গায়। এর মধ্যে আমি লক্ষ্য করলাম,আমানুল্লাহ্ সাহেব থানার অন্য সব কর্মকর্তাদের নিয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার রুমে বসে কিছু কথা বলে নিলেন। এতে আমি একটু ভয়ই পেলাম। আমার মনে হোলো আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর্বটা তারা হয়তো এখনই শুরু করবে। ভয় পাওয়ার কারণ,আমি বা আমরা আগে দেখেছি হক্ সাহেবের পার্টির লোকজনের উপর জিজ্ঞাসাবাদের নামে খুবই নির্যাতন করা হোতো। তাতে ক,রে আমাদের চেনা জানা কেউ কেউ মারাও গেছেন। ঝিনেদা জাসদ এবং গণবাহিনীর নেতা তোজাম্মেল হককে কিছু দিন আগে রক্ষীবাহিনী ধরে নিয়ে এসে,তার উপর নির্মম নির্যাতন করেছে। অবশ্য তখন পুলিশের হাতে পুরো বিষয় দেখ্ভাল করবার ক্ষমতা ছিলো না। রক্ষীবাহিনীর হাতেই ছিলো সব ক্ষমতা। রক্ষীবাহিনী দ্বারা আমার পরিবারও নানাভাবে নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে। সেটাও আমার ভয়ের একটা কারণ। রক্ষীবাহিনীর কার্যকলাপের ধারণা থেকেই আমার তখনকার চিন্তা কাজ করছিলো। অবশ্য আমি যখন গ্রেফতার হই,রক্ষীবাহিনী জামানা তখন কেবল শেষ হয়েছে। আমি শেষ পর্যন্ত বুঝতে পেরেছিলাম কিছুদিন আগের পথে পুলিশ বাহিনী হাঁটছে না। পুলিশ কতৃপক্ষের দিক থেকে আমার জন্য কোনো বৈরি পরিবেশ তৈরি করা হোলো না। এক ফাঁকে মহকুমা অফিসারকে আমি অনুরোধ করেছিলাম,আমার বাসার সব কেমন আছে জানাতে পারবেন? তিনি তখন কিছুক্ষন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,আপনাকে এটা জানাবার সুযোগ আমার নেই। তবে আমি খেয়াল রাখবো আপনার বাড়ির কেউ এলে যেন তারা আপনার কাছাকাছি আসতে পারেন। তখন জেনে নেবেন। আমার মনে হোলো তার মেজাজ একটু রুক্ষ হয়ে উঠেছে। এই ধাক্কাটা খেয়ে আবার একটু ধাতস্ত হতে চেষ্টা করলাম। হঠাৎ যেন আমি কিছু ভাবতে পারছিলাম না। তখন আবার চা খাওয়ার সময় হোলো। আমি চা খেতেও চাইলাম। তখন থানার ছোট বড় সব কর্মকর্তাই সেই রুমে উপস্থিত ছিলেন। হয়তো তখন অন্য অফিসারেরা কেউ কেউ একটু মজা করতেই বললেন,এই গণবাহিনীর লোক-আপনাদের ধরতে আমাদের কত যে মশার কামড় খেতে হয়,তা ভাবতেও পারবেন না। কিন্তু আমি তাদের সঙ্গে তাল মিলাতে পারলাম না। তাদের সঙ্গে বসে চা খাওয়ার সময়ই শৈলকূপা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জনাব মতিউর রহ্মান সাহেব এলেন। তিনি ছিলেন যুবক মানুষ,সেই কারণেই হয়তো গাম্ভীর্যের অত ধার ধারছিলেন না তিনি। তার পকেট থেকে আমার একটা ছবি বের ক’রে আমাকেই বললেন,দেখেন তো চিনতে পারেন কিনা? মহকুমা অফিসার ছবিটা হাতে নিলেন। তারপর তা উল্টো ক’রে রেখে বললেন,এখন সকলে ওঠা যাক। আমাদের মেহমানকে বিদায়ের কাজটা সারতে হবে। সেই শুনশান সকালে আমাকে পুলিশ কনভয়ে তোলা হয়েছে। সেই থেকে আমার মনে হয়েছে আমার গায়ে