সোজা কথা প্রতিবেদক
টিআইবির গবেষণার আওতাভুক্ত ৭টি প্রকল্পে যে অর্থ বরাদ্দ ছিলো, তার প্রায় ৫৪ শতাংশ অর্থই অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।২০১৬ সালের ৪ নভেম্বরে কার্যকর প্যারিস জলবায়ু পরিবর্তন চুক্তির ৪ বছর পূর্ণ হলেও জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন কার্যক্রমের স্থান ও সময়ভিত্তিক কোনো অগ্রাধিকার নির্ধারিত না থাকার সুযোগে রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে অনিয়ম-দুর্নীতির উদ্দেশ্যে অর্থায়ন, প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের প্রবণতা বিদ্যমান। পরিবেশ সুরক্ষায় সাংবিধানিক অঙ্গীকার ও প্রশমনের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে নবায়নযোগ্য উৎস হতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ না করে উল্টো কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অনুমিত অবদান (এনডিসি)- তে প্রতিশ্রুত ১৫ শতাংশ প্রশমন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকারের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক উৎস হতে তহবিল সংগ্রহে কোনো পথনকশা না থাকা এবং কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে আন্তর্জাতিক তহবিলসমূহ হতে সরাসরি তহবিল সংগ্রহে জাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যকর অভিগম্যতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। ‘বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন অর্থায়ন ও প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষ্যে বৃহস্পতিবার আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে উল্লিখিত পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এছাড়া, প্রশমন প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা, জনঅংশগ্রহণ ব্যবস্থা, স্থানীয়ভাবে প্রকল্পের চাহিদা এবং গুরুত্ব বিবেচনা না করে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রকল্পে অর্থায়ন, অনুমোদন এবং বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন নীতি নিয়মিত লঙ্ঘন করলেও অভিযুক্ত সংস্থাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়নি। একইসাথে, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রশমন প্রকল্প প্রণয়ন, অর্থায়ন, কার্যক্রম বাস্তবায়ন, তদারকি, নিরীক্ষা ও মূল্যায়নে সংশ্লিষ্ট আইএমইডি এবং মহা হিসাব নিরীক্ষকের অধিদপ্তরের সাথে বিসিসিটিএফর মধ্যে আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ ও কোনো কার্যকর সমন্বয় ব্যবস্থা অনুপস্থিত। এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন কার্যক্রমকে অধিকতর ফলপ্রসূ করতে ১০ দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন মো: রাজু আহমদ মাসুম, অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার-গবেষণা, জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসন, টিআইবি এবং গবেষণা দলের অন্য সদস্য ছিলেন একই বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার এম. জাকির হোসেন খান। সংবাদ সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন অর্থায়নে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ পর্যালোচনা করার উদ্দেশ্যে জুন ২০১৮ সাল থেকে অক্টোবর ২০২০ সময়কালের মধ্যে গবেষণা কর্মটি পরিচালিত হয়েছে। যেখানে শুধুমাত্র বাংলাদেশে জলবায়ু প্রশমন অর্থায়ন এবং কার্যক্রম সংক্রান্ত পর্যবেক্ষন তুলে ধরা হয়েছে। গুণগত ও পরিমাণগত উভয় পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় উৎস হতে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এই গবেষণায় প্রশমন অর্থায়ন ব্যবহারে সুশাসন পর্যালোচনার জন্য বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিল (বিসিসিটিএফ) এর অর্থায়িত ৭টি প্রকল্প নির্বাচন করা হয়েছে। যার আর্থিক মূল্য বিসিসিটিএফ এর প্রশমন খাতে বরাদ্দকৃত তহবিলের ১১ শতাংশ।
গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে দেশি-বিদেশি উৎস হতে প্রাক্কলিত প্রায় ২ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকা যোগানের পরিকল্পনার বিপরীতে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই অর্থের মাত্র ৬ শতাংশ (১২ হাজার ৬ শত ৯৯ দশমিক ৭০ কোটি টাকা) তহবিল আন্তর্জাতিক উৎস হতে প্রদান করা হয়েছে। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক উৎস থেকে ২০২০ সাল নাগাদ যথাক্রমে ৬ শত ৮ দশমিক ৬২ কোটি টাকা এবং ১২ হাজার ৯১ দশমিক শূন্য ৮ কোটি টাকা অর্থায়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশে প্রশমন অর্থায়নের সিংহভাগ আন্তর্জাতিক উৎস হতে সংগ্রহ করা হলেও এই আন্তর্জাতিক উৎস হতে প্রাপ্ত অর্থায়নের মাত্র ৬৭ শতাংশ অর্থ শুধুমাত্র প্রশমন সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে ব্যয় করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিলসমূহে সরাসরি অভিগম্যতা না থাকায় প্রশমন প্রকল্পে অর্থায়ন ও তা বাস্তবায়নে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার ওপরে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্ভরশীলতার কারণে তহবিল ব্যবস্থাপনায় ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু তাই নয়, শিল্পোন্নত দেশসমূহ হতে অনুদানভিত্তিক অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হলেও আন্তর্জাতিক উৎস হতে ২০১৯ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে প্রদত্ত প্রশমন অর্থায়নের মাত্র ১৫ শতাংশ অনুদান হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রশমন কার্যক্রম বাস্তবায়নরত জাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে কোনো কার্যকর সমন্বয় ও আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ না থাকায় এনডিসির প্রশমন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ সম্ভাব্য উৎস হতে প্রয়োজনীয় তহবিল পেতে যথাযথ কৌশল গ্রহণ এবং তহবিল সংগ্রহে এখনো আশানুরূপ সাফল্য অর্জনে করতে পারেনি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, জাতীয় পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনে কার্যকর অবদান রাখতে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা (বিসিসিএসএপি), ২০০৯- এ জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা ও গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে একটি কৌশলগত জ্বালানি পরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। বাস্তবে বিগত ১১ বছরেও জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ ও গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে সময়াবদ্ধ সুর্নিদিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক রোডম্যাপ তৈরি হয়নি। ফলশ্রুতিতে, নবায়নযোগ্য খাত থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়ে অগ্রাধিকারভিত্তিক অর্থায়নের বিষয়ে কোনো কৌশলগত দিকনির্দেশনা না থাকায় সহজেই পরিবেশ বিধ্বংসী কয়লা ও এলএনজিতে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
কৌশলপত্রের আলোকে বন অধিদপ্তর সবুজ বেষ্টনী সৃষ্টির মাধ্যমে উপকূল সুরক্ষায় একাধিক প্রকল্প গ্রহণ করলেও বাস্তবে দুর্যোগ মোকাবেলায় দুর্যোগ মোকাবেলায় তার কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশের উপকূল সুরক্ষায় সবচেয়ে কার্যকর ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের ১০ কি.মি. এর মধ্যে এবং সংরক্ষিত আরো কিছু উপকূলীয় বনের কাছে কয়লা বিদুৎকেন্দ্রসহ অপরিকল্পিত শিল্পায়ন করা হচ্ছে, যা এই কৌশলপত্রের প্রশমন ধারণার সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক।
প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল আমদানিতে ১০ শতাংশ শুল্ক ও কর আরোপের মাধ্যমে এই খাতে উৎপাদন ও বিপননের সাথে যুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহকে এক ধরনের নেতিবাচক প্রণোদনা প্রদান করা হয়েছে। অন্যদিকে কয়লা ও অন্যান্য জীবাশ্ম জ¦ালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসমূহে জাতীয় অর্থায়ন ও বিভিন্ন ছাড় প্রদান করা হয়েছে (যেমন, কয়লা আমদানিতে ১০ শতাংশ মূসক ছাড়, বিদেশি কর্মী ও কোম্পানির আয়ের ওপর কর হার সম্পূর্ণ মওকুফ ইত্যাদি), যা বিসিসিএসএপিতে কৌশলগত জ¦ালানি পরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যমাত্রার সম্পূর্ণ বিপরীত।
এনডিসিতে বাংলাদেশের প্রশমন বিষয়ক প্রতিশ্রুতির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে বায়ু বিদ্যুৎ ৪ শত এবং সৌর বিদ্যুতের উৎপাদন ১ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করা। অথচ দেশি-বিদেশি লবির স্বার্থে নবায়নযোগ্য জ্বালানির পরিবর্তে বাংলাদেশ এই লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে মার্চ ২০১৯ পর্যন্ত মাত্র ২ দশমিক ৯ মেগাওয়াট (০.০০৭ শতাংশ) বায়ু বিদ্যুৎ এবং ৩ শত ৩৮ দশমিক ৬৫ মেগাওয়াট (৩৩.৯ শতাংশ) সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অর্জন করেছে, যা প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম। নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে সীমাবদ্ধতা দেখানো হয়েছে তাও বাস্তবসম্মত নয়। বিভিন্ন গবেষণায় ২০৪১ সাল নাগাদ ৪০ হাজার মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য শক্তিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া, স্বার্থন্বেষী গোষ্ঠীর চাপে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে বিদু্যুৎ উৎপাদনে অগ্রাধিকার না দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিকল্পনার সিংহভাগই দূষিত কয়লা এবং আরো অধিক দূষণকারী এলএনজিসহ জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে বার্ষিক ১ শত ১৫ মিলিয়ন টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন হবে, যা এনডিসিতে উল্লেখিত প্রশমন লক্ষ্যমাত্রার সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। একইসাথে, পরিবহন খাতে ২০১৫ সালের তুলনায় ১৫ শতাংশ গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমানো লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও কিভাবে এই হার কমানো হবে সেই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা করা হয়নি।
গবেষণায় দেখা যায় যে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা, ২০০৮ এর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো ২০৫০ সালের মধ্যে দেশে কার্বন নির্গমন ৮০ শতাংশ কমিয়ে আনা। যদিও বাস্তবে ২০০০-২০১৫ সাল নাগাদ বিদ্যুৎ উৎপাদনে জীবাশ্ম জ¦ালানির ব্যবহার ৯৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯৯ শতাংশ উন্নীত হয়েছে এবং ২০০০-২০১৬ সাল নাগাদ মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণ দ্বিগুণ বৃদ্ধি (০.২ মে.ট. থেকে ০.৪৬ মে.ট. বৃদ্ধি) পেয়েছে, যা এই নীতির লক্ষ্য অর্জনের ধারণার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এছাড়াও এই নীতিমালার আলোকে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের জন্য যন্ত্রাংশ এবং সরঞ্জাম তৈরিতে ব্যবহৃত সকল কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশসমূহে ১৫ শতাংশ হারে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) অব্যাহতির কথা থাকলেও ২০২০-২১ অর্থ বছরে শর্তসাপেক্ষে ৬০ এএমপি পর্যন্ত ব্যাটারি কেনার ক্ষেত্রে মূসক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, তবে এর বাতি এবং যন্ত্রাংশের আমদানির ওপর ৩১ শতাংশ কর এখনো অব্যাহত রয়েছে।
গবেষণাধীন ৭টি প্রকল্পের মধ্যে ৪টির ক্ষেত্রে বনায়ন, ৩টি নবায়নযোগ্য জ্বালানি সংক্রান্ত কার্যক্রম করা হয়েছে। বনায়নের প্রকল্পগুলোর মধ্যে ২টি প্রকল্পে আংশিক বনায়ন করে প্রকল্প কার্যক্রম সমাপ্ত করা হয়েছে এবং অপর ২ টি প্রকল্পে প্রস্তাবিত গাছের প্রজাতি বৈচিত্র্য রক্ষা করা হয়নি। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ৩ টি প্রকল্পের ২ টি সড়কবাতি সংক্রান্ত প্রকল্প যেখানে ১ টি প্রকল্পে প্রস্তাবনার উল্লেখিত রাস্তায় সড়কবাতি স্থাপন না করে অন্য স্থানে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার ইচ্ছামতো সড়কবাতি স্থাপন করা হয়েছে। অপর যে প্রকল্পের আওতায় সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে সেখানেও প্রস্তাবনায় উল্লেখিত ৬ শত ৫০ কিলোওয়াট লক্ষ্যমাত্রা বিপরীতে ভোক্তা পর্যায়ে মাত্র ৫০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে, বাঁকি বিদ্যুতের অপচয় করা হচ্ছে। ৭টি প্রকল্পের মধ্যে ৫টিতে তথ্যবোর্ড থাকলেও তথ্য বোর্ডে প্রয়োজনীয় তথ্যাবলীর ঘাটতি রয়েছে এবং কিছু ক্ষেত্রে জনদৃষ্টির আড়ালে নামসর্বস্ব তথ্যবোর্ডগুলো বসানো হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী সমন্বিত তথ্য বোর্ড না থাকলেও স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যাক্তিদের স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক সুবিধার জন্য প্রকল্প এলাকার বিভিন্ন স্থানে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে।