তারা থানার আঁচ লাগতে দিতে চাননি। আমি এবার এর কারণ একটু খুঁজতে লাগলাম। তখন গ্রাম গঞ্জে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পুলিশ ক্যাম্প বসানো হোতো। আমরা এবং ক্যাম্পের সেই পুলিশ যার যার চারিদিকে ঘুরতাম। আমি এটা বলছি রক্ষীবাহিনী পরবর্তী সময়ের কথা। মাঝে মাঝে আমার মনে হোতো আমরা এবং পুলিশ কেউ কাওকে ঘাটাতে চাইনা। এবং তা জেনে বুঝেই। আমাদের নিজেদের একটা সিদ্ধান্ত ছিলো কোনো পুলিশ ফাঁড়িতে আক্রমণ করা যাবে না। বা সাধ্যমত সংঘর্ষ এড়িয়ে চলতে হবে। কোনো ধরণের হঠকারিতা করতে আমরা চাইনি। কিন্তু মাঝে মাঝে সংবাদ পেতাম আমাদের নামে রটানো হচ্ছে উল্টোটা। সেখান থেকে পুলিশের মনে একটা গণবাহিনী ভিতি ছিলো। আমার মনে হোলো আমাকে কেন্দ্র ক,রে পুলিশ তখন আত্মরক্ষার পথেই হাঁটছে। অবশ্য সে আমার শুধু নিজেরই কল্পনা। এতসব ভাবছি,এরমধ্যে আবার কিছু মানুষ থানায় আসতে শুরু করেছে। কিন্তু তখন তাদের অনুরোধ করা হচ্ছে,আর নয়। তবুও দুই চারজন তো আসছেই। এর মধ্যেই দেখলাম সকালে আসা আমার বোন এলেন। একজন পুলিশ তাকে এগিয়ে দিয়ে গেলো আমার কাছে। আমি তার কাছে মা এবং মেয়ের খবর নিলাম। বড়বোন বললেন,মা ভালো আছে। তোমার মেয়েকে নিয়ে মা ব্যস্ত। কোনো চিন্তা কোরোনা। আমরা কিছুক্ষন কথা বলার পর মহকুমা অফিসার আমার বোনকে বললেন,এবার আপনাকে চলে যেতে হবে। এখন আমাদের কিছু কাজ করতে হবে। আমার বোন চলে যাওয়ার পর,বাইরের কারোর সঙ্গে আমাকে আর দেখা করতে দেওয়া হয়নি। তখন দিনও প্রায় শেষ। এবার আমি খুঁজতে থাকলাম,আমাকে কে ধরিয়ে দিয়েছে। আমি একজনকে জিজ্ঞাসাই করলাম। ততক্ষনে থানার কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমি নিজে থেকে একটু কথা বলছি। আমাকে ধরিয়ে দেওয়ার মানুষটা সম্পর্কে আমি তখন জেনেছিলাম। সে আমার একজন নিকটাত্মীয়। যদিও সোর্স সম্পর্কে কোনো তথ্য দেওয়া নিয়ম নয়। কিন্তু তারপরেও আমি তা জানলাম। আমার সেই নিকটাত্মীয় আমার বাড়িতে আসবার সংবাদ রাতেই থানায় জানিয়ে দিয়েছে। আমি এতক্ষণও ভাবছিলাম,রাতেই হয়তো আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। নইলে জেলে কেন পাঠাচ্ছে না। থানার পাশেই ঝিনেদা জেলখানা। তখন আমি মহকুমা পুলিশ অফিসারের অতি ভালো ব্যবহার সন্দেহের চোখে দেখা শুরু করলাম। এবং তখন ভাবছি মানুষ এমনও হয়! এটা ভাবতে ভাবতে দেখলাম থানার সামনে দুটো বড় পুলিশের গাড়ি এবং একটা জীপ গাড়ি এলো। আমি তখন লক্ষ্য করলাম,পুলিশের মধ্যে একধরণের তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। সম্ভবত পাশের পুলিশ ব্যারাক থেকে বাড়তি পুলিশ ফোর্স এলো। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এমন সময় সেই ভালো মানুষ এস ডি পি ও আমানুল্লাহ্ সাহেব আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তিনি বললেন আপনাকে উঠতে হবে। আমি তখন জিজ্ঞাসা করলাম না আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একবার শুধু মুখ তুলে তাকালাম। আমি আজ জানিনা আমার সেই চোখে কোনো জিজ্ঞাসা ছিলো কিনা। কিন্তু তিনি নিজে থেকেই বললেন,যান,আপনার কোনো অসুবিধা হবেনা। আমাদের সদর থানার ওসি সাহেব এখন আপনার সঙ্গে যাবেন। আশাকরি ভালোভাবে যাবেন। আমি বুঝতে পারলাম না,” ভালোভাবে যাবেন” দিয়ে তিনি আসলে কী বলতে চাইলেন,রাস্তায় পালানোর চেষ্টা করবেন না,এটা,নাকি যাত্রা শুভ কামনা ক’রে তিনি আমাকে বিদায় দিলেন। অতঃপর আমাকে সকালের মতোই গাড়িতে ওঠানো হোলো। জীপ গাড়ির সামনে ভিতরের দিকে আমি,বাইরে জানালার দিকে ঝিনেদা থানার ওসি সাহেব। গাড়িতে সশস্ত্র অবস্থায় আরও কিছু পুলিশ সদস্য। আমাকে নিয়ে রওনা দেওয়ার জন্য ঝিনেদা পুলিশ বাহিনী প্রস্তুত।
আমি দেখলাম,আমাকে সকালে গ্রেফতার করবার নেতৃত্ব দেওয়া জনাব আমানুল্লাহ্ সাহেব থানার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। তার মধ্যে তখন পুলিশি কোনো তৎপরতা নেই। তার চেহারার মধ্যেও আমি তখন কোনো পুলিশ খুঁজে পেলাম না। তিনি বাস্তবেই আমাকে বিদায় দেওয়ার অপেক্ষা করছেন বলে মনে হোলো। অতঃপর পুলিশের গাড়ি হুইসেল বাজিয়ে আমাকে নিয়ে ঝিনেদা থানা থেকে বেরিয়ে পড়লো। আমি পথে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম। আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন জবাব পেলাম,গেলেই বুঝতে পারবেন। শুরু হয়ে গেলো পুলিশি আচরন। আমি তখন আনমনা হয়ে আমি চিন্তা করছিলাম,আমার মা জানেনা আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একটু খেয়াল করলেই আমি দেখতে পারতাম,আমি যশোরের পথে আছি। কিন্তু এমন অনেক সময় জীবনে আসে,তখন অনেক কিছু দেখেও প্রকৃতটা ভাবা যায় না। আমার অবস্থা এখন সে রকম। এভাবে ভাবতে ভাবতে দেখলাম আমাকে আনা হয়েছে যশোর এস পি অফিসে। এই অফিস আমার চেনা। এই এস পি অফিসের সামনে দিয়ে আমি এবং সালেহা আপা একদিন দুপুরে সশস্ত্র অবস্থায় হাসতে হাসতে কাজে গিয়েছিলাম। আমাকে যখন যশোর এস পি অফিসে আনা হোলো,তখন রাত আটটা হবে। সেখানে বাইরের মানুষের ভিড় না থাকলেও,পুলিশ বিভাগের নিজদের ভিড়ের অন্ত ছিলো না। ওখানে পৌঁছে দেখলাম,ঝিনেদা মহকুমার অন্য তিন থানার ওসিও সেখানে। আরও এসেছেন ডি আই ওয়ান-শাহাবুদ্দিন সাহেব। সেখানেও আমাকে একটা আলাদা রুমে বসানো হোলো। তবে একটা বিষয়ে আমি ভীষণ বিরক্ত হচ্ছিলাম, কিছুক্ষণ পরে পরে দূই তিন জন ক’রে এসে আমাকে দেখে যাচ্ছিলো। আমি একবার বলেও ফেললাম,আপনারা কেন আসছেন? তারাও সরল মনে বললো আপা আপনাকে দেখতে আসছি। তখন তো আর কিছু বলার থাকে না। দুই একবার আমাকে চা খাওয়ানো হয়েছে। সেই চা খাওয়ানোর সুবাদেই শৈলকূপা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে আবার দেখা হয়ে গেলো। কারণ চা তিনিই নিয়ে আসছিলেন। আমি খেয়াল করেছি,তুলনামূলক যুবক বয়সী অফিসারেরা আমার কাছাকাছি বেশি আসছিলো। এবং তুলনামূলক তারা ছিলো প্রানবন্ত। আমাকে একটু সময় দিয়ে অথবা নির্ধারিত মানুষ এতক্ষণে এলো বলেই হয়তো,এবার আমার মুখোমুখি হোলো যশোর এস পি অফিসের পুলিশ কতৃপক্ষ। সঙ্গে স্বয়ং এস পি সাহেব। আমার সামনে বসে তারা বললেন,আমরা এখন কিছু অনানুষ্ঠানিক কথা আপনার সঙ্গে বলবো। তারা বললেন অনানুষ্ঠানিক,কিন্তু তাদের কথা বলার ভঙ্গি দেখে আমার মনে হোলো না তা অনানুষ্ঠানিক। আমি ছিলাম খুবই ক্লান্ত। তা তাদের বললাম। তারপরও তারা রীতিমতো নাছড় বান্দা। বললো,কেন চা খেতে খেতে তো আমরা দুই একটা কথা সেরে নিতে পারি। আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম,আমি তো এখন বন্দী। আপনাদের হাতেই আছি। আমার একটু ঘুমানোর দরকার। অন্তত সেই সুযোগটা আমাকে দেন। আমাকে তারা কোনো ধরণের অবসর দিতে চান না। আবার বললাম আপনারা জোর করলে তো হবে না। আমার কিছু বলার মতো শারীরিক অবস্থা তো থাকতে হবে। এভাবে কথার পৃষ্ঠে কথা বলতে বলতে সময় পার হয়ে গেলো। তখন আমাকে এস পি সাহেবের রুমে এনে বসানো হোলো। সম্ভবত রাতের খাবার খাওয়ানোর জন্য। খাবার এলে যা পারলাম একটু খেয়ে-চা খেতে চাইলাম। আমার চা খাওয়ার সময় আবার ঢুকলো গোয়েন্দা বিভাগের দুইজন লোক। একজন তার নাম বলে পরিচয় দিলেন। তারা অল্প কিছু হলেও জানতে চান। কিন্তু আমার পক্ষে সম্ভবই হোলো না কোনো কথা বলা। সে আমার কোনো জিদ নয়। অপারগতা। এদিকে রাতও বেশ হয়ে গেলো। আমার কানে এলো যশোর কোতোয়ালি থানা হাজতে তারা আমাকে রাখতে চায়। সেক্ষেত্রে আমি জোর আপত্তি জানিয়ে বললাম ওখানে থাকা আমার পক্ষে একেবারেই সম্ভব না। আমাকে বরং কারাগারেই রেখে আসেন। যে কারণেই হোক আমার আপত্তি পুলিশ কতৃপক্ষ আমলে নিলেন। এবং সেই রাতে সঙ্গে সঙ্গেই এস পি সাহেব আমার সামনে বসেই যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলর সাহেবের সঙ্গে ফোনে কথা বলে সব বন্দবস্ত ক’রে ফেললেন। যদিও সাধারণত রাতে কারাগারে বন্দী রাখা নিয়ম নয়। পুলিশের পক্ষ থেকে জেলর সাহেবকে জানানো হোলো মিসেস জলি থানায় থাকবার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছেন। তিনি যখন ফোন রাখলেন,তখন বোঝা যাচ্ছিলো আমাকে জেলেই নেওয়া হচ্ছে। আয়োজনের সব ঘটনা ঘটছে আমার সামনেই। তাই আমি নিজেও কিছু আন্দাজ করতে পারছি। এতো সব সারতে সারতে রাত ১১টা বেজে গেছে,পুলিশ কতৃপক্ষের তৎপরতা দেখে মনে হোলো আমাকে তারা কারাগারেই রাখতে যাচ্চেন। আবার সেই গাড়ি,সেই বাড়তি পুলিশ ফোর্সের সমাগম।
– তাহেরা বেগম জলি, সাবেক শিক্ষিকা, রাজনৈতিক কর্মী