৭টি প্রকল্পের সবগুলোই বাস্তবায়নকারি স্থানীয় কার্যালয়ের কর্মকর্তা কর্তৃক পরিবীক্ষণ করার দাবি করলেও বাস্তবে এই তদারকির কোনো লিখিত প্রতিবেদন প্রস্তুত ও তা সংরক্ষণের চর্চা নেই। কেবলমাত্র ২টি প্রকল্পে মন্ত্রণালয়ের পরিবীক্ষণ দল তদারকিতে গিয়েছেন বলে জানিয়েছেন বাস্তবায়নকারি কর্তৃপক্ষ এবং গবেষণায় অংশগ্রহণকারী তথ্যদাতারা। স্থানীয় জনপ্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিদের প্রকল্পগুলোতে তদারকিতে সম্পৃক্ত থাকার যে প্রবিধান রয়েছে তা ৭টি প্রকল্পের মধ্যে ৬টি প্রকল্পেই অনুসরণ করা হয়নি। কোনো প্রকল্পই আইএমইডি কর্তৃক মূল্যায়ন এবং মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এর কার্যালয় কর্তৃক নিরীক্ষা করা হয়নি। কোনো প্রকল্পেই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ নিরসন ব্যবস্থা নেই। বাস্তবায়নকারি কর্তৃপক্ষ জানান কেউ অভিযোগ করলে তারা ব্যবস্থা নেন, তবে কোনো অভিযোগ তারা এ পর্যন্ত পাননি। প্রকল্প প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও তদারকিতে জনঅংশগ্রহণ বিশেষত নারী ও অতি দরিদ্রের মতামতের বাধ্যবাধকতা থাকলেও শুধুমাত্র ১টি প্রকল্পে স্থানীয় সুবিধাভোগীদের মতামত গ্রহণ করা হয়েছে। গবেষণার আওতাভুক্ত ৭টি প্রকল্পের সবগুলো প্রকল্পেই বিবিধ অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে ৭টি প্রকল্পের সবগুলোই রাজনৈতিক সুপারিশের ভিত্তিতে অনুমোদন করা হয়েছে। সার্বিকভাবে ৭টি প্রকল্পে অর্থায়নকৃত ৬৮ দশমিক ১৬ কোটি টাকার প্রায় ৫৪ দশমিক ৪ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৩৭ দশমিক ০৭ কোটি টাকা বিভিন্নভাবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের যোগসাজশ করে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎ এবং অপচয় করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে বাংলাদেশের জন্য অর্থায়ন নিশ্চিত করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি বিধায় আমাদের অভিগম্যতা নিশ্চিত হয়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কারিগরি দক্ষতার ঘাটতির কথা বলা হলেও মূলত এটা সদিচ্ছার ঘাটতি উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমরা অনেক অঙ্গীকারের কথা শুনতে পাই কিন্তু বাস্তবে তার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না, যা সত্যিই উৎকণ্ঠার বিষয়। জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অনুমিত অবদান (এনডিসি), যেটি সরকার প্রণয়ন করেছিলো সেখানে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার করার যে অঙ্গীকার ছিলো, সেখানে বাস্তব ও কৌশলগত অগ্রগতির দৃষ্টান্ত দেখতে পাচ্ছি না। প্রশমন কার্যক্রমকে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কোনো পথনকশা প্রস্তুত করা হয়নি। ১৫ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ¦ালানি ব্যবহার নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক তহবিল সংগ্রহ করতে হবে, যা খুবই যৌক্তিক হওয়া সত্ত্বেও সরকার বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের পক্ষ থেকে এই তহবিল সংগ্রহের জন্য কোনো জোরালো পদক্ষেপ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। প্রস্তাবিত যে অর্থায়ন হওয়ার কথা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে তার মাত্র ৬ শতাংশ এখন পর্যন্ত আমরা পেয়েছি। তার মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ অনুদান বাকী অর্থ কিন্তু ঋণ বা অন্যান্য শর্ত সাপেক্ষে গ্রহণ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অর্থায়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এ চিত্রটি খুবই হতাশাব্যঞ্জক।”
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “পরিবেশ সুরক্ষায় আমাদের যে সাংবিধানিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার সেটিকে যথাযথ গুরুত্ব না দিয়ে এবং সে অনুযায়ী নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না করে উল্টো কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। যার স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি যে প্রভাব তা কিন্তু জনগণের ওপর পড়ছে। আমরা যেটা খুব পরিষ্কারভাবেই আমরা বুঝতে পেরেছি। বিশেষ করে আমাদের পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে আমাদের সরকারের বাস্তবায়নরত কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে প্রকল্পসমূহ রয়েছে তাতে বছরে ১ শত ১৫ মিলিয়ন টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন করবে। এতে করে আমরা দেখতে পারছি যে, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত একটি দেশ হয়েও আমরা বাস্তবে দূষণকারী দেশ হিসেবে পরিচিতি পেতে যাচ্ছি।”
গবেষণা প্রতিবেদনে যে ৭টি প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে সেখানে প্রতিটি প্রকল্পের ক্ষেত্রেই দুর্নীতি ও অনিয়মের চিত্র অত্যন্ত প্রকটভাবে উঠে এসেছে মন্তব্য করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরো বলেন, “প্রকল্পের যথার্থতা, জনগণের চাহিদা, সুবিধা ও প্রকল্প বাস্তবায়নের উপযোগী স্থান বিবেচনায় না নিয়েই রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রকল্পসমূহ গৃহীত ও বাস্তবায়িত হয়েছে। এর ফলে একদিকে আর্থিক অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে প্রশমন কার্যক্রমের বাস্তব কোনো সুফল আমরা পাচ্ছি না বরং এক শ্রেণির প্রভাবশালী মহল দুর্নীতি এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রতারণার মাধ্যমে লাভবান হচ্ছেন । গবেষণার আওতাভুক্ত ৭টি প্রকল্পে যে অর্থ বরাদ্দ ছিলো, তার প্রায় ৫৪ শতাংশ অর্থই অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেটি খুবই উদ্বেগজনক একটি বিষয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নীতি ও আইন লঙ্ঘিত হওয়া সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার কার্যকর কোনো পদক্ষেপও কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এছাড়া, বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে কার্যকর কোনো সমন্বয় পরিলক্ষিত হয়নি, আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ নেই বললেই চলে। এর ফলে অপচয় বাড়ছে এবং প্রশমন কার্যক্রমের কার্যকর সুফল আমরা পাচ্ছি না।”
গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন কার্যক্রমকে অধিকতর ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে টিআইবি ১০ দফা সুপারিশ প্রস্তাব করেছে। উল্লেখযোগ্য সুপারিশসমূহ হলো- অবিলম্বে প্যারিস চুক্তিতে প্রতিশ্রুত অনুদানভিত্তিক প্রশমন অর্থায়ন নিশ্চিতকরণে উন্নত রাষ্ট্রসমূহের ওপর বাংলাদেশের নেতৃত্বে স্বল্পোন্নত দেশসমূহের ঐক্যবদ্ধ কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ; জাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের সবুজ জলবায়ু তহবিলসহ আন্তর্জাতিক তহবিলসমূহে অভিগম্যতা অর্জনে আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়ের মাধ্যমে কার্যকর পথনকশা প্রণয়ন; কয়লা ও এলএনজির মতো জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক শক্তিতে বিনিয়োগ বন্ধ করে নবায়নযোগ্য খাতে বিনিয়োগ ও অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে; নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের অযৌক্তিক ব্যয় কমিয়ে সুলভে উৎপাদনে সরকারি প্রকল্পের ন্যায় বেসরকারি খাতে বিনিয়োগকারীদেরও একই ধরনের প্রণোদনা (কর অব্যাহতি এবং ক্যাপাসিটি চার্জ মুক্ত) প্রদান করতে হবে; বনায়ন ও বন্যপ্রাণী আবাস সংরক্ষণসহ বন ব্যবস্থাপনায় অগ্রাধিকারমূলক প্রশমন অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে; প্রশমন কার্যক্রমে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে বাস্তবায়নকারী সংস্থাসমূহের সুশাসন নিশ্চিতে ফলপ্রসু পদক্ষেপ গ্রহণের বিবেচনা সাপেক্ষে প্রকল্প অনুমোদন দিতে হবে; তথ্যবোর্ডে আবশ্যকীয় উল্লেখিত বিষয় সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন প্রণয়ন সাপেক্ষে সকল প্রকল্প এলাকায় তথ্যবোর্ড স্থাপনসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত তথ্য কর্মকর্তার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে; প্রকল্প তদারকি, নিরীক্ষা ও মূল্যায়ন প্রতিবেদন জনগণের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে এবং প্রকল্পের সকল পর্যায়ে জনঅংশগ্রহণসহ তৃতীয় পক্ষের স্বাধীন তদারকি নিশ্চিত করতে হবে; অভিযোগ গ্রহণের জন্য অভিযোগ বাক্স স্থাপন, মোবাইল নম্বর প্রদানসহ প্রকল্প এলাকায় গণশুনানির মাধ্যমে অভিযোগ নিরসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে; জলবায়ু ট্রাস্ট তহবিল ব্যবহার নীতিমালা, ২০১২ লঙ্ঘনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট শাস্তির বিধানসহ নীতিমালা সংশোধন করতে হবে।